অর্থমন্ত্রী, আসলেই কি অর্থনীতি ভালো আছে

অর্থমন্ত্রী, আসলেই কি অর্থনীতি ভালো আছে

www.prothomalo.com   7 February 2020

গ্লাসটি অর্ধেক ভরা, না অর্ধেক খালি—এখন আর বিষয়টি সেখানে নেই। বলতে হবে গ্লাসটি সম্পূর্ণ ভরা অথবা সম্পূর্ণ খালি। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে অন্তত সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ‘বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী’ আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, একটিমাত্র সূচক কেবল নেগেটিভ (ঋণাত্মক), আর সেই খাতটি হচ্ছে রপ্তানি বাণিজ্য। এটি ছাড়া একটি খাতেও দেশ পিছিয়ে নেই। আসলে কি তাই? যদি তাই হবে, তাহলে অর্থের সন্ধানে মরিয়া হয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অর্থ নেওয়ার নতুন একটি আইন করতে হতো না।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাত মাস চলে গেছে। বেশির ভাগ সূচকেরই অন্তত ৬ মাসের হালনাগাদ তথ্য এখন পাওয়া যায়। কোনো গোপন প্রতিবেদন নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে এসব সূচক প্রকাশ করে। যে কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গেলে তা পেয়েও যাবেন। সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন গত ৩০ জানুয়ারির। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করে থাকে। যেমন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মাত্র এক দিন আগেই রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কেবল প্রবাসী আয়ের সূচকটিই ভালো আছে। আর রপ্তানি, আমদানি, রাজস্ব আয়, সরকারি ঋণ, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ, মূল্যস্ফীতি, শেয়ারবাজার—সব কটির অবস্থাই বেশ খারাপ।

এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, কেবল রপ্তানি বাণিজ্যের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কথা। জুলাই থেকে জানুয়ারি—এই সাত মাসে রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই। এ সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। অথচ আগের অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বলে রাখা ভালো, এবার যদি শেষ পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে, তাহলে তা হবে গত দশকের রেকর্ড। কেননা, এ সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয়ের এই দশা আর দেখা যায়নি।

এবার দেখা যাক অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো কী অবস্থায় আছে। আমদানির হিসাব পাওয়া যায় ৫ মাস পর্যন্ত। এই ৫ মাসে আমদানির প্রবৃদ্ধিও রপ্তানির মতোই, কমেছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ৫ মাসের আমদানির তথ্য পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্য কয়েক মাস ধরে আর হালনাগাদ করছে না। সূচকের অবস্থা বেশি খারাপ বলে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। এই দুই মাসে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ১৯ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং মূলধনি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

আমদানি ও রপ্তানির এই চিত্র থেকে এমন সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে দেশের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বেশ খারাপ। এর প্রমাণও আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেই। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ বেসরকারি খাত ব্যাংক থেকে তেমন ঋণ নিচ্ছে না।

খারাপ অবস্থা রাজস্ব আয়েও। ৬ মাসে রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অথচ এ সময়ে আদায় বাড়ানোর কথা ৪৫ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতির কারণেই সরকারকে এখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পুরো অর্থবছরের জন্য যে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৬ মাসের মধ্যেই। গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া ঋণ ৪৯ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এই ঋণ গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপরও সরকারের আরও অর্থের প্রয়োজন হবে। এ কারণেই স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থার অর্থের দিকে এই নজর। এ জন্য নতুন আইন পাস করতে হলো সরকারকে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকই গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়ে গেছে। অর্থাৎ, এমনটি এখন আর দেখা যায়নি। এসবই প্রকাশিত সরকারি তথ্য। অথচ অর্থমন্ত্রী বললেন, একটি ছাড়া বাকি সব ভালো অবস্থায় আছে, বরং উল্টো করে বলে যায়, আসলে একটি ছাড়া বাকি সব সূচকই খারাপ অবস্থায় আছে। আর ভালো থাকা সূচকটি হচ্ছে প্রবাসী আয়। ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ফল এটি। দেশীয় মুদ্রাকে কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত রেখে এই নগদ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, সে প্রশ্ন তো অর্থনীতিবিদেরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়াঅর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এবারের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের কম হবে না। এমনকি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জেপি মর্গান—সবাই তা-ই মনে করে। মুশকিলটা হয়েছে এখানেই। পুরোটা অর্থবছরে অর্থনীতির সূচক যা-ই থাকুক না কেন, শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়, অর্থবছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো বদলই হয় না। পাশের দেশ ভারতেও তিন মাস পরপর জিডিপির প্রাক্কলন হালনাগাদ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সেই ভদ্রলোকের মতো, যার কথা একটাই।

কয়েক বছর ধরেই জিডিপি চূড়ান্ত করার সময় এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে জিডিপি বেড়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এবার এখন পর্যন্ত একমাত্র অবলম্বন প্রবাসী আয় আর সব ঠিক হয়ে যাবে—এই আশাবাদ।

অর্থনীতি চাপে আছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মন্দাদশায়। বিশ্ব পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল নয়। করোনাভাইরাস শিগগিরই না কাটলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সমস্যা আরও বাড়বে। আবার দেশের মধ্যে রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও সংকটে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন বিনিয়োগ আসছে না। ব্যাংক খাতও আছে ‘নয়-ছয়’ সমস্যায়। এই অবস্থায় অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু এর আগে অর্থনীতিতে যে সমস্যা আছে, তা মানতে হবে। অর্থনীতিতে সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যায় না। বহুমুখী চাপের মধ্যে থেকে অর্থনীতিকে ঠিক পথে রাখাই হবে এখন অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

কটি ছাড়া সব সূচক ভালো থাকা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো জানি একটি সূচক ভালো আছে, সেটি হচ্ছে প্রবাসী আয়। অন্যগুলো নেতিবাচক। যেমন রাজস্ব আয়, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি, ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবাহ, এমনকি বড় বড় কোম্পানির মুনাফা-বিক্রি ইত্যাদিও কমে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী কীভাবে বললেন, আমার বোধগম্য নয়।’