Site icon The Bangladesh Chronicle

Kamaruzzaman hanged

কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি শনিবার রাত ১০টার পরপরই কার্যকর করা হয়েছে। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার পর তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যার যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। এর মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটলো তাকে গ্রেফতার ও বিচারের প্রায় সাড়ে চার বছরের দীর্ঘ পরিক্রমারও।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়ার আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল কামারুজ্জামানকে।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গ্রেফতার দেখানোর পর থেকে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে যুদ্ধাপরাধের ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে। তবে ট্রাইব্যুনালের আপত্তির পর রাষ্ট্রপক্ষ ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি পুনরায় ফরমাল চার্জ দাখিল করে।
 একই বছরের ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের ফরমাল চার্জ আমলে নেয় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে মামলাটি নব গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় ঐ বছরের ১৬ এপ্রিল। পরবর্তীতে ট্রাইব্যুনাল-২ এ নতুন করে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হয়।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
ঐ বছরের ১৫ জুলাই থেকে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১৮ জন রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট পাঁচজন।
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষ শেষ করে ৩১ মার্চ। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু করে আসামিপক্ষ। উভয়পক্ষের যুক্ততর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
মামলা সিএভি রাখার মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-২।
রায়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাত অভিযোগের পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন কামারুজ্জামান। ২০১৩ সালের ৬ জুন ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন তার আইনজীবীরা।
আপিলের এক বছরের অধিককাল পর ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই আপিল বিভাগে কামারুজ্জামানের আবেদনের উপর শুনানি শুরু হয়। ঐ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয়। শুনানি থেকে আপিলের রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন আদালত।
গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
আপিল বিভাগের দেয়া চূড়ান্ত রায়ে আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে দেয়া দণ্ড কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় কামারুজ্জামানকে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
এই অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে। সেদিন ওই গ্রামে রাজাকাররা ১৬৪ জনকে হত্যা করে। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।
চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পরদিন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। এরপর ৫ মার্চ মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা।
আসামিপক্ষের সময় আবেদনে দুই দফা পেছানোর পর ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষ হয়।
৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে তাঁর বিচারপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সমাপ্তি হয়। এর পরদিন খারিজের রায়ে স্বাক্ষর করেন আপিল বিভাগের চার বিচারপতি। এই স্বাক্ষরের কপি ট্রাইব্যুনাল হয়ে ৭ এপ্রিলই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
কামারুজ্জামানের দণ্ড এড়ানোর সবশেষ উপায় ছিলো রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা। তবে কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি বলে জানা গেছে।
এরপর শনিবার তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে চার দশকের বেশি সময় পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো।

যেভাবে তওবা পড়লেন কামারুজ্জামান

ফাঁসি কার্যকর করার আগে দণ্ডিত ব্যক্তিকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ি তওবা পড়াতে হয়। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাকে তওবা পড়ানো হয়েছে।
কারা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে রাত ৯ টার পর কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। ঐ সময় একজন ডিআইজি উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনার শেষ রাত। এই রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।
এর আগেই কামারুজ্জামান ওজু ও খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। এরপর তিনি এশার নামাজ আদায়ের পর নফল নামাজ আদায় করেন।
কারা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাকে প্রথমে বলেন, ‘আপনার কৃত কর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। কিন্তু আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃত কর্মের জন্য তওবা করেন।’
 এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।
Source: Ittefaq
Exit mobile version