Site icon The Bangladesh Chronicle

‘পা মোড়াইয়ে ভাইঙ্গে পুলিশ গুলি করে, আমি এখন পঙ্গু’

‘পা মোড়াইয়ে ভাইঙ্গে পুলিশ গুলি করে, আমি এখন পঙ্গু’

কমল জোহা খান, ঢাকা
২৪ নভেম্বর ২০১৮ Prothom Alo

পুলিশের গুলিতে পা হারানো ফারুক হোসেন ও আশরাফুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলোস্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বুক থেকে পা পর্যন্ত লাল রঙের পাতলা কম্বলে ঢাকা। এই রোগীর নাম ফারুক হোসেন (৪০)। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরপাড়া ইউনিয়নের মাটিকুমরা গ্রামের মেম্বার তিনি। কিন্তু অচেনা কোনো মানুষ স্ট্রেচারের সামনের এলেই দুচোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকেন। ছল ছল চোখে ফারুক বলেন, ‘আমার বাম পায়ের অর্ধেক নেই। পা মোড়াইয়ে আগে ভাঙসে। পরে পুলিশ গুলি করছে। এখন পায়ের যে টুকু আছে, সেখানে এখনো ব্যথা করে। ’

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) আজ শনিবার দুপুরে এভাবেই পা হারানোর কথা বলছিলেন ফারুক হোসেন। ফারুকের মতো তাঁর ভাইপো আশরাফুল ইসলাম (৩৫) বাম পা হারিয়েছেন গুলির আঘাতে। মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ৮ নভেম্বর রাতে নিজের গ্রাম মাটিকুমরায়।

ফারুক ও আশরাফুলের দাবি, পুলিশ পিটিয়ে তাঁদের দুজনেরই পা ভেঙে দিয়ে গুলি করেছে। কয়েক দিন যশোর সদর হাসপাতালে পুলিশের পাহারায় চিকিৎসা করানো হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ১২ নভেম্বর দুজনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার করে ফারুক হোসেন ও আশরাফুল ইসলামের বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। ঢাকায় আনার পরও পুলিশের পাহারায় দুজনের চিকিৎসা চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাটিকুমরা গ্রামের কয়েকজন জানান, জহুরুল নামে এক যুবক তাঁদের গ্রামে কয়েক বছর ধরে মাদকের ব্যবসা করছেন। তাঁকে এ ব্যবসায় সহায়তায় করেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন সদস্য। লোকজনের কাছে মাদক বিক্রি করে তাঁদের ডিবি পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতেন জহুরুল। বিনিময়ে কমিশন পেতেন। সম্প্রতি মাটিকুমরা গ্রামে আয়নাল মিস্ত্রি নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে জহুরুলও জড়িত ছিলেন। এর পর গ্রামবাসী রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেন। ৮ নভেম্বর রাতে ডিবি পরিচয় দিয়ে কয়েকজন একটি প্রাইভেট কার নিয়ে মাটিকুমরা গ্রামে আসেন। গাড়িতে জহুরুলও ছিলেন। রাত নয়টার দিকে গ্রামবাসী খবর পেয়ে তাঁদের ঘিরে ফেলেন। গাড়িতে থাকা ডিবি পুলিশ হিসেবে নিজেদের দাবি করলেও কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি ওই ব্যক্তিরা। এ সময় গ্রামবাসী তল্লাশি চালিয়ে প্রাইভেট কার থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেন। এ সময় ডাকাত সন্দেহে প্রাইভেট কারে থাকা চার ব্যক্তিকে পিটুনি দেওয়া হয়। তবে জহুরুল পালিয়ে যান। খবর পেয়ে স্থানীয় ফাঁড়ি ও থানা-পুলিশ তাদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। এরপর রাত ১১টার দিকে দুই শতাধিক পুলিশ মাটিকুমরা গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলেও গ্রামবাসীর দাবি। সেখান থেকে ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন, আশরাফুল ইসলামসহ ৪৬ জনকে আটক করা হয়। তাঁদের মধ্যে ফারুক হোসেন ও আশরাফুলকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পা ভেঙে গুলি করে পুলিশ।

ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে কথা বলার সময়ও সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের সদস্যরা এই প্রতিবেদককে বারবার চলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। তবে ড্রেসিং রুমে নেওয়ার সময় ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। ইউপি মেম্বার পরিচয় দেওয়ার পরও গাড়িতে আমাকে তোলা হয়। প্রথমে চাঁচড়া মোড়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আশরাফুল ও আমার চোখ–মুখ কালো কাপড়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর কোথায় নেওয়া হয় বুঝতে পারিনি।’
অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হয় জানিয়ে ফারুক হোসেন বলেন, ‘চার-পাঁচজন মিলে আমাদের দুজনকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে বাম পায়ের দুই পাশে রড দেওয়া হয়। এরপর পায়ে ওপর দাঁড়িয়ে হাঁটুর নিচ থেকে পা ভেঙে দেয়। পা মোড়ানোর পর গুলি করা হয়। জ্ঞান হারানোর পর আমার কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে আমাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে।’

তবে পুলিশের দাবি, পালানোর সময় ফারুক ও আশরাফুল আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। পুলিশের আহত সদস্যরা হলেন ডিবির কনস্টেবল মুরাদ হোসেন, শিমুল হোসেন ও মামুন আলী এবং প্রাইভেট কারের চালক শাওন। তাঁদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঝিকরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মাদক উদ্ধার অভিযানে ডিবি পুলিশের দল মাটিকুমরা গ্রামে গিয়েছিল। গ্রামবাসীর কাছে পরিচয়পত্র দেখানোর পরও ডিবি সদস্যদের মারধর করা হয়। পরে জেলা পুলিশ ওই গ্রামে অভিযান চালায়। এ সময় ফারুক ও আশরাফুল একটি ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পালাতে গেলে পা ভেঙে আহত হন। পরে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান পুলিশি পাহারায় ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ৪০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
ফারুক হোসেন ও আশরাফুলের পা কেটে ফেলার বিষয়টি জানানো হলে ওসি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এটি আমার জানা নেই।’

Exit mobile version