গল্পটা আমাদের রফিকের

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper

  • আফফান উসামা
  •  ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৩:৫৩, আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:৪৬

মোহাম্মদ রফিক – ছবি : সংগ্রহ

গল্পটা একজন মহানুভব মহান ক্রিকেটারের। গল্পটা একজন মানবিক ক্রিকেটারের। গল্পটা আমাদের মোহাম্মদ রফিকের। মোহাম্মদ রফিক, কে না চিনে তারে? বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক সময়কার সবথেকে বড় বিজ্ঞাপন তিনি, আর সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সেরাদের অন্যতম একজন। তাকে মূল্যায়ন করতে পরিসংখ্যান ব্যর্থ হবে। তাকে বুঝতে ফিরতে হবে পেছনে, তার অতীতে, তার জীবন গল্পে। তার জীবন সংগ্রাম আর উত্থান পর্ব আপনাকে কাঁপিয়ে দেবে, শিহরিত করবে নিঃসন্দেহে।

বুড়িগঙ্গার তীরঘেষে গড়ে উঠা জিঞ্জিরার বস্তিতে সারা দিন ক্রিকেট খেলে আর মাছ ধরে সময় কাটানো ছোটবেলার রফিক দেখেছিলেন দারিদ্রতাকে। নদী পাড়ে গরু চরাতে এসে নৌকার মাঝিকে বলে কয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসতেন রোজ বিকেলে। কারণ? কারণ ঢাকায় ক্রিকেট খেলা যায়!

সময় বহমান। বহমান প্রতিক্ষণ। দিনের পর দিন শেষে, মাস ফুরিয়ে বছর আসে। কেটে যায় কত কাল। তারই সাথে পথ চলতে দারিদ্র্যতাকে বন্ধু করে জিঞ্জিরার রফিক, একসময় রফিক হয়ে উঠলেন সমগ্র বাংলার। ব্যাটে-বলে সমতালে তার হাতেই লেখা হয় ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয়ের ইতিহাস। স্বাধীন বাংলার প্রথম জয়ের মহানায়ক!

ক্রিকেটের নতুন দর্শন ‘পিঞ্চ হিটিং’য়েও বাংলার সার্থক রূপকারও ছিলেন রফিক। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিলেন এই বাঁহাতি। সেই সঙ্গে ব্যাটিংয়েও তিনি হরহামেশাই মেটাতেন সময়ের দাবি। বিশেষ করে বিষাক্ত নীল স্পিন বিভ্রমে যেভাবে খাবি খাওয়াতেন বোলারদের, তাতে হরভজন সিং বা রঙ্গনা হেরাথও ছুটে আসতেন তার কাছে; একটুখানি পরামর্শ নিতে।

সাকিবের বাঁ হাতের ভেল্কি দেখতে আমরা চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি। স্পিন বিভ্রমের কথা হলে রাজ্জাককেও চোখে ভেসে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্পিন পথিকৃৎ মোহাম্মদ রফিকই। অনেক বা অগণিত বোলার হয়তো ওয়ানডে বা টেস্টে ১০০ উইকেট পাবে। কিন্তু ইতিহাস দেখতে গেলে প্রথম শততম উইকেট শিকারি আমাদের রফিকই।

প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড আছে রফিকের।(১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭)। তাছাড়া প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্ট ও ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট আর ১,০০০ রান সংগ্রহকারী মোহাম্মদ রফিক।
২০০৫ সালে বর্ষ সেরা ক্রিকেটার ও ২০০৬ সালে বর্ষসেরা বোলার নির্বাচিত হন রফিক। তখনকার সময়ে ওয়ানডে ও টেস্ট বোলিং র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ১৯। যা ছিল মোহাম্মদ রফিকের।

তার জীবনে ক্রিকেটের গল্পের বাহিরেও গল্প আছে। যেই গল্পগুলো আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। যেমন—

▪️ঐতিহাসিক মুলতান টেস্টে উমর গুলকে নিশ্চিত মানকাট আউট না করে মহানুভবতার এক অম্লান মূর্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ম্যাচটি শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। পরে রফিককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তার সরল ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আউটটা করলে আমরা জিতে যেতাম ঠিক; কিন্তু, মানুষ আমাদের ছোটলোক ভাবত। আমরা ছোট লোক নয়।’

উচ্চ ব্যক্তিত্বের এ মানুষটি একটি বস্তি থেকে ওঠে এসেছে, যে জীবনে কখনো পড়ালেখা করেননি! ভাবা যায়!

▪️১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর অংশ নেয়া সকল খেলোয়াড়কে সরকারি অনুদানে জমি আর গাড়ি দেয়া হয়েছিল। মোহাম্মাদ রফিক সে টুর্নামেন্টের ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন আর ফাইনালে করেছিলেন ম্যাচজয়ী ২৫ রান। তার সে জমি দান করেছিলেন এলাকার বস্তিতে স্কুলের জন্য; আর গাড়ি বিক্রির টাকায় উঠেছিল স্কুলের বিল্ডিং। বলেছিলেন, ‘আমরা তো লেখাপড়া করতে পারি নাই। পোলাপাইনগুলা যেন পারে।’

▪️আইসিসি ট্রফি জয়ের পরনপ্রধানমন্ত্রীর কাছে যখন অন্য ক্রিকেটাররা গাড়ি-বাড়ি চাইতে ব্যস্ত, তখন মোহাম্মদ রফিকে চাওয়া ‘নিজের জন্মস্থান বুড়িগঙ্গার কাছে বাবু বাজারে একটা ব্রিজ’, যাতে মানুষের যাতায়াতে সুবিধা হয়। তার অনুরোধে ওই ব্রিজটি হয়।

▪️নিজের পৈত্রিক জমি তিনি দান করে দিয়েছিলেন চক্ষু হাসপাতালে তৈরীতে। আর এখন চেষ্টা করে চলেছেন বাকি যা আছে তাই নিয়ে একটা ক্রিকেট একাডেমি গড়তে।

▪️২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের সময় রফিক তার ঐতিহাসিক ১১১ রানের ইনিংসের সেই ব্যাটটি (দেশের বাইরে প্রথম সেঞ্চুরি) নিলামে তুলেছিলেন এবং ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে রফিক প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে স্মারক নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আজ এত গল্প করার কারণ লিজেন্ডস লিগ ক্রিকেটে এশিয়া লায়ন্সের হয়ে মোহাম্মদ রফিকের অসাধারণ নৈপুন্য। ৪ ওভার বোলিং করে তুলে নিয়েছেন ওয়াসিম জাফর আর স্টুয়ার্ড বিনির উইকেট। তার চঞ্চলতা দেখে কে বলবে মোহাম্মদ রফিক বুড়িয়েছেন, ফুরিয়েছেন। তিনি তো সেই পুরনো রফিকের মতোই লড়েছেন। আগামী ম্যাচগুলোতেও তার ছাপ থাকুক, তার বোলিংয়ে প্রতিপক্ষ কাঁপুক। শুভকামনা রফিকের জন্য।