পুলিশের গুলিবর্ষণে সেদিন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয় বগুড়া

P1_Lead_Final_2

কোনটা বেশি দামি— ১৩ জন ধর্মপ্রাণ মানুষের জীবন নাকি তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ? এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের বগুড়াবাসীর মুখে মুখে। আওয়ামী ও বামপন্থীদের কথিত এই মঞ্চ রক্ষা করতে গিয়েই বগুড়ার ইতিহাসে ঘটে সবচেয়ে মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ ৩ মার্চের গণহত্যা। ধর্মপ্রাণ মানুষের হামলা থেকে মঞ্চটি রক্ষা করতেই পুলিশ সেদিন নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ১৩ জন সাধারণ মানুষকে।
বগুড়ার গণহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
বরেণ্য আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে—৩ মার্চ রাতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর’, ‘সাঈদীর মুক্তি চাই—দিতে হবে, দিয়ে দাও’ স্লোগান দেয়। গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত বগুড়া জেলা শহর ও উপজেলাগুলোতে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করলেও অপ্রীতিকর তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ফজরের নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার দিকে যেতে থাকে। ওই স্থানে রয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। ওই মঞ্চের আশপাশে রাস্তার মুখে অবস্থান নেয় পুলিশ সদস্যরা। মিছিলকারীরা গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙতে পারে—এমন আশঙ্কায় পুলিশ সদস্যরা ভোর ৬টার দিকে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকে। তাতেই ঘটে এত বিপুল মানুষের প্রাণহানি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিবর্ষণে হতাহতের পরই অগ্নিগর্ভ রূপ নেয় বগুড়া। দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে গত ৩ মার্চ গভীর রাত থেকে হাজার হাজার মানুষ শহর ও উপজেলাগুলোতে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করেছিল। শহরে ঢুকে মিছিলকারীরা গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙতে পারে এমন আশঙ্কায় পুলিশ গুলি চালালে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। গুলিতে অনেক মানুষ মারা গেছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় নেমে আসে নারী, বৃদ্ধ, শিশুসহ বিভিন্ন স্তরের আরও কয়েক হাজার মানুষ।
গুলিতে সাতমাথা সংলগ্ন স্টেশন রোডে ফাপোর উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র খালিদুর রহমান টিটু গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। কাছাকাছি সময়ে ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড় ও দত্তবাড়ী মোড়ে মিছিলকারীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। এতে এয়াকুবিয়া মোড়ে দু’জন ও দত্তবাড়ীতে দু’জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ সময় অনেক লোক নিহত হয়েছে—এমন খবর বগুড়ার জেলা-উপজেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। পুলিশ সদস্যরা তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বগুড়ায় দাবানল জ্বলে ওঠে। শুরু হয় পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা।
একদিকে অসংখ্য মিছিল বিভিন্ন সড়ক দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। সকাল ৬টার পর থেকে ক্ষুব্ধ সাঈদীর সমর্থকরা নারুলী, স্টেডিয়াম, ফুলবাড়ী, সদর পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের শহরের কাটনারপাড়া বাড়ি, শহরের কলোনিস্থ এমপি আবদুল মান্নানের বাড়ি, এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিস, এটিএন ইলেকট্রনিক্সের দোকান, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস, শহরতলির গোদারপাড়াস্থ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। সদরের সাবগ্রামে রেললাইন উপড়ে ফেলে। একই সময়ে শাজাহানপুর উপজেলা, শিবগঞ্জের মোকামতলা, নন্দীগ্রাম উপজেলা, দুপচাঁচিয়া উপজেলা, গাবতলী উপজেলায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। অন্যান্য উপজেলাগুলোতে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে রাখে তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসব মিছিলে সাঈদীভক্ত অনেক আওয়ামী লীগের সমর্থকও যোগ দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের ফাঁড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়, আগুন ধরিয়ে দেয়। বগুড়া-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের বাড়ি ভাংচুর ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় এক শিবির কর্মীসহ ১৩ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। বগুড়ার ইতিহাসে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এ ঘটনার জন্য পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন এলাকাবাসী। এ ঘটনায় বগুড়া জেলাজুড়ে এখনও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলেন, সকালে পুলিশ সদস্য মোতায়েনের আগেই হাজার হাজার মানুষ সরকারি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে—এ আশঙ্কায় পুলিশ গুলি ছুড়ে তাদের পিছু হটিয়ে সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করেছে।
এদিকে এ ঘটনার পর থেকে বগুড়ায় গণগ্রেফতার শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশি হয়রানির ভয়ে বেশিরভাগ এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গণগ্রেফতারের আড়ালে পুলিশ রমরমা বাণিজ্য করছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ১৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা বগুড়ার ইতিহাসে এই প্রথম। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারে শোকের মাতম চলছে। নিহতদের বেশিরভাগই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। ধর্মপ্রাণ এসব মানুষ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবি জানাতেই রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
বগুড়া শহরের গাজী পালশা গ্রামের বাসিন্দা মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, গভীর রাত থেকে বগুড়াবাসী মিছিল করে। কোথাও কোনো গোলমাল হওয়ার কথা শুনিনি। স্টেশন রোডে পুলিশ গুলি করার পরই হামলার ঘটনা ঘটে। একই গ্রামের বাসিন্দা মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, আমরা মিছিলসহ চারমাথা থেকে তিনমাথা হয়ে সাতমাথার দিকে যাচ্ছিলাম। বিআরটিসি বাস ডিপোর কাছে পৌঁছামাত্র পুলিশকে গুলি করতে দেখে পালিয়ে যাই। এরপরই শহরে ভাংচুর চলছে বলে জানতে পারি।
তবে দায়িত্বরত পুলিশের কয়েকজন জানান, সাধারণত সকাল ৬টায় পুলিশের শিফট পরিবর্তন করা হয়। ওইদিন হরতাল থাকায় সকাল সাড়ে ৫টা থেকে পুুলিশ সদস্যদের মোতায়েনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু শহরজুড়ে মানুষের ঢল নামতে শুরু হওয়ায় কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হলেও অতিরিক্ত ফোর্স পাঠিয়ে কোনো সহযোগিতা করেনি। এতে ভীত হয়ে তারা সাধারণ মানুষকে গুলি করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালান। এর অনেক পরে বিজিবি ও র্যাব সদস্য শহরে মোতায়েন করা হয়।
বগুড়ার জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ওইদিন পুলিশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে জান ও মালের এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। গণগ্রেফতারের বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে বলেছি, অযথা হয়রানি করলে এর পরিণাম ভালো হবে না। জামায়াতে ইসলামীর বগুড়া জেলা আমির অধ্যক্ষ শাহবুদ্দীন বলেন, জামায়াত বা শিবিরের নেতৃত্বে ওই দিন কোনো মিছিল বের হয়নি। কেউ সরকারি স্থাপনায় ভাংচুর চালায়নি। পুলিশ কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে পাখির মতো হত্যা করেছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে সাধারণ মানুষ।
তবে পুলিশ ঠাণ্ডামাথায় পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, রাতেই কয়েক স্থানে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে। সকালে হামলার মাত্রা বেড়েছে। বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ সদস্যরা পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছিল। আমরা কৌশলে তাদের রক্ষা করেছি। নির্বিচারে গুলি করলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়তো। তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি চালানো হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সায়েম বলেন, কী কারণে সহিংসতা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল তা পর্যালোচনা করা হয়নি। তবে পুলিশের গুলির পর সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে—এমন তথ্য সঠিক নয়। রাত সাড়ে ৩টা থেকে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছে। পুরো শহরে লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটি স্থানে হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, সকাল ৬টায় নতুন শিফট শুরুর আগেই হামলা শুরু হয়। স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম। সেভাবে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেছে।

Source: AmarDesh