Checking reality

Minar Rashid

মালয়েশিয়ার স্বপ্ন, অন্য রকম বাস্তবতা

(দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় কলাম)
বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদকে পাওয়া গেছে কামরূপ কামাখ্যার কাছাকাছি একটা জায়গায়। সব বিতর্ক এড়াতে এখন সহজেই বলা যায়, সুখরঞ্জন বালির মতোই জিন পরীরা তাকে আসামে কামরূপ কামাখ্যার কাছাকাছি একটা মুল্লুকে নিয়ে ফেলে এসেছে। কারণ কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে দু’টি দেশের দু-দু’টি বর্ডার গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবে বর্ডার অতিক্রম করা একমাত্র জিন পরীদের পইে সম্ভব। মনের মধ্যে অহেতুক খোঁচানো বন্ধ করার জন্য এই বিশ্বাসটিকেই আপাতত পোক্ত করে রেখেছি।
জর্জ বার্নার্ড শ-এর গার্লফ্রেন্ড একবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘বলো তো ডিয়ার, তোমার মেধা এবং আমার রূপ নিয়ে যদি আমাদের কোনো সন্তান জন্ম নেয়, তবে তা কেমন হবে?’ দারুণ উচ্ছ্বসিত এই গার্লফ্রেন্ডের উচ্ছ্বাসে একেবারে ঠাণ্ডা জল না ঢেলে কুসুম গরম জল ঢাললেন- তোমার এই ভাবনাটি সত্যি চমৎকার। তবে ব্যাপারটি উল্টো হয়ে গেলে কেমন হবে। বলছিলাম মানে, যদি তোমার মেধা এবং আমার রূপ নিয়ে কোনো সন্তানের জন্ম হয়?
দেশটি মালয়েশিয়া হয়ে যাবে আর আমাদের নেত্রী হবেন মাহাথির মোহাম্মদ! এ ধরনের আশাবাদ দেশের বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের মুখে শুনে জর্জ বার্নার্ড শ-এর উপরিউক্ত ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। মালয়েশিয়ার গুণ আর বাংলার রূপ মিশিয়ে তারা এই স্বপ্নটি দেখছেন। কিন্তু উল্টো হলে কী হবে, তা বোধহয় ভাবছেন না। মন্ত্রী-সান্ত্রীরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যে, দেশটি মালয়েশিয়া হয়ে যাওয়ার পথে পড়ে গেছে। কিন্তু সিম্পটম বা আলামত দেখে দেশবাসী দুঃস্বপ্ন দেখছে উত্তর কোরিয়ার।

উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাদের বালক লিডারের বক্তৃতা চলার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ‘মরার ঘুম’ কাকে বলে বিশ্ববাসী তা চাক্ষুস দেখেছে। এই অপরাধে আক্ষরিক অর্থেই গোলার আঘাতে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু দিন আগে নিজের ফুফাকে (দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি) ক্ষুধার্ত কুকুর দিয়ে ভক্ষণ করিয়েছেন এই খ্যাপা বালক।

জটিল এই বিষয়টিকে আমাদের নিজেদের ভাবনায় সহজ অনুবাদ করলে এ রকম দাঁড়ায় : মনে করুন, দেশে পঁচাত্তরের আগস্টে কোনো কিছু ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট হয়ে স্বাভাবিকভাবেই ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিঃসন্দেহে শেখ কামাল ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী। ঘটনা পরম্পরায় হঠাৎ ২০১১ সালে ষাটোর্ধ্ব শেখ কামালেরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তখন বিশ বা ত্রিশের কোটায় থাকা শেখ কামালের তরুণ ছেলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতেন।

এখান থেকে আবার একটু পেছনে যেতে হবে। ষাটের দশকে অনেক কিংবদন্তি ছাত্রনেতা আশপাশে থাকলেও শেখ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রটিকেই তার মেয়ের জামাই হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি চেতনায় সিক্ত শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে নিজের মেয়েকে নয়, সম্ভবত এই মেধাবী জামাতাকেই অধিকতর ক্ষমতাশালী করে রাখতেন।
কিম জং উনের দাদা এবং জাতির পিতা কিম ইল সাং সম্ভবত এমনভাবেই নিজের আদরের মেয়ের জামাইকে ক্ষমতার আশপাশে রেখে দ্বিতীয় শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। যেসব দেশে স্বাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা বদলের উপায় অবশিষ্ট থাকে না, সেসব দেশে ফুফা কেন – ভাই ভাইকে, বাবা ছেলেকেও এমনভাবে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। গণতন্ত্র মানব জাতিকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

বাংলার দুঃখজনক ইতিহাসটি উত্তর কোরিয়ার ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, কিম জং উনের দাদা ও তাদের জাতির পিতা তার সব পুত্র ও স্ত্রী পরিজনসহ নিহত হয়েছেন। শুধু তার একটি কন্যা বেঁচে রয়েছেন। সেই কন্যাই হয়েছেন এখন উত্তর কোরিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
কাজেই কিম জং উনের দাদা যদি সত্যি সত্যি সপরিবারে নিহত হতেন তবে আজ উত্তর কোরিয়ার সোনার পালঙ্কে শুয়ে গুমরে কেঁদে ওঠা ফুফুর জন্য তা আসলেই আশীর্বাদ হয়ে পড়ত। এটারই নাম দুনিয়া। যার এক কূল ভাঙে, অন্য কূল গড়ে।

বাংলাদেশের ইতিহাস উত্তর কোরিয়ার মতো হলে কী হতো অথবা উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস বাংলার মতো হলে কী হতো- আশা করি ওপরের এই মানসিক এক্সারসাইজে তা স্পষ্ট হয়েছে। কাজেই যারা দেশটিকে আজ মালয়েশিয়া বানানোর স্বপ্ন দেখছেন তাদের সামনে উত্তর কোরিয়ার উদাহরণটি মজুদ থাকা দরকার।

এটা সত্য যে, পৃথিবীর একটি ঘটনার রিপিট হয় না, অন্য কোথাও একইভাবে ঘটে না। তবে কাছাকাছি ঘটে থাকে।
বিরোধী দল শেষ হয়ে গেলে নিজের দলের মধ্য থেকেই বিরোধী পক্ষ তৈরি হয়ে যাবে। আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিরা তখন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রতিপক্ষের ঘরের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে আসবে। সর্বস্তরে এক নম্বর ব্যক্তি ছাড়া যেকোনো সময় অন্যরা গুম হয়ে যেতে পারেন।

মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো জাতিই একধরনের পরাবাস্তব জগতে চলে গেছে। অর্থাৎ The whole nation is on halucination stage. দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, কেউ যেন এই জাতির ওপর কোনো প্রতিশোধ নিচ্ছে। মনের আক্রোশ মেটাচ্ছে। জাতি যন্ত্রণায় যত কোঁকড়ায়, সেই সত্তাটি তত প্রশান্তি অনুভব করে। একটা জাতিকে ধ্বংস করার যত উপায় আছে, তার সবই করা হয়ে গেছে।

ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদির প্রান্ত বরাবর কিছু ত্রুটিরেখা সব সমাজে, সব দেশেই সৃষ্টি হয়েছে। এই বাস্তবতা বা নিয়মকে লঙ্ঘন করে নয়, বরং এটাকে মেনে নিয়েই আধুনিক বিশ্বের সব রাষ্ট্রে শান্তি বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুনিয়ার সবচেয়ে আলোকিত অংশ, ইউরোপে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংখ্যাগুরুদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ফলে ব্রিটেনের মতো দেশ ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাপারে আরো কঠোর হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশ তাদের ডেমোগ্রাফিক ক্যারেক্টারিস্টিক বা জনসংখ্যার আনুপাতিক বৈশিষ্ট্যটি ধরে রাখতে চায়। মুখে যা-ই বলুক না কেন, দেশ পরিচালনার মূল চাবিকাঠি সংখ্যাগুরুদের হাতেই রাখতে চায়।

এখন যদি হঠাৎ আমেরিকার প্রশাসনে আরব অথবা ইন্ডিয়ান অরিজিন ব্যক্তি দিয়ে ভরে ফেলা হয় তবে সেখানকার সবচেয়ে আলোকিত ও উদার অধিবাসীরাও চরম সাম্প্রদায়িক আচরণ শুরু করবেন। তেমনিভাবে ইন্ডিয়ার প্রশাসনে যদি মুসলিমদের সংখ্যা অনুপাতের চেয়ে মাত্রাধিকভাবে বাড়ানো হয় তবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশটির জনগণের প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হবে না। এই অন্যায্য কাজটি করা তো দূরে থাকুক, এমন ভাবনা কল্পনাতেও ঠাঁই দেয়া অসম্ভব।

এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একচেটিয়া প্রাধান্য দেখা যায়। এটা নিয়ে উদার বিশ্ব বা সেখানকার সংখ্যালঘুরা কখনোই উষ্মা প্রকাশ করে না। ইউরোপের প্রতিটি দেশেও তাই। তেমনিভাবে জাপানের রাষ্ট্র পরিচালনায় বৌদ্ধদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইন্ডিয়ায় হয়েছে হিন্দুদের, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মুসলিমদের। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উদার, তারা বড়জোর দু-একজন সংখ্যালঘুকে জায়গা করে দিয়েছেন। অনুদাররা তাও করেননি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এ ধরনের অনুদারের নমুনা ‘আলোকিত’ বিশ্বেই বেশি দেখা যায়।
পৃথিবীর সব সংখ্যালঘু এই বিষয়টি স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন। একটি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যা গুরুদের এই প্রত্যাশাটি পূরণ করা হয়।

বাংলাদেশের প্রশাসনে যা শুরু হয়েছে তাকে আর যা হোক, স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। ২২ জন অতিরিক্ত সচিবের ১৪ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে নেয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংখ্যালঘু আর পাননি বলেই আটজন সৌভাগ্যবান সংখ্যাগুরু এই সুযোগটি পেয়েছেন।
দেশে গণতন্ত্রকে গলাটিপে ধরার পর এ ধরনের নিয়োগ সঙ্কটাপূর্ণ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। জব ইজ ডান। সাতচল্লিশের আগে শেখ মুজিবের পূর্বপুরুষ যে কথাটি বলতে পারতেন, এখন তার সন্তানসন্ততিরা সেই কথাটি বলতে পারছেন না। অনেক সঙ্কোচ, অনেক দ্বিধা, অনেক ভয়। এক হাতে চকোলেট, অন্য হাতটি ছেলেধরার মুঠিতে। সেই চকোলেট চুষতে চুষতে অপরিণামদর্শী এই জাতি সামনের পানে অগ্রসর হচ্ছে।

চেতনার কথা বলেই এই চেতনানাশক ইনজেকশনটি জাতির শরীরে পুশ করা হয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকীরা এখন টেলিভিশনের সামনে এসে বিলাপ করলেও আর কোনো কাজ হবে না।
এই অস্বাভাবিকতা সংখ্যালঘু অথবা সংখ্যাগুরু কারো জন্যই স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনবে না। এ ধরনের উদ্যোগ যেকোনো দেশ বা সমাজের মতো আমাদের দেশেও সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয় কি না, সে ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তাভাবনা করতে পারেন। রেসিয়াল হারমনি বা সামাজিক ঐকতান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি হুমকিস্বরূপ।

মাহাথির মোহাম্মদের কম গণতান্ত্রিক বলে যে দুর্নাম ছিল, সেই দুর্নামের ফলটুকু তিনি সর্বদা সংখ্যাগুরুকেই খাইয়েছেন। সংখ্যাগুরুর প্রতি তার অনেক পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়েছে। সংখ্যাগুরুদের বঞ্চিত করেননি। তার সপক্ষে নিজের বলিষ্ঠ যুক্তি তুলে ধরেছেন।

শরীরের থেকে লেজ বড় হয়ে গেলে কোনো জানোয়ার স্বাভাবিক নড়াচড়া করতে পারবে না। সেই ধরনের উদ্ভট এক জানোয়ারের পিঠে যেন দেশটিকে আমরা উঠিয়ে না দিই।

1 COMMENT

  1. Excellent article. Yes, we are not far off DPRK (North Korea). There is no democracy, no human rights, no justice. There is only praise for the ruler – whatever she does.

    I do not know where the nation is heading. The future looks bleak. May Allah help us.

Comments are closed.