করোনা চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা চরমে

দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে চরম সমন্বয়নহীনতা দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও রোগীদের রোগ লুকানোর প্রবণতার ফলে এখন পর্যন্ত ৪৪ চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪ জন। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন ৩ শতাধিক চিকিৎসকসহ সহস্রাধিক নার্স, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের খাবার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এসব স্বাস্থ্যকর্মীর খাবারের দায়িত্ব নেয় সামাজিক সংগঠন বিদ্যানন্দ। তারা ইতোমধ্যে হাসপাতালে শুকনা খাবার পৌঁছে দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত তিন মাস ধরে করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয় সরকার। এ সময় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে বার বার গণমাধ্যমে ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মার্চ মাসের শুরুতে দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো কার্যত বন্ধ করে দেয় মালিকরা। এতে বিপাকে পড়ে সাধারণ রোগী ও স্বজনরা। বিনা চিকিৎসায় দেশের বিভিন্ন স্থানে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে। এতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চরম অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে ওঠে।

এর মধ্যে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয় বলে জানায় বাংলাদেশ ডক্টরস ফেডারেশন। দেশের একাধিক জেলায় বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া সারা দেশে প্রায় তিন শতাধিক ডাক্তার কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ৮ জন চিকিৎসক। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৩ জন চিকিৎসক এ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সোমবার একজন চিকিৎসক করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান। তবে তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

রাজধানীর উত্তরায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪ জনের মধ্যে ২ জন নারায়ণগঞ্জের, ১ জন ঢাকার ও ১ জন সিলেটের ডাক্তার। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিভাগের আক্রান্ত ২ জনের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও অন্যজন নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। দুই বিভাগের ১০ জন করে ২০ জন ডাক্তার ও ১০ জন নার্স আক্রান্ত সন্দেহে বা আক্রান্তদের সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কায় তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।

ডাক্তারদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফেডারেশন (বিডিএফ) আক্রান্ত বা সন্দেহজনক আক্রান্তদের বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করছেন।

সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক ডা: নিরুপম দাশ বলেন, যেসব চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ডাক্তার ঢাকায় কর্মরত। রোগীরা নিজেদের করোনা উপসর্গগুলো লুকানোর চেষ্টা করছে। কে করোনাভাইরাসের রোগী আর কে ভাইরাসের রোগী নয় তা তাৎক্ষণিকভাবে না জেনে অনেকেই চেম্বারে রোগী দেখতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত অবস্থায় ডাক্তার কর্মস্থলে গিয়ে অফিস করছেন। অন্যদের সঙ্গে বসে কথা বলছেন। এরপর অসুস্থ বোধ করায় করোনাভাইরাসের টেস্ট করতে গিয়ে পজিটিভ ধরা পড়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স অসুস্থ হয়ে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। এভাবে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক চিকিৎসক হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। আবার কেউ আইসোলেশনে রয়েছেন। চিকিৎসকরা প্রথম থেকেই রোগীদের চিকিৎসা ও তাদের নিরাপত্তায় পিপিই (পারসোনাল প্রটেকশন ইকুয়িপমেন্ট) দেয়ার দাবি করে আসছিল। যে ধরনের পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে তা মানসম্মত নয়। ফলে পিপিই পরেও ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তারদের যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা নেই। চার দেয়ালের ভেতরে বসে নির্দেশ ও হুমকি দেয়া যায়। কিন্তু করোনা মোকাবেলা করতে হলে এগুলো না করে সুষম বণ্টন ও সঠিক সমন্বয় করতে হবে। দেশের এ স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

নার্সদের খাবার সরবরাহ করবে বিদ্যানন্দ : করোনার জন্য নির্ধারিত চিকিৎসাকেন্দ্র কুয়েত মৈত্রী বাংলাদেশ সরকারি হাসপাতালে গতকাল নার্সদের শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ। সোমবার থেকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তাদের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে জানায় তারা। এ ছাড়া যেকোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে খাবারের সমস্যা থাকলেও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এর আগে গত রোববার বাজেট স্বল্পতার কারণে কুয়েত মৈত্রী বাংলাদেশ হাসপাতালে নার্সদের খাদ্য সঙ্কট এমন শিরোনামে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়।

ভয়ঙ্কর এই মহামারী চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে সরকারিভাবে খাবার সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়লে নানান আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সহতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ডা: আতিকুজ্জামান ফিলিপ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, এ কষ্ট রাখি কোথায়? এ লজ্জা রাখি কোথায়? করোনা যুদ্ধের অগ্রসৈনিকদের খাবারের বাজেট নেই! না খেয়ে, অর্ধ খাবার খেয়ে, বাসি পচা খাবার খেয়ে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন আমার সহযাত্রী চিকিৎসক নার্স ভাই-বোনেরা!