Site icon The Bangladesh Chronicle

জাফরউল্লাহ চৌধুরীঃ একজন দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি

 

শরীফ আস্-সাবের      28 May 2020

“We have tried to demystify medical care and decrease the control of the medical profession and instead promote the paramedic, the village-level health worker, as the backbone of health care.” – Dr. Zafarullah Chowdhury, the founder of Gonosasthya Kendro and promoter of people-centric health system

 

খবরে প্রকাশ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, ম্যাগাসেসে ও  স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন  চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী ভয়াল ব্যাধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।  তাঁর সঙ্গে কোনদিন আমার দেখা হয়নি। এমন কি, টেলিফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, চিঠিপত্র কিংবা অন্য কোন মাধ্যমেও তাঁর সঙ্গে কোন কালে যোগাযোগ হয়নি আমার। তবুও তিনি যেন আমার যুগ যুগান্তরের চেনা। তাঁকে আমি একজন কিংবদন্তীতুল্য দেশপ্রেমী বাঙালী হিসাবে চিনি যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন লন্ডনে পাকিস্তানী স্বৈরাচারের প্রতিবাদে পাকিস্তানী পাসপোর্ট জনসমক্ষে পুড়িয়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রহীন হয়েছিলেন এবং বিলাতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন না করে নিজের জীবন বাজী রেখে দেশের মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। যিনি স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে এখনো বাংলাদেশ গড়ার ব্রত নিয়ে নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন নির্বিকার, নিরলস।

তিনি কোন দল করেন কিনা, কিংবা কোন মতবাদে বিশ্বাস করেন কিনা তা আমার বিবেচ্য বিষয় নয় (আমার বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামান্যতম কৌতুহল বা আকর্ষণ নেই); আমি শুধু তাঁর কাজের বহর দেখি, সৃষ্টির উন্মাদনা দেখি আর মনে মনে আরেক জন কাজপাগল বাঙালী, শের এ বাংলা ফজলুল হক এর এক অমূল্য বাণী আওড়াই, “পুষ্প ঝরে যায়, সুরভী বেঁচে থাকে; মানুষ আসে, চলে যায় কিন্তু কীর্তি ও কৃতিত্বের স্মৃতি কোন দিনই মরে না”।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিলেত থেকে ফিরে ডাঃ জাফরুল্লাহ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ মাঠ হাসপাতাল স্থাপনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। তাঁর উদ্যম ও উৎসাহে হাসপাতালটিতে বাংলাদেশী চিকিৎসক এবং শিক্ষার্থীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় কোন  প্রাক-প্রশিক্ষণ নেই এমন স্বেচ্ছাসেবী মহিলাদের মাত্র কয়েক দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণশেষে চিকিৎসা সহকারী বা সেবিকা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে মাঠ হাসপাতালটি ঢাকায় পুনঃস্থাপিত হয় যা ১৯৭২ সালে সাভারে স্থানান্তরিত করে নামকরণ করা হয় ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। মাঠ হাসপাতালের এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি গ্রামের সাধারণ মহিলাদেরকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রশিক্ষনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে একটি কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি কম্যুনিটি ভিত্তিক মডেল তৈরি করেন যা বিশ্বখ্যাত ‘দ্য ল্যানসেট’ জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এ ছাড়াও তিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ঔষধ নীতিমালা তৈরিতে মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেন। এর ফলে ৪,৩৪০টি বাণিজ্যিক ওষুধের (যার অধিকাংশই ছিল অপ্রয়োজনীয় কিংবা বিপজ্জনক) পরিবর্তে মাত্র মাত্র ২২৬টি ওষুধের উৎপাদন ও সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই নতুন ঔষধ নীতি বাংলাদেশের ঔষুধ শিল্পে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুচনা করে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ৭৯ বছর বয়সী এই সাদা মনের মানুষটির কর্মোদ্যমে ভাটা পরেনি একটুও। ড. জাফরউল্লাহ  এবং তাঁর কেন্দ্র এখন দেশে করোনা নিয়ন্ত্রনে ভ্যাকসিন, ঔষধ এবং করোনা নির্ণয়ে র‍্যাপিড টেষ্ট কিট আবিস্কার চেষ্টার পুরোভাগে রয়েছে।

সব মিলিয়ে, ডাঃ জাফরউল্লাহ এক কীর্তিমান বাঙালী যাঁর মূল্যায়ন হওয়া উচিত তাঁর কর্মে ও কৃতিত্বে। তাঁর, দল, মত, ভাবাদর্শ জানার দরকার নেই আমাদের। তবে আমি নিশ্চিত জানি, তিনি একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযাদ্ধা, দেশপ্রেমিক। সেই সাথে তিনি একজন চিকিৎসক যিনি নিজের স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব না দিয়ে অপরের স্বাস্থ্য রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন; তিনি একজন বিজ্ঞানী যাঁর ধ্যান জ্ঞান জনগনের কল্যানে নিত্যনতুন আবিস্কা্র; তিনি একজন সমাজসেবক যাঁর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনসেবা এবং জনকল্যাণ; এবং তিনি একজন জনকন্ঠ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাঁর স্বভাব। তিনি আজীবন যুদ্ধরত এক বীর সেনানী, একজন ক্ষণজন্মা সংশপ্তক যাঁকে নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে!

 

আসুন আমরা সবাই কায়মনোবাক্যে এই মহান বাঙ্গালীর মঙ্গল, সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি  

——

ড. শরীফ আস্-সাবের মেলবোর্নের আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

 

Exit mobile version