While everything on “Razakar” account

Minar Rashid

সবই যখন রাজাকারের একাউন্টে

কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লালন ভক্ত এক প্রফেসর নিহত হয়েছেন। সংসার বৈরাগী লালন ফকিরের

অতিমাত্রায় সংসারী (একাধিক বিয়ে ও লিভ টুগেদার) এক শিষ্যের কথা জানা গেলো। সামান্য অনুসন্ধান ব্যতিরেকে

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অভিযুক্ত করে এই হত্যাকান্ড নিয়ে বিরাট রাজাকারনামা বা জঙ্গীনামা লিখে বসেন জনাব

আব্দুল গাফফার চৌধুরী । কয়েকদিন পরেই খুনের আসল রহস্যটি বের হয়ে আসে। তারপরেও এই গাফফার

চৌধুরীদের গুণে মুগ্ধা জনকন্ঠের এক লেখিকা বিশেষণের বন্যা প্রবাহিত করে তাকে যুগশ্রেষ্ঠ কলামিস্ট হিসাবে

অভিহিত করেছেন। হায় সেলুকাস!

এই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা একটি দেশ ও জাতিকে ভয়ংকর অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে । ঘাতকরা যখন

নিজেদের লুকিয়ে ফেলতে পারে তখন সেই দেশ ও সমাজটিতে হত্যা, গুম ও অন্যান্য অরাজকতা উৎসাহিত হয়।

এব্যাপারে আমাদের শুরুতেই গলদ । অনেকেই মনে করেন আমরা যদি ১৪ ডিসেম্বরের মূল ঘাতকদের চিহ্নিত করতে

পারতাম কিংবা এব্যাপারে মুক্তভাবে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালাতে দিতে পারতাম তবে ২৫শে ফেব্রুয়ারীতে পিলখানায়

এতগুলি অফিসারকে এমন নির্মমভাবে জীবন দিতে হতো না। স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পরেও ইলিয়াস আলীর মত

বিরোধী দলীয় নেতাদের গুম হতে হতো না। ঘাতকরা অামাদের দুর্বলতাগুলি ধরে ফেলেছে। তারা নিজেদেরকে লুকিয়ে

ফেলতে পারবে এই ভাবনা থেকেই এই সব হত্যার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছে। খায় একজন কিন্তু বিল ওঠে প্রায়ই

অন্যের নামে।

আমরা এখনও সাবধান বা সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আমাদের জন্যে অারো ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করে আছে ।

ষোল কোটি মানুষের নিরাপত্তার জন্যেই এই বিষয়গুলি নিয়ে আজ আমাদের ভাবতে হবে। কাউকে বাঁচানো অথবা

অন্য কাউকে ফাঁসানো এই কলামের উদ্দেশ্য নয়। এই ধরনের অসুস্থ চিন্তার মানুষ যে দলে বা যে চেতনাতেই থাকুক

না কেন – এদেরকে বিচ্ছিন্ন ও নিস্ক্রিয় করতে হবে। এরা কোন দলের জন্যে এসেট নয় – এরা সকল দলের জন্যেই

লাইয়াবিলিটিজ।

আজ ১৪ ই ডিসেম্বরকে সামনে নিয়ে এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে । এই দিনটি জাতির জন্যে এক শোকাবহ

দিন। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দু দিন আগে জাতির সূর্য সন্তানরা গুম হয়ে যান। আজকের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটির

গুরুত্ব অত্যধিক। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সকল কুকর্মের যোগ্য সঙ্গী এরশাদও বলতে বাধ্য হয়েছেন যে

বর্তমান সরকার পাকিস্তানীদের মতই গুম-খুনে লিপ্ত। আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই কিছু সাহসী কথা উচ্চারন

করতে হবে।

এই ব্যাপারে জাতির মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও সেগুলির কোন জবাব নেই। জাতির মনে উথ্থিত এই সব প্রশ্নের

জবাব একটি বিশেষ জায়গা থেকে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই জবাবের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ কোন স্বাধীন

গবেষকের নেই।

নির্মম হত্যার শিকার এই বুদ্ধিজীবীগণ স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময়টিতেই ঢাকাতে অবস্থান করছিলেন। এতে

স্পষ্ট বোঝা যায় যে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকারগণ এই বুদ্ধিজীবীদের হুমকি বা ক্ষতিকর বলে

গণ্য করে নি। পাকবাহিনীর উপর পূর্ণ অাস্থা রেখেই পুরো সময়টি নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করেছিলেন।

পাক হানাদার বাহিনী আমাদের অনেক সূর্য সন্তানদের হত্যা করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীন

হওয়ার দুদিন আগের হত্যাকান্ডগুলি নতুন করে ভাবায়। আজকে যে গুমের সংস্কৃতি চালু হয়েছে তার শুরুটি সম্ভবত

তখন থেকেই। এই সব রহস্য যদি আমরা প্রথমেই উদঘাটন করতে পারতাম বা ঘাতকদের প্রথমেই চিহ্নিত করতে

পারতাম তবে এই জাতিকে হয়তো এত রক্ত দেখতে হতো না।

যেসব বুদ্ধিজীবী ১৪ই ডিসেম্বরে গুমের শিকার হয়েছিলেন তারা কেউ জয় বাংলার কিংবা আওয়ামীলীগের লোক ছিলেন

না। অধিকাংশই ছিলেন চীনা পন্থী কমিউনিষ্ট। বেঁচে থাকলে এঁদের অনেকেরই সিরাজ শিকদার বনে যাবার সম্ভাবনা

ছিল । কাজেই মনে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক যে এঁদের জন্যে কি লাল ঘোড়াগুলি একটু আগে ভাগেই দাবড়ানো

হয়েছিল ? আর সবই কি করা হয়েছিল সেই একই রাজাকারের একাউন্টে ?

পরবর্তিতে এই বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া স্বজনগন আওয়ামী ভাবধারার রাজনীতির প্রতি কাত হয়ে পড়ায় ( এক

ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশনের আওতায় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী রাজনীতির বিরোধী হওয়ায়) আওয়ামী

ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন । স্বজনের ঘাতকদের খুঁজে বের করার চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই অনেকের মূল

খেয়াল হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বরের নারকীয় হত্যাকান্ড নিয়ে স্বাধীন গবেষণা ও অনুসন্ধানটি

আরো জটিল ও স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে।

জহির রায়হান ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক পরে নিখোজ হয়েছেন । সেই জহির রায়হানও পড়ে গেছেন সেই একই

রাজাকারদের একাউন্টে। কলকাতায় অবস্থানরত নেতারা যুদ্ধের সময়টিতে কে কী করেছিলেন – সেই সব কাহিনী ফাঁস

করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন জহির রায়হান । ১৪ ডিসেম্বরে নিখোঁজ হওয়া ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকেও তিনি

খুঁজে ফিরছিলেন। সেই অপরাধে তিনিও গুম হয়ে গেলেন। সেই দোষও পড়লো রাজাকারদের ঘাড়ে ! অথচ সেই সময়ে

রাজাকারদের উপর দিয়ে মহা কারবালা বয়ে যাচ্ছিল । জহির রায়হানের গুম হওয়া ও তাকে ঘিরে রহস্যটি নিয়ে একটি

অসাধারন সিনেমা হতো পারতো। কিন্তু আফসোস, সেই ধরনের সাহসী জহির রায়হান আর দ্বিতীয়টি জন্ম নেয় নি

এই বাংলায়।

জানি না চিন্তা ও মননের এই বিভ্রান্তি থেকে এই জাতি কখন উদ্ধার পাবে ?

আর কখন জন্ম নিবে আরো কয়েক জন জহির রায়হান ?