Interview – Mina Farah; Human rights activist

mina-farah

মিনা ফারাহ। মানবাধিকার সংগঠক ও সুলেখিকা। জন্ম বাংলাদেশে হলেও এখন আমেরিকাপ্রবাসী। নুরেমবার্গ ট্রায়ালস, সিয়েরালিওন ও কম্বোডিয়ার যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধ বিচারের পক্ষে শুরু থেকে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তিনি রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন। তবে পরে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সাক্ষী হিসেবে। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। অন্য আরো অনেকের মতো তিনিও যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া এবং মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচার শুরুর পর। নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। একজন মানবাধিকার কর্মী ছাড়াও মিনা ফারাহর আরো বেশ কিছু পরিচয় রয়েছে। তিনি একজন সুলেখিকা। মধ্য বয়সের সঙ্কট, জীবন-যৌবন ও বার্ধক্য, ডিবির ফাঁদে নোবান আলীসহ এ পর্যন্ত তার ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর ১৯৮০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। নিউ ইয়র্কে রয়েছে তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। বাংলাদেশে তার গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলায়।

নয়া দিগন্তের সাথে তার সাক্ষাৎকার প্রশ্ন আকারে এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : যুদ্ধাপরাধ বিচারে আপনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু আপনি সাক্ষ্য দেননি। কেন?

মিনা ফারাহ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১০ এপ্রিল আমরা পরিবারের সবাই ভারত চলে যাই। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত থেকে বাড়ি ফিরে আসি। আসার পর শুনি আমাদের বাড়িতে ক্যাম্প করা হয়েছিল; কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। কাউকে দেখিওনি। কারো নামও আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না।  আমার কাছে তদন্ত কর্মকর্তা গিয়েছিলেন। আমি বলেছি আমি যা  শুনেছি তাই বলতে পারব। আমি নিজে কিছু দেখিনি এবং শোনা কথার বাইরে কিছু জানিও না। তারা আমার শোনা কথাই রেকর্ড করল। কিন্তু পরে আমি জানতে পারলাম আমি যা বলেছি তার সাথে তদন্ত কর্মকর্তার লিখিত জবানবন্দীর মিল নেই। এরপর  আপনাদের নয়া দিগন্তেই একটি প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে আমি আমাকে সাক্ষী হিসেবে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেই।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন সিয়েরালিওন, কম্পোডিয়া ও নুরেমবার্গ  ট্রায়ালস নিয়ে কাজ করেছেন। ওই সব বিচারের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের কী পার্থক্য পেলেন আপনি?

মিনা ফারাহ : নুরেমবার্গ ট্রায়ালে পাঁচটি দেশের আইনজীবী ছিলেন। বিচারকরা ছিলেন বিভিন্ন দেশের। কম্বোডিয়ার বিচার হয়েছিল জাতিসঙ্ঘের অধীনে ও নেতৃত্বে। সেখানেও বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী এবং বিচারকদের নেতৃত্বে প্যানেল গঠন করা হয়।  অন্য দিকে বাংলাদেশের বিচার হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশীয় আইন, দেশীয় আইনজীবী ও দেশীয় বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলের মাধ্যমে।

প্রশ্ন : তাদের সাথে বাংলাদেশের বিচারের মানের কি  কোনো পার্থক্য পেলেন?

মিনা ফারাহ : ইতোমধ্যে এ বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন পর্যন্ত যারা এ বিচার নিয়ে সমালোচনা করেছেন তারা সবাই সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বিষয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন। সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে সে বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ন্যুরেমবার্গ বিচার নিয়ে এখনো প্রশ্ন উঠছে। বলা হয় এ বিচার ছিল সান্ত্বনার বিচার। মানবাধিকার কর্মীরা এ বিচার নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ইহুদিদের খুশি করার জন্য তাড়াহুড়া করে সান্ত্বনাস্বরূপ এ বিচার করা হয়েছে বলে এখনো সমালোচনা হচ্ছে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে কি?

মিনা ফারাহ : ভবিষ্যতে কেন প্রশ্ন তো এখনই উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সর্বশেষ শাহবাগ থেকেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার বিষয়ে অনেক মামলা করেছি। মামলায় সবার একটিই চাওয়া থাকেÑ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা। সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে সে বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় আইনজীবী আছেন। তাদের কয়জন রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলায় নিযুক্ত হয়েছেন? রাষ্ট্র তাদের কয়জনকে নিযুক্ত করতে পেরেছেন? একজনও না।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার ও সর্বশেষ শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলনের কারণে জাতি দুই ভাগে বিভক্ত এবং সঙ্ঘাতের মুখে পড়েছে বলে অনেকে বলছেন । আপনি কী মনে করেন?

মিনা ফারাহ : শাহবাগ থেকে যেসব দাবি করা হয়েছে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল; তা বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। ফাঁসি ছাড়া ঘরে ফিরব না, ফাঁসি ছাড়া কোন রায় গ্রহণ করা হবে না, ফাঁসিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য রায়Ñ এ ধরনের দাবি কোনো সুস্থ দাবি  হতে পারে না। এটি বিচার চাওয়ার ভাষা হতে পারে না। আমি বিচার চাই। এখানে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রমাণপত্র ট্রাইব্যুনালে সরবরাহ করেছে তার ওপর ভিত্তি করেই রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তার বাইরে তো তারা যেতে পারবেন না। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে ২৪ জনের মধ্যে ১২ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সাতজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। পাঁচজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। কাজেই খালাস দেয়া যাবে না, ফাঁসিই দিতে হবে এটি কোনো বিচারের কথা হতে পারে না।   শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটি সরাসরি বিচারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের  হস্তক্ষেপ। এর মাধ্যমে এ বিচার আরো বিতর্কিত হয়েছে। ভবিষ্যতে কেউ একে উদাহরণ হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে।

জাতিকে বিভক্ত করা এবং ধর্মীয় রাজনীতি বিষয়ে এখন যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে সে বিষয়ে আমি বলতে চাই, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। দেশ বিভাগ বিষয়ে যে ভোটাভুটি  হয়েছিল তাতে এ অঞ্চলে অর্থাৎ আমরা ৯৬ শতাংশ মানুষ তখন দেশ ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম। অন্য দিকে পাঞ্জাবে  ৪৯ শতাংশ মানুষ দেশ ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আমরাই চেয়েছিলাম পাকিস্তান নামে একটি আলাদা রাষ্ট্র। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো সেই চেতনা ধারণ করে। কাজেই তাদের বিপক্ষে ঠেলে দিলে, তাদের অধিকার কেড়ে নিলে সঙ্ঘাত হবে। দেশের অধিকাংশ মানুষকে বিপক্ষে ঠেলে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

প্রশ্ন : একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

মিনা ফারাহ : আমি গভীর আশঙ্কা বোধ করছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন আতঙ্কিত নাগরিক হিসেবে আমি ঢাকাস্থ আমেরিকার দূতাবাস দফতরে নাম লিখে এসেছি। এটি আগে কখনো হয়নি। এবার হলো। বাংলাদেশে এখন সব দিক দিয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এত সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও দেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা কারো কাম্য নয়। সরকার মানুষের নাড়ি বুঝতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন এ বিচার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?

মিনা ফারাহ : বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে এ বিচার রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত। বিরোধী দল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে সরকারের নিজ দলেও যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। আমরা সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। এটি না হলে এবং নিরপেক্ষভাবে বিচার  করা না হলে বিচার নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই।

মিনা ফারাহ নিজ থেকে বলেন, আমি সম্প্রতি আপনাদের পত্রিকায় লেখালেখি করার কারণে অনেকে আমার সমালোচনা করছে, প্রশ্ন করছে। আমি বলতে চাই যেখানেই আমি আমার কথা অবিকৃত আকারে প্রকাশ করতে পারব, মানুষের কাছে আমাদের কথা পৌঁছাতে পারব সেখানেই আমি লিখব। আমি নয়া দিগন্তের মাধ্যমে আমার কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি গণমানুষের কাছে। জনকণ্ঠ বা প্রথম আলোও যদি আমাকে বলে তোমার লেখা আমরা হুবহু  প্রকাশ করব তা হলে তাদের পত্রিকায় লিখতেও আমার আপত্তি নেই।

Source: Naya Diganta