Site icon The Bangladesh Chronicle

তেলের দাম বাড়ানো কেন অযৌক্তিক

তারেকুল ইসলাম | ২২ নভেম্বর ২০২১, ১৯:২৫

– ছবি : সংগৃহীত


সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম নজিরবিহীনভাবে প্রতি লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। তীব্র প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও সমালোচনা সত্ত্বেও এখনো সেই বর্ধিত মূল্যহার বহাল রাখা হয়েছে। ২৩ শতাংশ তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে পরিবহন মালিকদের ডাকা ধর্মঘটের মুখে পরিবহন ভাড়াও এক লাফে বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ। তেলের দাম ও পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোভিড-পরবর্তী সাধারণ মানুষের সীমিত ক্রয়ক্ষমতা ও আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিবহন মালিকরাও শুধু নিজেদের স্বার্থই দেখলেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবলেন না। তারা ধর্মঘট করেছেন যতটা না তেলের দাম কমানোর দাবিতে, তার চেয়েও বেশি ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে। যার ফলে তাদের পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর দাবি দ্রুত পূরণ হলেও তেলের দাম কমেনি। তাছাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে অনুমোদিত বর্ধিত পরিমাণের চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। বাস ভাড়ার নৈরাজ্য ঠেকানোর ব্যবস্থা নেয়া হলেও সেটা তো চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। তাই সরকারকে জ্বালানি তেলের পূর্বতন মূল্যে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।

তেলের দাম বাড়ানোর পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাহলে যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিগত সাড়ে ৫ বছর যাবত আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল, তখন সেই অনুপাতে দেশে দাম কমিয়ে সমন্বয় করা হলো না কেন? বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিগত ৭ বছরে মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে সরকার প্রতি বছর ৯-১০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্সও আয় করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি থেকে। অথচ এখন বিপিসির মাত্র পাঁচ মাসের লোকসানের অজুহাতে উচ্চহারে তেলের দাম বাড়ানো হলো। কিন্তু বিপিসির আগের সেই লাভের টাকাটা গেল কোথায়? বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে যে মুনাফা করেছে বিপিসি, সেই টাকা দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে’ (১১ নভেম্বর ২০২১, মানবজমিন)। ‘দক্ষতা বৃদ্ধি’র জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরেও আর কোনো ‘অদক্ষতা’ বাকি থাকে যার কারণে বিপিসি এমন লোকসানে পড়েছে যে উচ্চহারে দাম না বাড়িয়ে উপায় ছিল না? ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিপিসির আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন।

সরকার যে লোকসানকে দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে, তার ‘নৈতিক ভিত্তি’ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল আলম বলেছেন, ‘কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। তেলের দাম বাড়িয়ে জ্বালানি বিভাগ সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। সরকার লোকসানে নেই। সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয় ঠিকই, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট ও মুনাফা বাবদ আয়ও করে। তবে বিশ্ববাজার থেকে কত টাকায় কেনে, পরিবহন ভাড়া কত দেয় বিপিসির এই বিষয়টি স্বচ্ছ নয়। এ ক্ষেত্রে বড় আকারের দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিপিসি যা বলছে, আমরা তাই বিশ্বাস করছি’ (৮ নভেম্বর ২০২১, ডেইলি স্টার)। এ ছাড়া এভাবে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটিও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, আইনগতভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট মূল্যের শুল্ক নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে শুধু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হাতে। অথচ বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে এককভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। শামসুল আলম মনে করেন, আইন লঙ্ঘন করে সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেটা বোঝা যায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমানের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমলাদের এতবড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই’ (১১ নভেম্বর ২০২১, বাংলা ট্রিবিউন)। সুতরাং, এ প্রশ্ন করাটা অযৌক্তিক হবে না যে, তাহলে কি এক্ষেত্রে বিপিসিকে ‘শিখণ্ডী’ বানানো হয়েছে? কারণ এটা স্পষ্ট যে, বিইআরসিকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নিয়ম হলো, বিইআরসির কাছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠাতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি যাচাই-বাছাই করে দেখবে যে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব যৌক্তিক কি না। আর যৌক্তিক হলেও ভোক্তার স্বার্থের সাথে সঙ্গতি রেখে কতটুকু দাম বাড়ানো যেতে পারে সেসব বিচার-বিবেচনার দায়িত্ব মূলত বিইআরসির। যদি দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি নিয়মমাফিক হতো, তাহলে প্রতি লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা না-ও বাড়তে পারত।

এ ছাড়া জনগণের স্বস্তির জন্য সরকারের কাছে আরেকটি উপায় ছিল যেটা ঠিক একই সময়ে ভারত অবলম্বন করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে ভারত জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে বরং তেলের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক (excise duty) উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে ভারত সরকার বলেছে, ‘পেট্রল ও ডিজেলের ওপর আবগারি শুল্ক কমানোর ফলে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে, যা গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য সহায়ক হবে’ (৪ নভেম্বর ২০২১, বিবিসি)। এই শুল্ক হ্রাস ভারতের কৃষক ও উৎপাদনকারীদের ওপর থেকে চাপ কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই সময়ে বিশ্বব্যাপী নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি আরো লাগামহীন হয়ে পড়বে। তাই ভারতের অনুরূপ আমাদের দেশেও জ্বালানি তেলের দাম ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য আবগারি শুল্কহার কমানোর কৌশলটা অবলম্বন করা যেতে পারত। এতে বিপিসি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কিছুটা কমলেও দাম বাড়ানোর দরকার হতো না এবং ভোক্তারাও স্বস্তিতে থাকতে পারত।

এখন তো পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিসহ সর্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এখন কি জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে সমন্বয় করা হবে? না, এরকম চর্চা আমাদের দেশে লক্ষণীয় নয়। দাম বেড়েছে তো বেড়েছেই; কমার আর লক্ষণ নেই। ২০১৬ সালের এপ্রিলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকায় সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি তিন টাকা কমিয়েছিল। তখন কিন্তু পরিবহন ভাড়া কমানো হয়নি। স্থিতিশীল সময় এলে কিভাবে পরিবহন ভাড়া কমানো যায় সে ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা না করেই উচ্চহারে তেলের দাম বাড়িয়ে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভারতে তেল পাচার রোধ করতে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে আরেকটি যুক্তি দেয়া হচ্ছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। ভারত থেকে দিনে প্রায় ২০০ ট্রাক বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে। এ ট্রাকগুলোর মাধ্যমে তেল পাচার হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এই তেল পাচার রোধ করাটা তো সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। তাই তেল পাচারের অজুহাতে জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধি চাপিয়ে দেয়াটা অযৌক্তিক।

তেলের দাম বাড়তে পারে এমন সংবাদ পেয়ে বিপিসির বিভিন্ন বিপণন কোম্পানি থেকে আগেভাগে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে। সরকার থেকে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার অব্যবহিত পূর্বেই দেশের বিভিন্ন ডিপো থেকে তিনটি জ্বালানি পণ্যের বিক্রি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় (ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েল)। একটি ‘অসাধু চক্রে’র মাধ্যমে দেশের ফিলিং স্টেশন ও ডিলাররা তেল কিনে মজুদ করেছে। এ ব্যাপারে বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘দুটি কারণে জ্বালানি তেলের বিক্রি বাড়তে পারে। এক. আগে থেকে সংবাদ পেয়েছে যে তেলের দাম বাড়ছে। দুই. বিপণন কোম্পানির কর্মকর্তাদের কারসাজি থাকতে পারে। তারা কম দামে এই তিনটি পণ্যের বেশি বিক্রি দেখিয়েছেন। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলো’ (৬ নভেম্বর ২০২১, ডেইলি স্টার)। বিপিসির জ্বালানি পণ্য আমদানি, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি বিদ্যমান। এর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছিল কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব বাংলাদেশ। তখন অডিট রিপোর্টে তারা বলেছিল, ‘বিপিসির প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। আয় ও ব্যয়ে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। আর এ কারণেই বিপিসির আর্থিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে’ (২৬ আগস্ট ২০১৫, সমকাল)। কাঠামোগত মজুদদারি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও তেল চুরি রোধ করতে না পারলে ফলস্বরূপ লোকসান গুনতে হবে এবং বিপিসি আবার আগের মতো ভর্তুকিনির্ভর হয়ে পড়বে। সরকারকে লাভবান হতে হলে অবশ্যই জ্বালানি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, আয়-ব্যয়ের অস্বচ্ছতা ও অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম সময়ান্তরে বাড়ে কমে। সে অনুসারে দেশে ভোক্তাদের স্বার্থের সাথে সঙ্গতি রেখেই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সবসময় জনস্বার্থের পক্ষে থাকবে, এটাই কাম্য। কিন্তু বিগত ৫ বছর ধরে দামের সমন্বয় না করে ব্যাপক মুনাফা লাভের পর এখন হঠাৎ করে লোকসানের অজুহাতে অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করাটা নিতান্তই জনস্বার্থবিরোধী। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর প্রকোপে সাধারণ মানুষ এমনিতেই আর্থিকভাবে সঙ্কটাপন্ন। সেটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জ্বালানি তেল ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো আঘাত করেছে। এখন গণপরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও ফসলের উৎপাদন খরচ, এলপিজি, সেবামূল্য, কৃষি ও নিত্যপণ্যের দামসহ সামগ্রিক ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। এই সর্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে করোনা-পরবর্তী এ সময়ে আরো বহু মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’ অর্থের জোগান দিতে গিয়ে জনগণের ঘাড়ের ওপর অমানবিকভাবে দফায় দফায় ভ্যাট-ট্যাক্স ও মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Exit mobile version