Site icon The Bangladesh Chronicle

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাতকাহন


কারাবন্দী অবস্থায় একজন লেখকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশের রাজপথ যতটা না উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে তার চেয়েও বহু গুণ উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে মানুষের দেহ মন এবং মস্তিষ্ক। যিনি মারা গেছেন তার কারাবরণের কারণ সম্পর্কে দেশবাসী তেমন জানে না। তিনি কী লিখেছিলেন এবং তার সেই লেখনীর ফলে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটির কী এমন ভয়ানক ক্ষতি হয়েছিল যার কারণে তাকে প্রায় আট মাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল, এ কথাও জনগণ জানে না বা বুঝে না। রাষ্ট্রের পরিচালকরূপে যারা ক্ষমতা ভোগ করছেন তারাইবা কিভাবে একজন লেখকের লেখা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা হতে পারেন সেই বোধবুদ্ধি সচেতনতা কিংবা আগ্রহ এ দেশের লোকজন এখনো অর্জন করতে পারেনি। জনগণ যা খুব সহজেই বুঝে যায় তা হলো- ক্ষমতার দাপট কত ভয়ঙ্কর। দাপুটে লোকজন যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন এবং তারা তা করেনও বটে।

লেখক মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে যেসব কথাবার্তা বাজারে চলছে তা কিছুতেই জানতে পারছেন না ক্ষমতাবানরা। বাজারের কথা হলো- বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো কোনো লেখক বন্দী অবস্থায় মারা গেলেন। লোকজন আরো বলছেন যে, তার ‘স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি’। হয়তো বন্দী অবস্থাতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, যে দেশে খুনি-চোর-ডাকাত-লুটেরা ও ধর্ষকরা জামিন পেয়ে যায় সেই দেশে একজন নিরীহ লেখক কী কারণে আট মাসে ছয়বার জামিন প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হলেন এবং উচ্চতর আদালত থেকে কেনো প্রতিকার পেলেন না, তার কোনো কার্যকারণ মেলাতে পারছেন না। ক্ষমতার শীর্ষপর্যায় থেকে বলে দেয়া হয়েছে যে, এটাই কারাগারে প্রথম মৃত্যু নয়। এর আগে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের মধ্যে হত্যা করা হয়েছিল। কই, তখনতো কেউ হইচই করে বাজার গরম করেনি। এখনো কেন সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওভাবে আলোচনা করা হয় না?

মুশতাক সম্পর্কে যারা জানেন তাদের বক্তব্য হলো- তিনি স্বভাবজাত লেখক। দুনিয়ার ধান্ধাবাজি তার মাথায় ঢুকত না। সমাজের পাপ-পঙ্কিলতা, রাজনীতির দূষণ এবং ক্ষমতালোভী ব্যক্তিদের ফন্দিফিকির এবং নির্মমতা সম্পর্কে তিনি বেপরোয়া ছিলেন। তিনি সাদা চোখে যা দেখতেন তাই বিশ্বাস করতেন এবং অকপটে লিখতেন। আমাদের সমাজ হয়তো তার সেসব লেখালেখি সম্পর্কে জানত না। কিন্তু অন্ধকারের কুটুম্ব সবাই ঠিকই সবকিছু জানতেন এবং তাদের সেই জানা বুঝা দায় সেটিতেই তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হয়েছে।

মুশতাকের মৃত্যুর পর আরো অনেক মানুষের মতো আমিও ভাবাবেগ দ্বারা তাড়িত হয়েছি। বুঝার চেষ্টা করেছি কেনো এবং কিভাবে তিনি এতটা সাহসী হয়ে উঠেছিলেন যার কারণে রাষ্ট্র তাকে বিপজ্জনক মনে করেছিল। অথবা তিনি কেন এমন সব বিষয় লিখতেন যেসবের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে বেখেয়াল থাকতেন। আমার মনে হয় তার বোহেমিয়ান জীবন, কুমির সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে মাসের পর মাস সুন্দরবনের গহিনে অবস্থান করে বন্য জীবনের সরলতা সততা, বনের বৃক্ষলতা-পশুপাখি এবং বনভূমিকেন্দ্রিক নদ-নদী, খালের কুমিরসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন সংগ্রাম, নৈতিকতা, আইন মেনে চলা এবং সঠিক পথে চলার অভ্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি জনারণ্যের ভ্রান্তিগুলো বরদাশত করতে পারেননি। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে লেখক মুশতাকের অনেক ছবি ভাইরাল হয়ে পড়েছে। এসব ছবির মধ্যে একটি ছবি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মুশতাক এবং তার স্ত্রী পাশাপাশি বড় বড় দুটো কুমিরের পিঠে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে বসে রয়েছেন। কুমির দু’টির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তারা লেখক মুশতাক এবং তার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। ফলে তাদের ভালোবাসার মানব-মানবীকে পিঠে সওয়ারী হিসেবে পেয়ে ভয়ঙ্কর কুমিরগুলো নিজেদের সম্মানিত ভেবে একধরনের তৃপ্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল অভিব্যক্তিতে। ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে- মুশতাক সারা দুনিয়ার ভয়ঙ্কর সব কুমিরের ভাষা বুঝতেন এবং এই হিংস্র প্রাণীটির সাথে মানুষ কী করে বন্ধুত্ব করতে পারে সেই কৌশলও জানতেন।

কুমিরের সাথে মুশতাক দম্পতির ছবি দেখে আমার আরো মনে হয়েছে যে, তিনি কুমির সম্পর্কে অভিজ্ঞ হলেও কুমির স্বভাবের মানুষ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন। অর্থাৎ একটি জানোয়ারের দেহে যখন কুমিরের প্রাণ থাকে তখন সেই প্রাণীর আচরণ বৈশিষ্ট্য এবং প্রজনন সম্পর্কে তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু মানবের দেহের মধ্যে কুমিরের প্রাণ প্রবিষ্ট হওয়ার পর জনারণ্যের মধ্যে মিশে থাকা সেই প্রাণীগুলো যে কতটা ভয়ঙ্কর তা হয়তো তিনি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারেননি; যেমনটি আমরা বুঝতে পারিনি তার জীবৎকালে। অর্থাৎ তিনি যত দিন কারাবন্দী ছিলেন তত দিন আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি ও জবান যেভাবে বন্ধ করে রেখেছিলাম তাতে আমাদের কারোই হয়তো মনে হয়নি যে, দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের একটি কালো আইন রয়েছে এবং সেই আইনের অধীনে মুশতাকের মতো নিরীহ লোকেরা মাসের পর মাস বিনা বিচারে কারা অভ্যন্তরে পচে-গলে কবরের দিকে যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন।

লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জোরদার হচ্ছে। সরকার প্রথম দিকে আইনটির ব্যাপারে অনড় থাকলেও তাদের কণ্ঠের তেজ কিছুটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা এখন বলার চেষ্টা করছেন যে, আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল বা সংশোধন হতে পারে। অন্য দিকে যারা এই আইনটির বিপক্ষে তারা পুরো আইনটির বাতিল দাবি করছেন। একই সাথে তাদের দাবির তালিকাও বাড়ছে। তারা মুশতাকের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছেন এবং কেন সংশ্লিষ্ট আদালত পরপর ছয়বার তার জামিন আবেদন খারিজ করেছিলেন সে ব্যাপারে তদন্তের জন্য উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচক বা বিশেষজ্ঞরা যা বলেন তার চেয়েও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যারা এই কালো আইনটির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ যেমন সরাসরি সাইবার কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারেন তদ্রূপ তারা স্থানীয় থানাতেও মামলা দায়ের করতে পারেন। ফলে কারো যদি পুলিশ কানেকশন ভালো থাকে তবে এই আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোর সাহায্যে সে তার প্রতিপক্ষের ভিটেমাটিকে ঊষর মরুভূমি বানিয়ে সেখানে মরুভূমির ক্যাকটাসের বাগান বানিয়ে ফেলতে পারে। অন্য দিকে সারা দেশের জন্য একটি মাত্র আদালত, নিম্ন আদালতের পরিবেশ, বিচারক-আইনজীবীদের দক্ষতা অভিজ্ঞতা এবং মন-মানসিকতার কারণে বিচার প্রার্থীরা যে কতটা দুর্ভোগ দুর্দশার মধ্যে পড়েন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

ব্যক্তিপর্যায়ে আইনটির অপপ্রয়োগের যে সুযোগ রয়েছে, তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি অপপ্রয়োগ হতে পারে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত সরকার বা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কাউকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে এবং সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলো প্রয়োগ আরম্ভ করে। লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর যেভাবে তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তার চেয়েও বেশি আলোচিত হয়েছিল যখন কার্টুনিস্ট কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো আলোচনা-সমালোচনাই কিশোরকে এ যাবৎকালে মুক্ত করেনি। কিন্তু যেই না কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু হলো অমনি কিশোরের জামিন হয়ে গেল। সুতরাং আইনটির প্রয়োগ, কার্যকারিতা এবং এই আইনের অধীনে কিভাবে বিচার হচ্ছে তা আমরা লেখক মুশতাকের মৃত্যু এবং কার্টুনিস্ট কিশোরের জামিনকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারব।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

Exit mobile version