Site icon The Bangladesh Chronicle

Khaleda Zia has given an important statement about use of Military

সেনাবাহিনী নিয়ে মন্তব্য প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনেরা
শামছুদ্দীন আহমেদ
‘দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে সেনাবাহিনী বসে থাকবে না। তারা সময়মত দায়িত্ব পালন করবে। আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিদেশে শান্তি স্থাপনে কাজ করতে যায়। নিজ দেশেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তারা নীরব দর্শকের মত বসে থাকতে পারে না।’ বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এনিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ, চলছে নানামুখী আলোচনা। ইত্তেফাকের সঙ্গে পৃথক আলাপকালে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তারাও এটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের কেউ বলেছেন, এটা বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা রাজনৈতিক কৌশল। কারও মতে, তার এই বক্তব্য নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার কেউ বলছেন, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা খালেদা জিয়া প্রত্যাশা করছেন, তা অমূলক নয়। তবে যিনি যেভাবেই দেখছেন না কেন, উদ্ভূত কিংবা চলমান প্রেক্ষাপটে তার এই বক্তব্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বার্তাবহ সে ব্যাপারে একমত সবাই।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও সেনাবাহিনী-এ দুটি বিষয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় একসময় এনিয়ে মন্তব্য করা হত না। কিন্তু এখন অনেকেই মন্তব্য করেন। সেনাবাহিনীর মত একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তবে বিরোধী দলীয় নেতা ও একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসাবে খালেদা জিয়া এনিয়ে কথা বলতেই পারেন। তিনি নিশ্চয়ই দূরদর্শী, তা না হলে এতবড় দলের নেতা হতে পারতেন না। তাছাড়া তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, সে সুবাদেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিশ্চয়ই তার সুসম্পর্ক রয়েছে। সে হিসাবেও তিনি একথা বলতে পারেন। একথাও ঠিক যে, আমাদের সেনাবাহিনী বহু দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। নিজ দেশেও অশান্তি দেখা দিলে সেখানেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা তাদের দায়িত্ব। তা না হলে এনিয়ে তারা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। রবিবার মধ্যরাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক টকশোতেও তিনি খালেদা জিয়ার বক্তব্য সম্পর্কে এভাবেই মন্তব্য করেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘ নয় মাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, আর এর মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্রবাহিনী। এজন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কোনো মার্সিনারি বাহিনী নয় যে, দেশের ক্রান্তিলগ্নে বা দুর্যোগে তারা ভূমিকা রাখবে না। মুক্তিযুদ্ধে যেমন তারা ভূমিকা রেখেছেন, স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন সংকট-দুর্যোগে তারা এগিয়ে এসেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ তারাও এদেশেরই নাগরিক, তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরাও এদেশের নাগরিক। তাই দেশের সংকট তারা উপেক্ষা করতে পারেন না। দেশের যে কোনো সমস্যা, সংকট কিংবা দুর্যোগ অন্যান্য নাগরিকদের মত তাদেরও স্পর্শ করে। সেই বিবেচনায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সহিংসতার সময় পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে রবিবার বগুড়ায় এক জনসভায় খালেদা জিয়া আরও বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিদেশে শান্তি স্থাপনে কাজ করতে যায়। কিন্তু তাদের দেশে যদি শান্তি না থাকে তাহলে বিদেশিরা বলবে-আমাদের সেনাবাহিনী নিজের দেশে শান্তি রক্ষা করতে পারছে না। এসব আজ ভাবনার সময় এসেছে।

দলীয় চেয়ারপারসনের বক্তব্যকে সমর্থন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদক্ষ। অতীতে তাদের প্রশংসনীয় নানা ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের জন্ম। এই বাহিনীরই একজন সদস্য জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাও করে সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর দেশ বিনির্মাণেও তারা ভূমিকা রাখেন। প্রাকৃতিক কিংবা মানব সৃষ্ট, দেশের বড় বড় যে কোনো দুর্যোগেও তারা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কাজেই সেনাবাহিনী তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। কখন কী দায়িত্ব পালন করতে হবে- তা তারা জানেন। আগামী দিনগুলোতেও নিশ্চয়ই তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন। জেনারেল মাহবুব বলেন, আমি মনে করি, এসবকিছু বিবেচনা করেই খালেদা জিয়া ঐ বক্তব্য রেখেছেন। তাছাড়া তিনি রাজনীতি করেন, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, একটি প্রধান দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সুতরাং তিনি যা বলেছেন তা বুঝে-শুনেই বলেছেন।

অবশ্য খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যকে ভিন্নভাবে দেখছেন ক্ষমতাসীনরা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ও দেশের জনগণের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এজন্য বিকল্প পথে ক্ষমতায় যেতে তিনি সেনাবাহিনীকে উস্কে দিচ্ছেন। প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করেছেন দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও।

সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতারা যার যার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে এভাবে বিশ্লেষণ করলেও রাজনীতির বাইরের মানুষরা দেখছেন একটু অন্যভাবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতে, বিরোধী দলীয় নেতা যেটি বলেছেন সেটি তার রাজনৈতিক বক্তব্য। এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। সেজন্য তার এই বক্তব্য নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠতে পারে। সেনাবাহিনীর অতীত ভূমিকার বিচার-বিশ্লেষণে তার এই বক্তব্য যৌক্তিক কী অযৌক্তিক তা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে।

ড. আকবর আলি বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্য নিয়ে আইনি প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনার কথা বললেও এর সঙ্গে একমত নন দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বক্তব্যে শান্তিরক্ষার কথা বলা হয়েছে। এখানে মার্শাল ল’কে আহ্বান করা হয়নি। কারণ বিদেশে সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে যায়, সামরিক শাসন আনতে যান না। সুতরাং আমি যতটুকু বুঝি, খালেদা জিয়া সেরকম শান্তি প্রতিষ্ঠার কথাই বলেছেন, সেখানে অন্য কোনো ইঙ্গিত বা মার্শাল ল’র ডাক নেই।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা কীভাবে দেখছেন বিরোধী দলীয় নেতার এ বক্তব্যকে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহম্মেদ মনে করেন, মূলত আগামী নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে- তা এখনও ফয়সালা না হবার কারণেই এসব বক্তব্য সামনে চলে আসছে। যতদিন এ সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন দেশের ভেতরে যেসব স্টেকহোল্ডার রয়েছেন তাদের এবং সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে যারা ভূমিকা রাখেন তাদেরও এক ধরনের পরোক্ষ চাপ থাকে। তিনি বলেন, আমার ধারণা, নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে চাপে ফেলতেই বিরোধী দলীয় নেতা সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা বলেছেন। এটা বিরোধী দলের রাজনৈতিক কৌশল। তাদের ধারণা, সেনাবাহিনীর কথা বলা হলে হয়তো সরকার দাবি মানার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে।

Source: Ittefaq
Exit mobile version