সাগরের মহিসোপান দাবিতে দিল্লির আপত্তি

Daily Nayadiganta


বঙ্গোপসাগরের মহিসোপানে (কন্টিনেন্টাল শেলফ) বাংলাদেশের দাবির ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে ভারত। এ ছাড়া মিয়ানমারও বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। দুই প্রতিবেশী দেশের আপত্তি ও পর্যবেক্ষণের নিষ্পত্তির পরই ইস্যুটি সুরাহা করতে পারে কমিশন অন দ্য লিমিটস অব দ্য কন্টিনেন্টাল সেলফ (সিএলসিএস)। কিন্তু দাবি, পাল্টা দাবি, আপত্তি ও পর্যবেক্ষণের কারণে এটি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত শুক্রবার জাতিসঙ্ঘের সিএলসিএস ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ভারতের আপত্তিপত্রে বলা হয়েছে, ভূখণ্ডের যে বেসলাইনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মহিসোপান নির্ধারণ করেছে, সেটির মাধ্যমে ভারতের মহিসোপানের একটি অংশ দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে ‘গ্রে এরিয়া’র বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো তথ্য দেয়নি।

অর্থাৎ সিএলসিএসে বাংলাদেশের দাবির বিরোধিতা করেছে ভারত। তারা বাংলাদেশের দাবি বিবেচনায় না নেয়ার জন্য কমিশনকে অনুরোধ করেছে। এর আগে গত জানুয়ারিতে মহিসোপানে বাংলাদেশের দাবির ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু ভারতের মতো বাংলাদেশের দাবির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেনি দেশটি। বাংলাদেশ আইনগতভাবে মহিসোপানের যতটুকু অংশ প্রাপ্য মনে করে, সেটি থেকে নিজেদের অংশ দাবি করছে উভয় প্রতিবেশী।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে আলোচনার পরও মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সালিসি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা করেছিল। আর ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মামলা করেছিল স্থায়ী সালিসি আদালতে। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ ইটলস বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। ইটলসের রায়ে বাংলাদেশ ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিরোধমুক্ত সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিরোধমুক্ত সমুদ্রাঞ্চল রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার।

২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে। ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চল ছিল ২৫ হাজার ৬০২ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পর এ রায়ের ফলে বঙ্গোসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার আঞ্চলিক সমুদ্র (টেরিটোরিয়াল সি), ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানের (কন্টিনেন্টাল শেলফ) তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর টানা রেখায় দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের অংশে পড়েছে। অবশ্য দ্বীপটির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তালপট্টির সৃষ্টি হলেও ১৫ বছর পর আরেক ঝড়ে তা পানিতে তলিয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ করার সময় রেডক্লিফের আঁকা ম্যাপ অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরের তালপট্টির অংশটি ছিল ভারতের। অন্য কোনো ম্যাপ দিয়েই একসময়ের দ্বীপটির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বাংলাদেশ।

আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ৫০ বর্গ কিলোমিটারের একটি ‘গ্রে এরিয়া’ রয়েছে, যার মৎস্য সম্পদে ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদে বাংলাদেশের অধিকার থাকবে।

ভারত যে বেইস লাইনের ওপর ভিত্তি করে তাদের মহিসোপান দাবি করছিল, সেটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আপত্তি জানিয়েছিল, যা এখনো বলবৎ রয়েছে। ২০১০ সালে এপ্রিলে শুনানির পর ভারতের দাবি পর্যালোচনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সিএলসিএস। এই দাবি পর্যালোচনার জন্য নিয়মানুযায়ী সাব-কমিটি গঠন থেকে বিরত রয়েছে কমিশন। ২০১১ সালে মহিসোপানের দাবি জানিয়ে সিএলসিএসে আবেদন করে বাংলাদেশ। গত বছর অক্টোবরে এতে সংশোধনী আনা হয়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমারের পর্যবেক্ষণের জবাব আমরা শিগগিরই সিএলসিএসে জমা দেবো। ভারত কেবলই তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। আমরা এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জবাব প্রস্তুত করব।

সমুদ্র আইন বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের সনদ (আনক্লস) অনুযায়ী, সিএলসিএস কোনো দেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানের আউটার লিমিটসের দাবি নিষ্পত্তি করবে। কিন্তু তার আগে উপকূল রেখা বা বেইস লাইন থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটরিয়াল সি বা আঞ্চলিক সমুদ্র এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) বা একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমারেখা নির্ধারণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। শেষোক্ত দু’টি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের রায়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে।

কোনো দেশ তার আঞ্চলিক সমুদ্রে মূল ভূখণ্ডের মতোই সার্বভৌমত্বের অধিকার রাখে। ইইজেডের সমুদ্র সম্পদ ও আকাশসীমার একান্ত অধিকার থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের। আর কন্টিনেন্টাল শেলফ বা মহিসোপানের সম্পদের ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের অধিকার থাকলেও চলাচলের জন্য এ সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করতে কোনো জাহাজের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই।