দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া ‘রাজনীতির অর্থনীতি’

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া ‘রাজনীতির অর্থনীতি’

ডিম আগে নাকি মুরগি আগে- এ রকমই আরেকটি বিতর্ক : ‘রাজনীতি কি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি অর্থনীতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে?’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বা ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বলে একটি তত্ত্ব আছে। ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপর দিকে মার্কসবাদীরা অর্থনীতিকেই রাষ্ট্রের মৌলিক নিয়ামক মনে করেন। ‘ইকোনমিক ডিটারমিনিজম’ বা অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ দ্বারা প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদগণ মার্কসিও ধারা অনুযায়ী উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করেন। গতানুগতিক সূত্রে অর্থনীতিকে সরকারের শিল্পকলা বলে অভিহিত করা হয়। অন্য অর্থে একে বলা হয় ‘রাজনীতির অর্থনৈতিক অংশ’। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভূমিকা এতটাই জোরদার হয়েছে যে, পণ্ডিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে স্রেফ ‘অর্থনীতি’ বলে নাম দিতে চান। সব সময়ই রাষ্ট্রব্যবস্থায় অর্থনীতি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ থেকেছে। অনেকেই বলে থাকেন, এটা হচ্ছে ‘গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনার মতো সরল ও স্বাভাবিক বিষয়’। অ্যারিস্টটল তার প্রধান গ্রন্থ ‘দ্য পলিটিকস’-এ রাষ্ট্রের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে অর্থনীতির প্রাধান্য দিয়েছেন। এডাম স্মিথ তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘দি ওয়েলথ অব নেশনস’ (১৭৭৬)-এ পলিটিক্যাল ইকোনমিকে বলেছেন ‘এ ব্রাঞ্চ অব দ্য সাইন্স অব এ স্টেটসম্যান অর লেজিসলেচার’। তার বিবেচনায় এই তত্ত্ব দ্বারা দুটো কাজই করা হয়- জনগণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের জোগান দেয়া ও রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমষ্টিকে সেই অর্থ দ্বারা সমৃদ্ধ করা। প্রথমটি অর্থনীতি এবং দ্বিতীয়টি রাজনীতি। অর্থনীতির বোদ্ধা পুরুষগণ অর্থনৈতিক অবস্থান দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে অধ্যয়ন করতে চান।

এ মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক দল প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনীতি, অর্থনীতি পরিচালনা করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার সুবাদে এ দলটি ক্ষমতা গ্রহণ করে। একটি রাজনৈতিক দল তার সুনির্দিষ্ট আদর্শ-লক্ষ্য ও কর্মসূচি দ্বারা পরিচালিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলির ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তারা আবার ক্ষমতায় আসে। এত দিনে তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের লোকজনের স্বভাব-চরিত্র ও বিষয়-বৈশিষ্ট্যও অপরিবর্তনীয় রয়েছে। মার্কস একে বলেছেন, ‘ক্লাস ক্যারেক্টার’। ১৯৭২ সালে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জগাখিচুড়ির অর্থনীতি গ্রহণ করলেও মূলত সেটি ছিল লুটপাটের রাজত্ব। এই সময়ে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত শিল্পকারখানা ও বাড়িগাড়ি তারা দখল করে নেয়। অর্থনীতির অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, দু’জন বিশ^বিশ্রুত অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তীব্র হতাশা ব্যক্ত করেন। এমনিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, তার ওপর তাদের একচেটিয়া ব্যবসায়, সর্বাত্মক কর্তৃত্ব এবং দুর্নীতি দেশকে শোচনীয় অবস্থার দিকে নিয়ে যায়। সব লাইসেন্স পারমিট প্রকৃত ব্যবসায়ীদের না দিয়ে দলীয় লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ সময়ে একটি টার্ম সংবাদপত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আর সেটি হচ্ছে ‘ব্রিফকেস বিজনেসম্যান’। আমদানি-রফতানি চলে যায় কিছু চিহ্নিত ‘ম্যান ছেরু মিয়া’দের হাতে। সে এক বিরাট কাহিনী। আজকের রাজনীতি ও অর্থনীতি দেখে যে কেউ সেই অতীতের সাথে এর অপূর্ব মিল খুঁজে পাবে। সে সময়ের একটি সত্যি ঘটনার তথ্য থেকে সমগ্র এর উদাহরণ পাওয়া যাবে।

সে সময়ে আমি ঢাকার চকবাজারের পশ্চিম দিকে থাকি। চকবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ‘ক’ (নাম উল্লেখ শোভন নয়)। তিনি চকবাজারের দোকানদার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এদিক-ওদিক লুকিয়ে কাটিয়েছেন। ভারতে যাননি। মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেননি। বিজয়ের পর ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ বা ষোড়শ বাহিনীর সদস্য হয়ে ব্যাপক লুটপাট চালান। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘কিছু নেই আমার। ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব কিছুই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে খান সেনারা।’ বঙ্গবন্ধুর সতত দয়ার্দ্র মনকে প্রভাবিত করে তিনি পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ‘কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি’ (আজো একই নামে বর্তমান)-এর সারা দেশে বিক্রয়ের ‘সোল এজেন্সি’ নিয়ে নেন। তিনি সব মাল স্টক করে ফেলেন। ফলে ১৫ দিনের মাথায় ছয়আনার তিব্বত টুথপেস্ট ছয় টাকায় বিক্রয় হয়। সেকালের ঘটনাবলির একটি প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে এটিকে গ্রহণ করা যায়। আমি একদিন পথ অতিক্রমকালে লক্ষ করি, এক বস্তা লবণ নিয়ে মানুষ কাড়াকাড়ি করছে। চারআনা লবণ সের ১০-১২ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছিল। ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয় তার অন্যতম কারণ ছিল মজুদদারি। সে সময়ের পাতি বুর্জোয়া স্থানীয় আওয়ামী নেতারা চাল ব্যবসায় ও মিলের মালিক ছিল। যুদ্ধের কারণে খাদ্য উৎপাদন অবশ্যই ব্যাহত হয়েছিল। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের সম্যক ধারণা না থাকা এবং খাদ্য আমদানিতে অনেক বিলম্ব হওয়ায় দুর্ভিক্ষ ত্বরান্বিত হয়েছিল। তা ছাড়া কিউবায় চিনি রফতানি করার কারণে মার্কিন খাদ্য সাহায্য ব্যাহত হয়।

আজকে অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিটি জিনিসপত্র এবং সেবা ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। পেঁয়াজের দাম নিয়ে সরকার যে অদক্ষতা, ব্যর্থতা ও দুর্নীতির প্রমাণ রেখেছে, তাতে শুধু এই একটি কারণে তাদের পদত্যাগ করা উচিত। উড়িয়ে আনার পরও তারা পেঁয়াজের লাগাম ধরতে পারেনি। তাদের দুই মন্ত্রী আশ্বাসের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। যখন পেঁয়াজের দাম ২৫০ ছাড়িয়েছে তখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘সব ঠিক হ্যায়।’ তাদের কথায় পেঁয়াজের দাম আরো বেড়েছে। কোনো সভ্য দেশে এ ঘটনা ঘটলে মন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতে হতো না, বরং তারা নিজ দায়িত্বেই পদত্যাগ করত। ইতোমধ্যে লবণ বা নিমক নিয়ে যে নিমকহারামি হলো তার তুলনা নেই। ১৯৭২ সালে আমি যে লবণ কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করেছি, তার সাথে এটির একটি সামঞ্জস্য রয়েছে। কিভাবে দাম বাড়াতে হয় তার শিল্পকলা ব্যবসায়ীদের জানা আছে। ’৭২ সালেও লবণের এত দাম হওয়ার কথা নয়। সেখানেও আমি বিশ্বাস করি গুজব রটেছে। যেমন রটেছে লবণের ক্ষেত্রে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সাধারণ পাবলিকরা এই গুজব রটিয়েছে। এই গুজব রটিয়েছে তারাই, যারা এক লাফে তালগাছ হতে চায়। তারা অবশ্যই পেঁয়াজ অথবা লবণ ব্যবসায়ীদের এজেন্ট। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা অতি সাধারণ মানুষ। সবাই বোঝে, এটি অসাধারণ মানুষের কাজ। পুলিশ কি এতই অক্ষম, তাদের খুঁজে বের করতে সক্ষম নয়? হয়তো বা তারা পারে। তদন্তে হয়তো কিছু নাম পাওয়া যাবে। কিন্তু তা প্রকাশ করা যাবে না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, শেয়ারবাজারে মহাবিপর্যয়ের পর যে তদন্ত হয়েছিল। তাতে কিছু নাম বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দে আর ভেরি ইমপর্টেন্ট পারসনস’। দেশের মানুষও জানে তারা কারা। কিন্তু প্রকাশ করার সাহস নেই। সেই ভীতির রাজত্বে পেঁয়াজ কেলেঙ্কারি বা লবণ কেলেঙ্কারির নায়ক-নায়িকাদের আমরা কখনো খুঁজে পাবো না।

ইতোমধ্যে চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৫-১০ টাকা। অথচ বলা হচ্ছে দেশে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, যদি সত্যিই দেশে চালের সঙ্কট থেকে থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ধানের দাম বাড়বে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের দামের নিয়ন্ত্রক এখন ৫০টি চালকল। যদি এর মালিকানার খোঁজখবর নেয়া হয় তাহলে শাসকদলের পরিচিত মুখগুলোই বেরিয়ে আসবে। যথার্থভাবেই আটার দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে দুই টাকা। ময়দার দাম কেজিতে আট টাকা বেড়েছে। সবজির দাম চড়া। বেশির ভাগ সবজির কেজি ৬০-৮০ টাকা। ডিমের ডজনপ্রতি দাম ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০৫ টাকা হয়েছে। এ দিকে অনুমোদনের আগেই ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। ট্যারিফ কমিশনের অনুমোদনের আগেই এই তেলের দাম দুই দফায় লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়েছে। ভোগ্যপণ্য সমিতির সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থনীতির সঙ্কটে পড়েছে। তিনি যদিও এ জন্য শুধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন। কিন্তু অন্যান্য অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু ব্যবসায়ীরা দায়ী নয়। যে সিন্ডিকেটের কথা বারবার সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে, তারা কি গায়েবি জিনিস- ধরাছোঁয়ার বাইরে? এত বছর ধরে অহরহ সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে, অথচ একজন সিন্ডিকেটের টিকিটিও আমরা স্পর্শ করতে পারলাম না। বাংলাদেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন কেন্দ্রের মহাপরিচালক ড. খান আহমেদ সাইদ মোরশেদও স্বীকার করেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দায় বিশেষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর বর্তাবে। বিশ্বব্যাংকের একটি হিসাবে বলা হয়, মূল্য বৃদ্ধির ফলে গরিষ্ঠ মানুষের উপার্জনের ৫০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে খাদ্যশস্য কিনতে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার স্বীকার করেছেন, ভালো চালের দাম বেড়েছে। অথচ সরবরাহ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, কারা কৃত্রিমভাবে মূল্য বৃদ্ধি ঘটাল? তারা কি সেসব লোক নয়, যারা ১৯৭২ সালে কৃত্রিমভাবে চালের দাম বাড়িয়েছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে এবং আগের মতো বেপরোয়াভাবেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

সাধারণভাবে বাজার অর্থনীতির নিয়মে চাহিদা ও সরবরাহের প্রেক্ষাপটে দাম নির্ধারিত হয়। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাহিদা যদি একই থাকে আর সরবরাহ কমে যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আগের দামে পণ্য বিকোবে না। মূল্য বৃদ্ধি হয় ঘাটতির কারণে। ঘাটতির সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী বা অভিন্ন সিন্ডিকেট যেমন খুশি তেমন দাম বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব সময়ই একটি ভূমিকা রয়েছে। যেসব কারণে দ্রব্যমূল্যের ঘোড়াটির মুখে আমরা লাগাম পরাতে পারছি না, তার কারণ যতটা না বেসরকারি তার চেয়ে সরকারি। প্রথমত, মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত যে পেঁয়াজ সরবরাহ বন্ধ করবে তার খবর আমাদের মন্ত্রণালয়ে রাখতে পারেনি। উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে যদি মাত্র দুই লাখ টন পেঁয়াজ ঘাটতি হয়ে থাকে তাহলে এই আকাশছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে না। এতে বোঝা যায়, আমাদের পরিসংখ্যান হিসাব-নিকাশে বিভ্রান্তি রয়েছে। বিআইডিএসের একটি সেমিনারে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই তথ্যবিভ্রান্তির কথা স্বীকার করেন। নীতি ও তথ্যের বিভ্রান্তি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যকে লাগামহীনতা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা অপ্রতুল ও অকার্যকর। তৃতীয়ত, বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও চাপ প্রয়োগের জন্য যে ভোগ্যপণ্য সমিতিগুলো রয়েছে তা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। নামকাওয়াস্তে সরকারি তত্ত্বাবধানে যে সংস্থাটি রয়েছে তা কার্যকর নয়। সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে এ ধরনের অসংখ্য ভোক্তা সংস্থা সাধারণ স্বার্থকে রক্ষা করতে পারে। চতুর্থত, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বড় একটি কারণ পরিবহন তথা পথে পথে চাঁদাবাজি। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি ট্রাককে কিভাবে পদে পদে চাঁদা দিতে হয়, নাজেহাল হতে হয় তার উদাহরণ দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারি দলের তত্ত্বাবধানে তথা নিয়ন্ত্রণে এসব চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। পুলিশের কথা না হয় নাই বললাম। পঞ্চমত, ভোগ্যপণ্য দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা আইনের কার্যকারিতা মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। ব্যবসায়ীরা কত দিন কতটা পণ্য ধরে রাখতে পারবে তা নিশ্চিত করতে হবে। ষষ্ঠত, আবুল মাল আবদুল মুহিতের পরামর্শ মোতাবেক দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ঠিক রাখতে গভীরভাবে ভারতের অর্থনীতিকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পেঁয়াজের বিষয়টি মনে রাখলে মুহিতের কথার সত্যতা মিলবে। সপ্তমত, আমাদের খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। অষ্টমত, কৃষক এবং মূল বাণিজ্য কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দালালগোষ্ঠী নির্মূল করলে কৃষক যেমন প্রকৃত দাম পাবে তেমনি মূল্যহ্রাস ঘটবে। নবমত, চাল বা অন্য ক্ষেত্রে বড় বড় মিল বা কোম্পানি যাতে এককভাবে বা প্রাধান্যশীলভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। দশমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতিগত সিদ্ধান্ত। অন্য ভাষায় আমরা একে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ বলতে পারি। একটি সরকার যদি জনবান্ধব হয়, সত্যিকার অর্থেই যদি তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাহলে তার হাতে রয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা, ব্যবস্থা এবং প্রক্রিয়া। সরকারের চরিত্র যদি পুঁজিবাদী, গোষ্ঠীতান্ত্রিক এবং লুণ্ঠন প্রকৃতির হয় তাহলে সে সরকার দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

আবার সেই পুরনো বিতর্কে আসি, রাজনীতি অর্থনীতিকে নাকি অর্থনীতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে? উপর্যুক্ত পর্যালোচনা প্রমাণ করছে যে, বাংলাদেশে এই সময়ে রাজনীতি আর অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। তোফায়েল আহমেদ ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন, ‘রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমীক্ষকরা কয়েক বছর ধরে প্রমাণ করছেন, কিভাবে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমেই বাণিজ্যবাদের কবলে পড়েছে। দেশের রাজনীতিতে শুধু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই ঘটেনি; বরং রাজনীতির বাণিজ্যকরণ ঘটেছে। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যবিমোচনে সাফল্য এলেও আর্থিক খাতে বিপর্যয় ঘটেছে। ‘আর্থিক খাত এখন হুইল চেয়ারে’। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। ব্যাংকিং খাত এক রকম ফোকলা হয়ে পড়েছে। এর মর্মার্থ হলো এই যে, কাক্সিক্ষত ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ কায়েম না হয়ে ‘অর্থনীতির রাজনীতি’ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর এ ধরনের অবস্থায় জনসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষিত না হয়ে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলতন্ত্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com