মহাত্মা লালন ফকির- কাঙাল হরিনাথ

From a Facebook entry of Harun Or Rashid
17 October 2021
” বাউল সাধক মহাত্মা
লালন ফকির “
লৌকিক বাংলার সাংস্কৃতিক পুরোধা ব্যক্তিত্ব লালন সাঁই তাঁর সাধনা ও উপলব্ধির মাধ্যমে জাগরণের যে তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন তা বিস্ময়কর! আজ এই সাধক পুরুষের ১৩১ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লালন ছিলেন একাধারে বাউল সাধক, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক এবং মানবতাবাদী। অসংখ্য গানের গায়ক, গীতিকার এবং সুরকার। তৎকালীন সময়ে মানুষের উপর নিপীড়ন, জাতিভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা সহ সমাজ জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতাকে তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর গানের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক মনোভাবই ছিল তাঁর রচনার মূলমন্ত্র। তাঁর রচিত গান যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবিকেও। লালনের সঙ্গীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সম্পাদক সর্বোপরি গ্রামের সাধারণ মানুষও।
লালনের বাল্য জীবন সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর, বাংলা ১লা কার্তিক তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ড উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কিছু লালন বিশেষজ্ঞের মতে, তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। পিতা শ্রী মাধব কর আর মাতা শ্রীমতী পদ্মাবতীর সংসারের একমাত্র সন্তান তিনি, প্রকৃত নাম লালন চন্দ্র কর। শৈশবেই পিতাকে হারান তিনি। ফলে অল্প বয়সেই লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। মাতৃভক্ত লালন মায়ের সেবার উদ্দেশ্যে বিশাখাকে বিয়ে করে সংসারে মনোনিবেশ করেন।
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তিনি। গ্রামে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পালাগান, কবিগান বা কীর্তনে তার গান শুনে মুগ্ধ হতো মানুষ।
পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে তরুণ বয়সে প্রতিবেশী ও সঙ্গীসাথী নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বের হন তিনি। পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। অসুখের তীব্রতা বাড়লে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। তাঁর সাথীরা তাকে মৃত কল্পনা করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। মৃত্যুর খবরে মা ও স্ত্রী মুষড়ে পড়ে। পরবর্তীতে সমাজের চাপে, রীতি অনুযায়ী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাধ্য হন তারা।
অপরদিকে, নদীর জলে ভেসে ভেলা অপর পাড়ে পৌঁছালে এক মুসলিম নারী, মতিজান তাঁর হৃদস্পন্দন আছে দেখে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান। সেখানেই মতিজান ও তার স্বামী মলম শাহের শুশ্রূষার ফলে নতুন জীবন ফিরে পায় লালন। দুর্ভাগ্যবশত গুটিবসন্ত রোগে এক চোখ হারান তিনি। সুস্থ হয়ে হৃষ্ট চিত্তে গ্রামে ফিরে আসেন। তাঁর অপ্রত্যাশিত আগমণে স্ত্রী ও মাতার হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে। কিন্তু সেই আনন্দ কিছুক্ষণের মাঝেই হাহাকারে পরিণত হয়।
তাঁর ফিরে আসার সংবাদে গ্রামের মানুষ তাকে দেখতে ছুটে আসে। সমাজপতিরা তাকে জীবিত মেনে নিতে অস্বীকার জানায়। মুসলিম ঘরে জলপান করায় বিচ্যুত করা হয় পরিবার তথা সমাজ থেকে। জাতি, ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয় যা তিনি সহ্য করতে পারেননি। স্ত্রীকে সাথে নিতে চাইলে সমাজের শাসন আর ধর্মের বেড়াজাল ভেদ করে যাওয়ার মনোবল জড়ো করতে পারেননি বিশাখা। লালন চলে যাওয়ার অল্প কিছুদিনের মাঝেই শোকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ঘর-বাড়ি, পরিবার ছেড়ে, সমাজের উঁচু-নিচু জাত প্রথার প্রতি বিতৃষ্ণা যেন নতুন এক লালনের জন্ম দেয়। পরিচয় ঘটে একজন মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে। তার সান্নিধ্যে লালনের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে। সিরাজ সাঁইকে গুরু মেনে তিনি লালন শাহ্‌ থেকে হয়ে উঠলেন লালন সাঁই। এই জাত ধর্ম নিয়ে তার আক্ষেপ থেকে সৃষ্ট গান-
“জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা—
আসবার কালে কি জাত ছিলে ?
এসে তুমি কি জাত নিলে ?
কি জাত হবে যাবার কালে?
সে কথা ভেবে বলো না”
আনুমানিক ২৩৬ বছর পূর্বে গুরুর নির্দেশে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউরিয়া গ্রামে কালীগাঙ্গের ঘন জঙ্গলে আম গাছের নিচে লালন তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় বেড়াজাল, জাত, বর্ণের উঁচু নিচু প্রভেদ দূর করতে সাধনা শুরু করেন। একই আকাশের নিচে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সবাই এক; তেমনি একটি দেশ চেয়েছিলেন লালন।
ধীরে ধীরে তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে হিন্দু-মুসলিম পরিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে শুরু করে। শিষ্যদের নিয়ে যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার শুরু করেন। তাঁর আসম্প্রদায়িক মনোভাব, সমাজের লৌকিকতার বিরুদ্ধে রচিত গান সাধারণ মানুষের মন জয় করে। জীবনের বাকি সময় তিনি সেখানেই কাটিয়ে দেন।
‘গ্রাম বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ একবার জমিদারের অত্যাচারের বর্ণনা পত্রিকায় তুলে ধরলে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী তাকে মারতে তেড়ে আসে। তখন বাউল লালন সাঁই তাঁর শিষ্যদের নিয়ে তাদের প্রতিহত করে কাঙাল হারিনাথকে রক্ষা করেন। হারিনাথের মাধ্যমে লালনের পরিচয় ঘটে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের সাথে।
মাতৃভক্ত লালন তাঁর সব সাধনার মাঝেও মায়ের স্থান হৃদয়ে রেখে কাজ করে গেছেন। মায়ের মৃত্যু সংবাদে তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছুর জোগাড় নিজ আখড়া থেকেই পাঠিয়ে দেন, যদিও সমাজের রীতিনীতির বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে তিনি সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি।
মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে লালন ও তাঁর শিষ্যেরা পদে পদে পদদলিত হয়েছেন। কোথাও কোথাও বাউলদের চুল কেটে অথবা হাতের একতারা ভেঙে তাদের বাঁধা দিয়েছে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা। কিন্তু কোনো বাঁধা তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি মতাদর্শ থেকে।
লালন শাহের মৃত্যুর পর মলম শাহের দেওয়া ১৬ বিঘা জমি নিলামে উঠলে, ইসমাইল শাহ্‌ সেটা কিনে সাঁইজীর শেষ স্মৃতি রক্ষা করেন। এভাবে লালন ভক্তরা তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
লালন রচিত গানের কোনো লিখিতরূপ ছিল না তাই সঠিক সংখ্যা অনুমান সম্ভব হয়নি। তিনি হঠাৎ করেই মুখে মুখে গান বেঁধে গাইতে শুরু করতেন। ভক্তদের হিসেবে তাঁর রচিত গানের সংখ্যা অনুমানিক ১০ হাজারের মতো। পরবর্তীতে মানিক শাহ্‌ ও মনিরুদ্দিন শাহ্‌ সাঁইজীর গান খাতায় লিখে সংগ্রহ শুরু করেন। ফলে সেসব গান বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর, বাংলা ১২৯৭ সালের পয়লা কার্তিক ১১৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মহাত্মা ফকির লালন শাহ। নিজ আখড়ায় সারারাত শিষ্যদের নিয়ে গান বাজনা করে ‘আমি চলিলাম‘ বলে তিনি আসর থেকে বিদায় নেন।
গান্ধীজীরও প্রায় ২৫ বছর পূর্বেই তাকে ভারতীয় মহাদেশে প্রথম ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়। মৃত্যুর ১২ দিন পর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পত্রিকা ‘হিতকরী’তে রাইচরণ নামক লেখকের লিখিত একটি রচনায় তাঁকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দার্শনিক এই সাধক, বাউল গানের অগ্রদূত লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত। শিষ্যরা তাকে ‘সাঁইজী’ নামে ডাকেন।
লালন সাঁইয়ের মৃত্যুর ২ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আখড়ায় যান, সেখানে তিনি তার দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে লালনকে নিয়ে প্রায় ১০০টির বেশি গান রচনা করেন। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তার আদর্শে রচনা করেন ‘After lalon’ নামে একটি কবিতা। ১৯৬৩ খ্রীস্টাব্দে তার আখড়ায় ‘লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র‘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে তা পরিবর্তিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লালন একাডেমী‘।
একতারা হাতে মাঠে-ঘাটে মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তনের জন্য মানবতার গান গেয়েছেন। তবে তার সমাজচিন্তা, মানবপ্রেম এবং মনুষ্যত্ববোধের উপলব্ধি আজও উপেক্ষিত। লালন সাঁই গান লিখেছিলেন- “এসব দেখি কানার হাটবাজার—।” গানের কথাগুলো এখনকার সমাজের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
তাঁর গানের কয়েকটি লাইন এখানে প্রাসঙ্গিক:
“পন্ডিত কানা অহংকারে
মাতব্বর কানা চোগলখোরে
আন্দাজি এক খুঁটো গেড়ে
চেনে না সীমানা কার..”
লালন প্রতীকী অর্থে একচোখা রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত পন্ডিত বুদ্ধিজীবীদের প্রসংগ টেনে হয়তো এসব পঙতিগুলি সাজিয়েছেন। এঁরা সবাই জনগণকে ডাকছে, নানান তত্ত্ব ফেরি করে বেড়াচ্ছে। উদ্ধার পেতে হয়তো স্মরণ করে বলতে হবে ‘এসো দয়াল,পার করো ভবের ঘাটে।’
গোঁড়া ধর্মীয় সমাজপতিরা তাঁকে ‘নাস্তিক’ বলে সম্বোধন করলেও তিনি তাঁর মতবাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তাই লালন চলে গেলেও আজও মানুষ তাকে স্মরণ করে। মানব মুক্তির উদ্দেশ্যে রচিত গানের জন্য আজও বিশ্ব দরবারে তিনি দাপটের সাথে সমাদৃত।
লালন ভক্তরা এখনো তাঁর উদ্দেশ্যে গেয়ে যায় তাঁরই রচিত গান- “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়~!, বাড়ির কাছে আরশি নগর ~~♪♪♪ মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়তো; লালনের সেই বিখ্যাত কথা ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’
© হারুন-অর-রশীদ।
(Source- “মহান সাধক ফকির লালন শাহকে নিয়ে যত কথা”- ৯-১১-২০১৩ আর্কাইভ,”মহাত্মা লালন ফকির- কাঙাল হরিনাথ “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা”- ১৯-৯- ২০১৪, “লালন: সহজ মানুষের সাধক” – প্রথম আলো, বাউল ও সুফিবাদের আলোয় লালন-দর্শন- প্রদোষ কান্তি সরকার, roarmedia)
May be an image of 1 person