গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও বলাৎকার

সলিমুল্লাহ খান

বাংলাদেশ এখন উন্নতির পথে চলিয়াছে। উন্নয়ন আমাদের ব্রত। অনেকদিন পর- এই সেই দিন- দেশটি উন্নতির মধ্যম শিখরে পৌঁছিয়াছে। উন্নতিটা আমরা অবশ্য আয় দিয়াই মাপিতেছি। একই সাথে গণতন্ত্রও আমাদের ব্রতের মধ্যে পড়ে। গত বছরের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে যে জয় হইয়াছে তাহাতে বর্তমান গণতন্ত্রের অপর পিঠও দেখা গিয়াছে। অনেক লোকে বলিতেছে, এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের জয় হয় নাই, হইয়াছে পরাজয়। তারপরও অস্বীকার করা যাইবে না- ১৯৯১ সালের পর হইতে এই দেশে গণতন্ত্র কায়েম হইয়া আছে।

মধ্যে মধ্যে খুনখারাবির খবর আসিয়া গণতন্ত্রের সুবাতাস দুর্গন্ধময় করিয়া থাকে এ কথাও অস্বীকার করিতে পারি না। খুনখারাবিও আবার নানান কিসিমের হইয়া থাকে। এই বিষয়ে বিচারকদের প্রধান অভিযোগ, সরকার কর্তৃক নিয়োজিত পুলিশ, ‘র‌্যাব’প্রভৃতি বিশেষ পুলিশবাহিনী, এমনকি কখনও কখনও সেনাবাহিনীর লোকজনও এই খুনখারাবির সহিত জড়িত। ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ প্রভৃতি সমেত আমি গত ২৫ বছরের কথা এক জায়গায় টানিয়া কথাটা বলিতেছি।

আরেক ধরনের খুনখারাবি হইতেছে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই ধরনের রাজনৈতিক রক্তপাত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শাসক রাজনৈতিক দলের প্রবর্তনায় ঘটিয়া থাকে। কখনো কখনো বিরোধী দলের প্রযোজনায়ও হইয়া থাকে এই ধরনের খুনজখম। আরও এক ধরনের রক্তপাত ঘটিতেছে ধর্মধ্বজাবাহী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে। ইঁহারাও টার্গেট করিয়াই হত্যা করেন। নিত্যদিনের নৈমিত্তিক হত্যাকাণ্ডের কথা এখানে না বলিলেও চলিবে।

গত এক মাসের মধ্যে আলোচিত দুই তিনটি বিশেষ হত্যাকাণ্ডের কথা মনে রাখিয়া আমি খুনখারাবির তৃতীয় একটি ধরনের কথাও আলোচনা করিব। সিলেট অঞ্চলের অনুর্ধ্ব ১৪ বছরের একটি শিশু বা কিশোর হত্যার পর খুলনা অঞ্চলে প্রায় সমবয়সী আরেকটি কিশোর হত্যা ঘটিয়াছে। বেশিদিন না যাইতেই একই বয়সী আরেকটি কিশোর হত্যার কাহিনীর কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে। এই ঘটনাটি বরিশাল এলাকার। মনে হইতেছে, উন্নতির মতন অপরাধের ঢেউও আছড়াইয়া পড়িতেছে সারাদেশে।

এই ঘটনাগুলির একটি অভিন্ন ব্রত আছে। দেখা যাইতেছে, এগুলি নিছক হত্যা নহে, ইহাদের আলপনায় ছক আছে অর্থাৎ হত্যার সহিত বলাৎকারের ব্রতও জড়িত আছে। ঘটনার বিবরণ হইতে বলাৎকারের ব্রত স্পষ্ট হইলেও আমি এ বিষয়ে বিশদ বিচার-বিশ্লেষণ কোথাও পড়িতে পাই নাই। হইতে পারে কেহ কেহ আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু আমি তাহাদের নাগাল পাই নাই। এখানে মনে হয় হত্যা, শোষণ ও ধর্ষকাম একাকার হইয়া গিয়াছে।

সিলেটের ঘটনা- অর্থাৎ কিশোর রাজন হত্যার কথা বলিতেছি। শোনা গিয়াছিল রাজন হত্যাকারীদের মধ্যে মন্টুনামা জনৈক চৌকিদারও জড়িত ছিল। কিশোর-কামী বলিয়া উহার একটা খারাপ পরিচয়ও সাধারণ্যে প্রচারিত ছিল। আর খুলনায় রাকিবকে যে ব্যক্তিরা হত্যা করিয়াছে তাহাদের পালের গোদার নাম ‘মিন্টু’। ইঁহারও ইতিহাস দেখিতে হইবে। রাজনকে যে কায়দায় পিটাইয়া হত্যা করা হয় তাহাকে মনোবিজ্ঞানীরা বহুদিন আগেই ‘ধর্ষকাম’ বলিয়া দাগ দিয়া রাখিয়াছেন। ইহাকেই আমরা বলাৎকার বলিতেছি। রাকিব হত্যা তো সাক্ষাৎ বলাৎকারই। বলাৎকার শব্দটির তুলনায় বর্তমানে ‘ধর্ষণ’ অধিক প্রচলিত হইলেও আমি বলাৎকার শব্দটির পক্ষ লইয়াছি আরেক কারণে। ইংরেজি ভায়োলেন্স বা বলপ্রয়োগের সহিত এই শব্দের নৈকট্য স্পষ্ট। তাহা ছাড়াও বলা যায়, ইংরেজিতে যাহাকে ‘রেপ’ বলে ফরাশি ভাষায় তাহার নাম ‘বিয়োল’। বাংলা ‘বলাৎকার’ শব্দে তাহার প্রতিধ্বনি কান পাতিলেই শোনা যাইবে।

এখন আসল কথায় আসি। পুরুষ ধর্ষণও ধর্ষণই। কিশোর বলাৎকারও বলাৎকারই। যে অপরাধের কথা রাষ্ট্র হইয়াছে সে অপরাধের আসল নাম বলাৎকারের সহিত খুন? না, ধর্ষণের পর হত্যা? না, তাহার অধিক গণ্য হইতে হইবে? ইহা হইতেছে অপরাধের প্রক্রিয়া বা ঘটনার বিবরণ মাত্র। কিন্তু আমাদের আরো কর্তব্য দাঁড়ায় এই অপরাধের কারণ ও ফলাফল দুইটাই আলোচনা করা। স্বীকার করি, মাত্র দুই কি তিনটা মামলার বিবরণ হইতে এই জাতীয় অপরাধের পূর্ণ কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোথাও না কোথাও হইতে তো শুরু করিতে হইবে। সঙ্গে আরও বলিয়া রাখিব, আমরা এখানে যাহাকে বলে বৈজ্ঞানিক আলোচনা তাহা করিতেছি না। শুদ্ধ দোহাই আকারে একটি দুইটি নাম ব্যবহার করিতেছি।

মনে রাখিতে হইবে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই ধরণের ঘটনা ঘটিয়া থাকে। উন্নতিব্রত দেশে তো বটেই। যখন কোন দেশে এই জাতীয় ঘটনা বারংবার ঘটিতে থাকে তখন ইহাকে নিছক ধর্ষকাম বা কামবিকৃতি বলিয়া ছাড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে না। আমার ধারণা, বিজ্ঞানীরা এই পুনরাবৃত্তির মধ্যে তাহারই প্রমাণ পাইয়াছেন যাহার নাম রাখা হয় এক প্রকারের ‘প্রতিক্রিয়াজাত মনোবিপর্যয়’বা রিয়েকশনাল সাইকোসিস। রিয়েকশনাল সাইকোসিসেরও নানা প্রকারভেদ আছে। আমার ধারণা, সিলেট ও খুলনার এই দুই ঘটনায় এই ধরনের সাইকোসিসের লক্ষণ আছে।

খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ফ্রানৎস ফানোঁর লেখা হইতে এই বিষয়ে হয়তো আমরা সামান্য সহায়তা পাইতে পারি। তবে বিশেষ বিশ্লেষণটা আমাদেরই করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, সকল ঘটনারই তিন মাত্রা থাকে: সামান্য, বিশেষ ও ইতর। আমরা আপাতত সামান্য লইয়াই আলোচনা সীমিত করিতেছি।

‘দুনিয়ার মজলুম’ নামে বিখ্যাত একটি গ্রন্থে ফানোঁ লিখিয়াছেন, পরাধীন দেশে- অর্থাৎ যে দেশে বিনাবিচারে দখলদার দেশের অত্যাচার চলিতে পারে সে দেশে- যখন বিদেশি দখলদারদের একতরফা অত্যাচার বিনাবাধায় চলিতে থাকে- তখন দেশীয় লোকেরা বিপুল সংখ্যায় মানসিক বিপর্যয়ের স্বীকার হয়। সহজ বাংলায় বলিতেছি মার খাইতে খাইতে যখন তাহারা প্রতিরোধের ব্রত হারাইয়া ফেলে তখন এই মানসিক রোগই ছড়াইয়া পড়ে। হাসপাতাল থাকিলে ভরিয়া যায়।

কিন্তু যখন দেশ স্বাধীন করিবার জন্য দেশপ্রেমিকরা মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন তখন আরেক ধরনের মানসিক রোগ বাড়িয়া যায়। ফ্রানৎস ফানোঁ লিখিয়াছেন আলজিরিয়ার ইতিহাসকে মূলধন করিয়া। ১৯৫৪ সালে শুরু হইয়া ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটবছর পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলিয়াছিল। ফানোঁ লিখিয়াছেন, যখন চারিদিকে শ্বাসরুদ্ধকর রক্তপাত চলিতেছিল, রক্তের নেশায় মানুষ পাগল হইয়া গিয়াছিল সেই নির্মম বিরূপ অমানবিক আবহাওয়ায় অনেক রোগী পাওয়া যাইতেছিল যাহারা মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলিয়াছিলেন। ফানোঁ এই রোগের নাম দিয়াছিলেন ‘প্রতিক্রিয়াজাত মনোবিপর্যয়’ (Psychoses réactionelles)।

এই জাতীয় বিপর্যয় বুঝিতে হইলে যে সকল ব্যক্তি এই অপরাধের সহিত জড়িত তাহাদের মনোজগত, আবেগ অনুভূতির জগত, এমনকি দৈহিক জগতের অবস্থাও হিসাবের মধ্যে টানিতে হইবে। তাহাতে সন্দেহ নাই। আমার প্রস্তাব শুদ্ধ এইটুকু যে তাহাতেও সবকিছু পরিষ্কার হইবে না। শুদ্ধমাত্র একটি কারণে বা হঠাৎ করিয়া এই জাতীয় মানস বিপর্যয় ঘটিতে পারে না। বাহিরের জগতও এই রোগীদের মনোজগতে প্রভাব ফেলিয়া থাকে। আমি সেই বাহিরের জগতের কথাটা মাত্র তুলিতেছি। আলজিরিয়ার মুক্তি যুদ্ধের সপ্তম বছরে- ১৯৬১ সালে- ফ্রানৎস ফানোঁ লিখিয়াছিলেন, আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ একদিন শেষ হইবে। কিন্তু ফরাশিরা যে আলজিরিয়া পেছনে রাখিয়া যাইবেন তাহাতে এই ধরনের মানসিক পঙ্গু মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম হইবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মাত্র নয় মাসে শেষ হইয়াছিল- এ কথা সত্য। কিন্তু ঐ নয় মাসের অভিজ্ঞতা এ দেশের জাতীয় মানসেও একটা স্থায়ী প্রভাব রাখিয়া গিয়াছে। একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথায় আমি পড়িয়াছি, সালুটিকর অপারেশনের পর তিনি এক পর্যায়ে নিহত পাকিস্তানী সৈনিকের রক্ত হাতে লইয়া পান করিয়াছিলেন।

স্বাধীনতার লাভের প্রায় ৪৫ বছর পরও কি আমরা সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাই নাই? যুদ্ধের পর আমাদের সমাজে সাধারণভাবে নৃশংসতার মাত্রা বাড়িয়াছে না কমিয়াছে? এই নৃশংসতার মধ্যে বিশেষ ‘বলাৎকার’ কি পরিমাণে বাড়িয়াছে? বিশেষ করিয়া খুলনার রাকিব নামক কিশোরের কাহিনী হইতে যাহা জানিলাম তাহা অমানবিকতায় সকল কাহিনীকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। আলজিরিয়ায় ফরাশি নির্যাতনকারীরা বহু অভিনব কায়দায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করিয়াছে। তাহাদের অভিধানে নাকে মুখে গরম পানি ঢালিয়া দেওয়া ছিল মুড়িমুড়কির মত অতি সামান্য ব্যাপার। মেয়েদের যোনিপথে গরম গরম সিদ্ধ ডিম ঢোকানোর কথা কাহারও অবিদিত ছিল না। সেখানেও শুনি নাই- পায়ুপথে মোটরযানের চাকায় বাতাস দেওয়ার পাইপ ঢোকানোর মত নৃশংসতার কাহিনী।

প্রশ্ন হইতেছে, পায়ুপথ কেন? আরও প্রশ্ন, পায়ুপথে বায়ুই বা কেন? এই বলাৎকারের সকাম চরিত্র ইহাতে স্পষ্ট। একটি ১৩ বছরের বালক, আপনার গ্যারেজের চাকুরিটি ছাড়িয়া আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কোন গ্যারেজে চাকুরি লইয়াছে। এই ‘অপরাধের’দণ্ড কেন পায়ুপথ খুঁজিতেছে? আর কেনই বা সেখানে বায়ু ঢোকানো হইতেছে, তাহাও পাইপযোগে! উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ‘কলিকাতা’ হইতে প্রকাশিত ‘সঞ্জীবনী’ নামক একটি পত্রিকায় ইংরেজ চা-কর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী ছাপা হইত। একবার এক কুখ্যাত ইংরেজ চা-কর এই রকম ১৪ বছরের একজন কুলি বা চা-শ্রমিককে পেটে লাথি মারিয়া মারিয়া মারিয়া ফেলিয়াছিল। ইহা অতি কুখ্যাত ঘটনা। মামলা হইয়াছিল। সেখানেও পায়ুপথের কথা শোনা যায় নাই।

ফানোঁ লিখিয়াছিলেন, পরাধীন দেশের নিপীড়িত মানুষ তাহার অস্থিমজ্জার মধ্যে ঢোকাইয়া রাখা আগ্রাসী মনোবৃত্তি বা বলাৎকার প্রবণতার প্রথম প্রকাশ ঘটায় তাহার স্বজাতির উপর। আমরা এখানে শুদ্ধ যোগ করিব সাবেক পরাধীন বা সদ্যস্বাধীন দেশের মজলুম মানুষও বিশেষ ব্যতিক্রম নহে। তাহাদের বলাৎকারের শিকার প্রথমে হয় তাহার স্বশ্রেণীর লোক- বিশেষ করিয়া স্বজাতির অর্থাৎ পুরুষ জাতির লোক। এই উন্নতির যুগে হয়তো এই কারণেই গরিব গরিবকে পিটাইয়া ছাতু বানায় আর পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট বাহিনী হিমশিম খাইতে থাকে। অপরাধীন দেশের অপরাধ অকুল সমুদ্রের ঢেউ হইয়া টাল খাইতে থাকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে অপরাধের ঢেউ যে দিনকেদিন বড় হইয়া অকুলে আছড়াইয়া পড়িতেছে তাহাও নিশ্চয়ই অকারণ নহে। এই ঢেউয়ের সহিত উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সভ্যতার সম্পর্ক প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: চিন্তাবিদ, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

Source: NTVbd.com