Site icon The Bangladesh Chronicle

ওপারে গোলাগুলি চলছে, রোহিঙ্গাদের ঢোকার চেষ্টা

মিয়ানমারের রাখাইনে গোলাগুলি, সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় এপারে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। তবে তারা যাতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরপরও নাফ নদীর ওপারে বেশ কয়েকটি নৌকায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা অপেক্ষায় রয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে।

সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্রসহ ২৩ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ সোমবার কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের রিমান্ড শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে। রোহিঙ্গা–ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

এদিকে গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী তেলীপাড়া এলাকার একটি ব্রিজের নিচ থেকে মাথায় হেলমেট, গ্লাভস, গুলিসহ অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপর দিকে উখিয়া সীমান্ত থেকে শনিবার উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।

২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। ইতিমধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। পরদিন সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এ সময়ে মিয়ানমার সেনা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা বর্তমানে বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন।

এপারে আসতে অপেক্ষায় শত শত রোহিঙ্গা

দিনের বেলায় নাফ নদীতে ছোট ছোট ডিঙিতে রোহিঙ্গাদের ভাসতে দেখা গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সতর্ক পাহারার কারণে দিনে ঢুকতে পারছেন না রোহিঙ্গারা। রাতে সুযোগ বুঝে নাফ নদী পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষা করছেন তাঁরা।

স্থানীয় লোকজন বলেন, নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের শিলখালী ও বলিবাজার এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। এতে ওই এলাকায় থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, টেকনাফের মাঝেরপাড়া, উত্তরপাড়া, কোনারপাড়া, লম্বাবিল, উনছিপ্রাং, কানজড় পাড়ার বিপরীতে ওপারে নাফ নদীতে ছোট ডিঙি নিয়ে অবস্থান করছে কিছু রোহিঙ্গা। কয়েক ঘণ্টা পর পর তারা এপারে আসার চেষ্টা করে। তখন বিজিবি বাঁশি বাজালে তারা আবার ওপারে চলে যায়। লম্বাবিলের বাসিন্দা নাসির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এলাকা থেকে ওপারে কিছু ডিঙি দেখা যাচ্ছে। প্রতিটিতে ১৫-২০ জন করে মানুষ আছে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

বিজিবি ও কোস্টগার্ড সূত্রমতে, নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গাবোঝাই চার-পাঁচটি নৌকা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সময় টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি ১০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর চৌধুরী বলেছেন, ‘রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মঙ্গলবার সকালে অস্ত্রসহ ২৩ জন রোহিঙ্গাকে ধরে বিজিবির হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা সতর্ক পাহারায় আছি।’

একই মন্তব্য করেছেন টেকনাফের হোয়াইকং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তাঁদের এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করছে। গত তিন দিনে ছয়জন রোহিঙ্গাকে বিজিবি আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে। আরও কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নিয়ে নাফ নদীতে অবস্থান করছে বলে তাঁরা শুনেছেন। এ জন্য তাঁর এলাকার সব ইউপি সদস্যকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। কোনোভাবেই যেন একজন রোহিঙ্গাও অনুপ্রবেশ করতে না পারে।

বালুখালী ও উনছিপ্রাং আশ্রয়শিবিরের কয়েকজন মাঝি বলেন, কয়েক দিন ধরে সীমান্তের ওপারে চাকমাকাটা, কোয়াংচিমন ও কুমিরখালী ঘাঁটি দখলে নিতে যুদ্ধ চলছে। এসব এলাকায় কয়েক শ রোহিঙ্গা আছে।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ওপার থেকে যাতে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে বিজিবি সতর্ক পাহারায় রয়েছে। ইতিমধ্যে এপারে আসতে চেষ্টা করা অনেক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লুৎফুর লাহিল মাজিদও প্রথম আলোকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওপার থেকে একজন রোহিঙ্গাও যাতে ঢুকতে না পারে, এ ব্যাপারে তাঁরা সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রয়েছেন।

অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ২৩ রোহিঙ্গার রিমান্ড শুনানি আজ

মঙ্গলবার উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে অস্ত্রধারী ২৩ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা তাদের আটক করে বিজিবির কাছে সোপর্দ করে। পরে শুক্রবার দুপুরে উখিয়া থানায় বিজিবির এক সদস্য বাদী হয়ে ওই রোহিঙ্গাদের আসামি করে মামলা করেন। পরে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, পালিয়ে আসা এই ব্যক্তিরা আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির (এআরএ) সদস্য। সশস্ত্র এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটির প্রধান হচ্ছেন নবী হোসেন।

বিজিবির সূত্র জানায়, এই নবী হোসেন সীমান্তে মাদক, অস্ত্র পাচারসহ নানা অপরাধের হোতা, যাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা আছে।

উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ রোহিঙ্গার অস্ত্রের উৎস, সীমান্তের আশপাশে তারা কেন ছিল, তা সোমবার (আজ) তাদের রিমান্ড মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার চেষ্টা করা হবে।

মাথায় হেলমেট, গ্লাভস পরা লাশ উদ্ধার

উখিয়া উপজেলার বালুখালী সেতুর নিচ থেকে একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে এটি উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের কোমরে থাকা বেল্ট থেকে ৯৯টি গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নাফ নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা একটি খালে জোয়ারের পানিতে লাশ ভেসে আসতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে।

ওসি আরও বলেন, লাশের মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লাশটি তিন-চার দিন আগের। পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।

প্রথম আলো
Exit mobile version