সাইফুল্লাহর স্মার্ট বাড়ি

নাদিম মজিদ
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলম্বটেকবিডি ইন্টারনেট কাজে লাগিয়ে তৈরি করছে বাড়ির জন্য স্মার্ট প্রযুক্তি।  
024104joy_kalerkantho_pic

২৮ জুলাই। জাপানের টোকিও শহরের টোকিও ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম হলে চলছে কেবল টেক শো-২০১৬ মেলা। এক স্টলে একটি রোবটকে জাপানি ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। নির্দেশনা অনুযায়ী রোবটটি স্টলে রাখা লাইট অন-অফ করছে, লাইটের আলো কমাচ্ছে-বাড়াচ্ছে এবং একটি লাইট থেকে ২৫৬ রঙের আলো প্রদর্শন করে দেখাচ্ছে। মেলায় দর্শকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছিল এই রোবট। দর্শকদের মুগ্ধ করা এই প্রযুক্তি তৈরি করেছে বাংলাদেশি হাইটেক প্রতিষ্ঠান অ্যাপলম্বটেকবিডি। মেলায় অ্যাপলম্বটেকবিডি বাংলাদেশে তৈরি তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যও প্রদর্শন করে। জাপানের মেলায় তারা কাজটি করেছিল জাপানের স্বনামধন্য বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠান ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিকের সঙ্গে। নিজেদের দেশে ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিকের বেশ নামডাক রয়েছে। ৫০ হাজার কর্মচারী সরাসরি এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কম্পানির বার্ষিক আয় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। জাপানের স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠান অ্যাপলম্বটেকবিডির সঙ্গে কাজ করাকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

একজন সাইফুল্লাহ

অ্যাপলম্বটেকবিডি শুরু হয় জার্মানপ্রবাসী সাইফ সাইফুল্লাহর হাত ধরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ হিসেবে বেছে নেন জার্মানিকে। ভর্তি হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার্সে। ২০০৫ সালে মাস্টার্স করেন। কম্পিউটারের ডি র‌্যাম তৈরির কারণে বহুল প্রচলিত প্রতিষ্ঠান কিমন্ডায় যোগ দেন কনসেপ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। দুই বছর কাজ করে হেড অব কনসেপ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। সব কিছু ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা সব এলোমেলো করে দেয়। দেউলিয়া হয়ে যায় কিমন্ডা। বন্ধ হয়ে যায় ১২ হাজার কর্মচারীর প্রতিষ্ঠানটি।

কয়েক বছর জার্মানিতে থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে হাইটেক প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ভাবছিলেন সাইফুল্লাহ। দেশে হাইটেক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সৃষ্টি না হওয়ায় বাদ দেন সেই চিন্তা। জার্মানি থেকে নতুন কিছু তৈরি করে দেশে ফেরার কথা ভাবেন।

জার্মানিতে আছে, বাংলাদেশে নেই—এমন প্রযুক্তির তালিকা তৈরি করতে লাগলেন। প্রথমে কাজ করার জন্য বাছাই করেন ‘ভেহিকল নেভিগেশন সিস্টেম’। ভেহিকল নেভিগেশনের সাহায্যে গাড়ির অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয় করা যায়। কাজটি করতে করতে দেখেন, বিশ্বের বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভেহিকল নেভিগেশনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব মনে হয়। তাই ভেহিকল নেভিগেশন প্রযুক্তি তৈরির প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসেন।

২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান সাইনপালস। জার্মানির সাইনপালসে কাজ করছে ৩৬ জন, যার মধ্যে ২৮ জনই বাংলাদেশি। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ইন্টেল, ইনফিনিয়ন, সিমেন্সসহ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট কাজ করে দিত। এভাবে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল। কিন্তু সাইনপালসের কাজ মানুষ দেখছিল না। আর এভাবে আড়ালে থাকার ইচ্ছা কখনোই সাইফ সাইফুল্লাহর ইচ্ছা ছিল না।

তাই সাইনপালসের আয়ের একটি অংশ গবেষণা খাতে খরচ করার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষণা করার সময় মাথায় রাখতেন, ভবিষ্যতে কী ধরনের পণ্য বাজারে আসবে। সে ধরনের পণ্য তৈরিতেই ছিল তাঁর পুরো মনোযোগ। আর কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সময় বাংলাদেশিদের অগ্রাধিকার দেন।

অ্যাপলম্বটেকবিডি

সাইনপালসের সুবিধাগুলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ২০১২ সালে তিনি  অ্যাপলম্বটেকবিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করেন। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির অফিস চালু হয়। এরই মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইলেকট্রিক পণ্য নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। স্মার্ট ডিমেবল এলইডি, স্মার্ট ডিমেবল রেইনবো, স্মার্ট সুইচ, স্মার্ট ট্যাংক প্রভৃতি পণ্য তৈরি করছেন। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করে বাড়ির পর্দা, হিটার, এসি অন-অফ করার প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছেন। প্রযুক্তিগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বেও নতুন।

জার্মানি, জাপানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় অংশ নিয়ে প্রশংসিতও হয়েছেন। সেই সূত্র ধরে জাপানের স্বনামধন্য ইলেকট্রিক প্রতিষ্ঠান ফুরুকাওয়া, জার্মানির সিমেন্স, ইনফিনিয়নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজও করছেন।

এ ছাড়া এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসার চারটি পাম্পকে অটোমেশন করতে সাহায্যে করেছে অ্যাপলম্বটেকবিডি। পিডিবি কুমিল্লা শাখায় স্মার্ট মিটার বসানোর কাজও করছে তারা।

মেড ইন বাংলাদেশ

অ্যাপলম্বটেকবিডির উদ্ভাবিত সব পণ্যে লেখা থাকে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। বিশ্বের বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় এই পণ্যগুলো নিয়ে হাজির হন সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, “ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশও আছে। আমাদের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগান বিশ্বদরবারে পজিটিভ বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করছে।”

ভবিষ্যতে

স্মার্ট হোম টেকনোলজির আওতায় অক্টোবর থেকে স্মার্ট রাউটার বাজারে আনতে যাচ্ছে অ্যাপলম্বটেকবিডি। রাউটারের সাহায্যে ইন্টারনেটকে আরো সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করা যাবে।

 

অ্যাপলম্বটেকবিডির স্মার্ট পণ্য

 

স্মার্ট সুইচ

সুইচবোর্ডের বিকল্প হিসেবে কাজ করা স্মার্ট সুইচ হাতের সাহায্যে টাচস্ক্রিন ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একটি স্মার্ট সুইচ দ্বারা ছয়টি লাইট ও ফ্যান নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সুইচবোর্ডের ওপরে গ্লাস প্যানেল থাকায় ইলেকট্রিক শক খাওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই। প্রতিটি লাইট বা ফ্যান মাসে কী পরিমাণ বিদ্যুত্ খরচ করে, তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। স্মার্ট সুইচ ব্যবহার করা স্থানে কোনো কারণে আগুন ধরলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকারে দেখার জন্য স্মার্ট সুইচে ইন্ডিকেটর লাইট রয়েছে। অনুমোদিত একাধিক ব্যবহারকারী মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে এটি ব্যবহার করতে পারবে।

স্মার্ট ডিমেবল রেইনবো

অ্যাপলম্বটেকবিডির স্মার্ট ডিমেবল রেইনবোর একটি বাল্ব থেকে পাওয়া যাবে ২৫৬ ধরনের রং। প্রয়োজন অনুসারে আলো কমবেশি করা যায়। রাতে ঘুমানোর সময় ডিমিং বা আলো কমিয়ে রাখা যাবে। ড্রইংরুম, শোরুমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোর ভিন্ন রং ব্যবহারে এই বাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 

স্মার্ট ট্যাংক

স্মার্ট ট্যাংক ব্যবহার করলে একটি নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত পানি পূর্ণ হওয়া মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোটর বন্ধ হয়ে যায়। মোটর অন-অফও হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বাড়ির নিচে থাকা মোটরে পানি না থাকলে মোটর অন হবে না। এটি তত্ত্বাবধানের জন্য আলাদা কোনো খরচের প্রয়োজন হয় না।

 

স্মার্ট ডিমেবল এলইডি

স্মার্ট ডিমেবল এলইডি বাল্বের আলো স্মার্টফোন বা সুইচের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রয়োজন অনুসারে আলো বাড়ানো বা কমানো যায়। কম বিদ্যুতেও এটি জ্বলে। ব্যবহারকারী যে পরিমাণ আলো ব্যবহার করে, বিদ্যুত্ বিলও আসে সেই পরিমাণ। এতে বিদ্যুত্ খরচের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে গ্রাহকের।

যেভাবে কাজ করে

স্মার্ট ট্যাংক ছাড়া বাকি তিনটি পণ্য মোবাইল অ্যাপের সাহায্যেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পণ্যের প্যাকেটে দেওয়া ঠিকানা অনুসারে গুগল প্লেস্টোর এবং অ্যাপস্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপ ইনস্টল করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে অ্যাপের সাহায্যে এই তিনটি পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মোবাইল অ্যাপের সঙ্গে ইন্টারনেট না থাকলে ৩০ মিটার দূর থেকে পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ইন্টারনেট থাকলে যেকোনো জায়গা থেকে এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

স্মার্ট ট্যাংক ডিভাইস ৬৫০ টাকা, স্মার্ট ডিমেবল এলইডি ৫২০ টাকা, স্মার্ট ডিমেবল রেইনবো দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং স্মার্ট সুইচ দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি পণ্যে তিন বছরের ওয়ারেন্টি রয়েছে। পণ্য তিনটি বিক্রয় ডটকম, এখানেই ডটকমসহ বিভিন্ন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুক পেইজ www.facebook.com/aplombtech বা ০১৭০৬৭৬২৯৯৫ নম্বরে ফোন করেও অর্ডার দেওয়া যাবে।

Source: kalerkantho