বেকার হচ্ছে ‘মেরিন ক্যাডেট’

maritime_bg_459695844

সরকারি-বেসরকারি মেরিন একাডেমির সমন্বয়হীনতা এবং আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় বেকার হচ্ছে শত শত ‘মেরিন ক্যাডেট’। দিন দিন ‘পাস-আউট’ মেরিন ক্যাডেটদের বোঝা বাড়ছেই। বাংলাদেশে বর্তমানে পাস-আউট ক্যাডেট ও জুনিয়ার অফিসারসহ প্রায় ২ হাজার মেরিন ক্যাডেট বেকার রয়েছে।বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাব কনফারেন্স লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

‘অবিলম্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মেরিটাইম প্রজন্মকে রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এক্স-ক্যাডেটস অব বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি।

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশি মেরিন ক্যাডেটদের সুনাম রয়েছে। সম্ভাবনাময় এসব খাতকে টিকিয়ে রাখতে দেশে-বিদেশে তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরিতে সেসব দেশের সরকারি মেরিন একাডেমির নিজস্ব এজেন্সি থাকে। কিন্তু দেশে বা বিদেশে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির নিজস্ব কোনো এজেন্সি নেই। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে বিভিন্ন দেশ সরকারি উদ্যোগে নিলেও বাংলাদেশ কোনো উদ্যোগ নেয় না।

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, টাকার বিনিময়ে জাল সিওসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) নিয়ে নন ক্যাডেটরা বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিতে যোগ দেয়। পরে প্রমাণিত হওয়ায় বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশি মেরিনদের নেওয়া বন্ধ রেখেছে। মেরিন ক্যাডেট ও অফিসারদের জন্য নৌ, শ্রম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সম্ভাবনায় এ খাত ধ্বংসের মুখে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ১৯৮৯ সালে সুইডেনের ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি একটি গর্বিত শাখা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর একজন শিক্ষার্থী লিখিত, শারীরিক, মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তির সুযোগ পায়। একাডেমিতে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি রেজিমেন্টাল প্রশিক্ষণ নিতে হয়। একজন ক্যাডেট পাসড-আউট কার্ডকে ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য এক বছরের সেইফ টাইম অর্জন করতে হয়।

আরও জানানো হয়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি মেরিনারদের চাহিদা অনুসারে প্রথম ৪০টি ব্যাচে ২ হাজার ৪১২ জন ক্যাডেট পাস-আউট হয়। পরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই আটটি ব্যাচে এক হাজার ৩২৫ জন ক্যাডেট পাস আউট হয়। বিশ্ববাজারে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশি মেরিনার বাজার তৈরি হয়।

জানানো হয়, আগামী ডিসেম্বরে পাস-আউট ২৩৫ জন ক্যাডেট ও জুনিয়র ক্যাডেট হবে ৩১৫ জন ক্যাডেট। ৫১তম ব্যাচে ভর্তি হয়েছে আরো ৫ শতাধিক ক্যাডেট। অর্থাৎ দেশি-বিদেশি বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় গত ১০ বছরের প্রায় এক হাজার ৮৭৫ জন ক্যাডেট ও জুনিয়র ক্যাডেট বেকার হয়েছে। এক্ষেত্রে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকে দায়ী করা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪টি। প্রতিটি জাহাজে সবোর্চ্চ ২-৪ জন ক্যাডেট সি-টাইম সম্পন্ন করতে পারে। সে হিসেবে প্রতিবছর ৯০-১৬০ জন ক্যাডেট সি-টাইম সুযোগ পাবে।

অথচ দেশে লাইন্সেসপ্রাপ্ত ১৭টি বেসরকারি একাডেমি মিলিয়ে প্রতিবছর প্রশিক্ষিত ক্যাডেটের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮শ’ জন। দেশীয় ক্যাডেটের প্রশিক্ষণ সমস্যা ও বিদেশি জাহাজে যোগদান সমস্যার কারণে প্রতিবছর বেকার মেরিন ক্যাডেট সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ক্যাডেট কামরুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, পাস করায় এসব ক্যাডেট ও জুনিয়ার অফিসারদের দায় কেউ নিতে চায় না। নকল সিওসি করে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি নেওয়ায় সেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে মেরিন নিতে রাজি নয়।

তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি উদ্যোগে ও সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে প্রতিবছর বিশ্ববাজারে মেরিনারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টাও করা হয় না।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ভারতে ১৪৭টি মেরিন একাডেমি রয়েছে যেখানে প্রতিবছর ১৫ হাজার মেরিন ক্যাডেট বের হয়। এসব মেরিন ক্যাডেট বেকার থাকে না। অথচ আমাদের দেশে এক থেকে ২ হাজার মেরিনারের কর্মসংস্থান হয় না।

আমাদের দেশে বিদেশি কোনো কোম্পানির ম্যানিং ও অপারেশন অফিস নেই। যার কারণে কোনো নামিদামি কোম্পানি এদেশ থেকে মেরিন নিতে পারে না। অথচ ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ফিলিফাইনে ম্যানিং ও অপারেশন অফিস রয়েছে।

ক্যাডেট মো. ইমরান ওয়াহিদ ইমন বাংলাদেশি মেরিনারদের ভিসা সমস্যা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশি মেরিনাররা চাকরির সুযোগ পেলেও ভিসা জটিলতায় পড়তে হয়।

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ভিসা শুনলেই ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও আরব আমিরাতে কয়েক হাজার মেরিনারের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও ভিসা পুরোপুরি বন্ধ।

সরকারের কোনো উদ্যোগ না থাকায় ভারত, সিঙ্গাপুর, চীনসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি মেরিন ক্যাডেটদের অযথা হয়রানির শিকার হতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিদেশে বাংলাদেশি রিজিওনাল অফিস চালুর আহ্বান জানান তিনি।

জুনিয়র অফিসার দীপক শর্মা বলেন, বাংলাদেশে কত ক্যাডেট রয়েছে, কোথায় রয়েছে, কিভাবে রয়েছে তার কোনো সার্ভে হিসাব সরকারের কাছে নেই। এমনকি এসব ক্যাডেটদের বিষয়ে কোনো মনিটরিং করা হয় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বিভাগ থাকলেও তা অকার্যকর।

মেরিন একাডেমি, নৌ মন্ত্রণালয় এমনকি সরকারের কোনো ওয়েবসাইটে মেরিনারদের বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকায় সিওসি ও সিডিসি সনদপত্র যাচাই করা যায় না। ফলে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশি মেরিনার নিতে আগ্রহী হয় না। যেসব দেশে সীমিত আকারে মেরিনার যাচ্ছে তাও বন্ধের পথে।

ভিসা জটিলতা দূর, চাহিদা অনুযায়ী ক্যাডেট তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রতিশ্রুতি অনুসারে চাকরি দিতে না পারলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেস কয়েক বছর বন্ধ রাখা, জাল সিডিসি ও সিওসি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল, সিডিসি ও সিওসি সনদ যাচাই, বিভিন্ন দেশের বড় বড় শিপিং কোম্পানিকে এদেশে অফিস স্থাপন ও মেরিনার নিয়োগে আহ্বান জানানো, পানামা, লাইবেরিয়া, বাহামাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং মালেশিয়ায় মেরিটাইম কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া এবং নৌ, শ্রম ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে সমস্যা সমাধানে কাজ করার আহ্বান জানান দীপক শর্মা।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের পাস-আউট ক্যাডেট ও জুনিয়র ক্যাডেটরা উপস্থিত ছিলেন।

Source: banglanews24