Site icon The Bangladesh Chronicle

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘লম্বা নাক’

ফাইল ছবি

একই কথা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বলে মিয়ানমার যতই সাফাই গাক না কেন, কেউ সে কথায় কান দেয়নি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই অবিলম্বে দেশচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের কাছে দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশও এই প্রশ্নে মধ্যস্থতার জন্য জাতিসংঘের ‘অভিভাবকত্ব’ মেনে নিয়েছে। শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলে তৃতীয় পক্ষ এভাবে নাক গলাতে পারত না।

মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার কাঠামোগত অপূর্ণতা সত্ত্বেও, এ কথা এখন মোটের ওপর স্বীকৃত যে জাতিসংঘভুক্ত প্রতিটি দেশকে কিছু কিছু মৌলিক নীতিমালা মেনে চলতে হয়। মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ইত্যাদি এই নীতিমালার অন্তর্গত। প্রায় সব মৌলিক প্রশ্নেই এখন আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র বা কনভেনশন গৃহীত হয়েছে। কারও চাপে পড়ে নয়, স্বেচ্ছায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেসব চুক্তির স্বাক্ষরকারী। ধরা যাক, শিশুশ্রম অথবা বাল্যবিবাহ। আপনার দেশে যে প্রথাই প্রচলিত থাকুক, এ–সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলে তাতে নির্ধারিত বিধান মেনে চলতে আপনি বাধ্য। অর্থাৎ, ১৮ বছরের কমবয়সী বালককে শ্রমে নিয়োগ করলে অথবা ১৫ বছরের কম কোনো বালিকাকে বিয়ে করতে বাধ্য করলে আপনি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করবেন। নিজ দেশের সংস্কৃতি বা নিয়ম-রীতির কথা বলে যতই লম্বা ফিরিস্তি দিন না কেন, আন্তর্জাতিক ফোরামে এই ব্যাপারে আপনাকে জেরা করা হতেই পারে।

এ তো গেল আইনের কথা। প্রযুক্তির কথা ভাবুন। যে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের বাস, সেখানে নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ বলে এখন আর কিছু নেই। আপনার দেশে নিরাপত্তাবাহিনী গুম-খুন করে চলেছে, এমন অভিযোগ নিয়ে যদি বিদেশি বার্তা সংস্থা সিনেমা বানায়, আপনি তাকে ঠেকাবেন কী করে? বড়জোর নিজের দেশে সে সিনেমার উন্মুক্ত প্রচার আপনি ঠেকাতে পারেন, কিন্তু মুখ বুজে সে নির্দেশ মেনে চলবেন, এমন সুশীল নাগরিক কোথায় পাবেন?

ফাইল ছবি

গুজরাটের মুসলিম নিধনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা ঘিরে একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছে বিবিসি। ভারত সরকার লম্বা ঘোষণা দিয়ে সে তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করেছে। ফল হয়েছে উল্টো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে সে তথ্যচিত্র দেখছেন। শুধু ছাত্রছাত্রী কেন, বিরোধী কংগ্রেস দল কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সদলবল সেই তথ্যচিত্রের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে।

জর্জ ফ্লয়েডকে এভাবে হত্যার পর পুলিশের জবাবদিহি ও বর্ণবাদী নিপীড়নের ন্যায়বিচারের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় 
ফাইল ছবি: এএফপি

অথবা ভাবুন চীনের শিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর অব্যাহত নির্যাতনের প্রশ্নটি। চীন যতই ‘এটা আমার অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে প্রচার করুক, আধুনিক তথ্যব্যবস্থার সুবাদে পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে ‘পুনঃশিক্ষা প্রদান’ কর্মসূচির নামে সেখানে উইঘুরদের ওপর কেমন নির্যাতন চলছে। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক টাইমস খোদ চীনা সরকারের প্রায় ৪০০ পাতার অতি গোপনীয় মূল নথি পত্রিকার পাতায় ছেপে দেয়। এইখানে দেখুন

আসলে বিদেশি বা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ঠেকানোর প্রয়োজন পড়ে, যখন আমরা কোনো কিছু ঢাকতে চাই। গুম–খুন হলে আমরা চেঁচিয়ে বলি, না, গুমখুন হয়নি। সত্যি যদি গুম–খুন না হয়, তাহলে তো চেঁচানোর প্রয়োজন পড়ে না। মোদি সাহেব যদি গুজরাটের হত্যাকাণ্ডের হোতা না হতেন, তাঁকে হুমকি দিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র বন্ধের এই হাস্যকর ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো না। সত্যি সত্যি যদি দশ লাখ রোহিঙ্গা সামরিক হামলার মুখে দেশত্যাগে বাধ্য না হতো, তাহলে এই প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দেশের নেতাদের জেরার মুখে পড়তে হতো না।

আইনভিত্তিক যে বিশ্বব্যবস্থার কথা আগে উল্লেখ করেছি, তা এই সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যেসব ছোট-বড় দেশ, তাদেরই গৃহীত এসব নীতিমালা মেনে চলবে। এই আন্তর্জাতিক অবস্থা কেমন হবে, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে, প্রায় ২০০ বছর আগে প্রথম তার রূপরেখা প্রণয়ন করেন জার্মান দার্শনিক এমানুয়েল কান্ট। তিনি যে ‘গণতান্ত্রিক দেশসমূহের শান্তিপূর্ণ সংস্থা’ প্রস্তাব করেন, তার মোদ্দা কথাই ছিল, এই সংস্থাভুক্ত প্রতিটি দেশ শান্তি, অনাক্রমণ ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মতো নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলবে। কেউ সে নিয়ম ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে যৌথভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। জাতিসংঘভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থারও একই কথা। দায়িত্বটা একক নয়, সম্মিলিত। জাতিসংঘ সনদের ৫৫ ও ৫৬ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা’ রক্ষায় সংস্থাভুক্ত দেশগুলো ‘সম্মিলিতভাবে’ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা বলছি বটে, কিন্তু এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অজুহাতে ক্ষমতাশালী দেশগুলো যত্রতত্র কাছে-দূরের দেশে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করছে। একই যুক্তিতে তারা ‘সরকার বদল’ বা ‘রেজিম চেঞ্জের’ রাজনীতিও অনুসরণ করছে। দেখা গেছে, যারা আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার কথা বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি এই আইন ভাঙে। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ হামলার কথা ধরুন। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী এই দুর্বল দেশের ওপর সে হামলা করে বসেছে, লক্ষ্য পুরো দেশটিকে নিজ ‘সাম্রাজ্যে’র ভেতর ঠেসে ফেলা। নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ৭০ বছরে ডজনখানেকবার দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বারবার ঠিক এই কাজই করেছে। মানবাধিকার প্রশ্নে ওয়াশিংটন যেভাবে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তাতে দেশটির হিপোক্রেসি বা কপটতা দিনের মতো ফর্সা।

সার্বভৌমত্ব বনাম যৌথ দায়িত্ব

বস্তুত, যে মুহূর্তে কোনো রাষ্ট্র এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন কিছুটা হলেও নিজের জাতীয় সার্বভৌমত্ব সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়। যেমন শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরের ফলে আমরা মেনে নিই যে জাতিসংঘের মতো বহির্গত শক্তি এ ব্যাপারে আমাদের অনুসৃত ব্যবস্থার ওপর নজরদারি করতে পারবে। প্রয়োজনবোধে তারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করতে পারবে। যেমন আফগানিস্তানে মেয়েদের শিক্ষা ও কর্মের অধিকার বঞ্চিত করায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা আরোপের দাবি উঠেছে। এই যে গুণগত নতুন বিশ্বব্যবস্থা, প্রাচীন ‘ওয়েস্টফালিয়ান’ ব্যবস্থা থেকে তা ভিন্ন। ১৬৪৮ সালে জার্মানির ওয়েস্টফালে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির কেন্দ্রে ছিল এই নীতি যে প্রতিটি স্বাধীন দেশের স্বার্বভৌমত্ব অলঙ্ঘনীয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই সার্বভৌমত্বভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা থেকে আমরা সরে এসেছি। তার জায়গায় এসেছে ‘যৌথ দায়িত্ববোধ’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে অক্ষশক্তির ভূমিকা সেই যৌথ দায়িত্ববোধের প্রকাশ, এ কথা বলা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে এই যৌথ দায়িত্ব আরও কিছুটা সম্প্রসারিত হয়েছে। ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব) নামে পরিচিত এক নতুন নীতিমালার অধীনে প্রতিটি স্বার্বভৌম দেশ যার যার দেশের নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকারসহ সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ায় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ‘আরটিপি’ নামে পরিচিত এই নতুন নীতিমালার প্রবর্তন হয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের অধীন অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে সে সনদ স্বীকৃতি লাভ করে। তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে এসব দেশের কোনো কোনো নেতাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।

আপাতত আমাদের এইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে যে বড় দেশগুলোর চোখ রাঙানির একটা ভালো দিক হলো, এর ফলে আমরা কখনোসখনো কিছুটা নড়েচড়ে বসি। বাংলাদেশের কথাই ধরুন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে লুর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, র‌্যাব আগে কিছু ‘উল্টাপাল্টা’ যে করেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে র‌্যাবের জবাবদিহি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এখন অনেক উন্নতি হয়েছে।

২৮ জানুয়ারি ২০২৩, নিউইয়র্ক

Exit mobile version