মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে : শফিক রেহমান বনাম গাফফার চৌধুরী

Minar Rashid

( দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয় কলাম)

এরা কলেজ জীবনে একসাথে লেখাপড়া করেছেন। সেই সুবাদে পরস্পরের বন্ধুও বটে। এখন হয়েছে ‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি’ অবস্থা। এই বন্ধুত্ব বা শত্রুতার কথা শফিক রেহমানের কোনো লেখা থেকে খুব বেশি জানা যায় না। কিন্তু গাফফার চৌধুরী সাংবাদিকতা বা বন্ধুত্বের নীতিমালা ভঙ্গ করে অহরহ লিখে যাচ্ছেন। তার সর্বশেষ ‘শফিক রেহমানের মৃত্যুদণ্ড’ লেখাটি দেখে আমার মতো অনেকেই চমক খেয়েছেন। শিরোনামটি এভাবে লিখে মনে পুষে রাখা কোনো দুধের স্বাদ হয়তো ঘোল দিয়ে মিটিয়েছেন।

গুয়ান্তানামো বে-তে বন্দীদের ওপর নিপীড়ন হলে পশ্চিমা জগতের অনেক মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব সোচ্চার হয়েছিলেন। তাই বলে সেসব মানবতাবাদীর কেউ আল কায়েদার সমর্থক বা সিমপেথাইজার হিসেবে গণ্য হয়ে পড়েননি। কিন্তু শফিক রেহমানকে জনাব গাফফার চৌধুরী সেভাবেই চিত্রিত করতে চেয়েছেন। শফিক রেহমানের সর্বশেষ অপরাধ, তিনি এই ‘অসময়ে’ নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে গিয়ে তার মৃত্যুদণ্ডবিরোধী লেখালেখি প্রকাশ করে তার ক্যাম্পেইনটিও শুরু করেছেন।

শফিক রেহমান তার এই ক্যাম্পেইন শুরু করার জন্য সময়টিকে সঠিক বলে গণ্য করেছেন। কারণ মানুষের জীবন নিয়ে এমন রাষ্ট্রীয় হেলাফেলা গত ৪৫ বছরের মধ্যে আর কখনোই দেখা যায়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তার জনগণের একটা অংশের জন্য রীতিমতো ত্রাস বা আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও ছ্ত্রালীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ৩২ বছর যে দলটি করেছেন তাকে এখন একটি অভিশপ্ত দল হিসেবে গণ্য করেন। কাজেই যে কথাটি দেশের প্রায় সব মানুষের মনে অনুরণিত হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে বলার সৎ সাহস দেখিয়েছেন শফিক রেহমান। শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় যুক্তিটি হলোÑ ভুল সাক্ষী বা ভুল মানুষকে এই শাস্তিটা দেয়া হলে তা আর শোধরানোর কোনো উপায় থাকে না।

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর এই সর্বনাশা খেলাটি দেখে যদি তিনি আরো বেশি করে তার এই ক্যাম্পেইনটি শুরু করেন, তা হলে তাকে খুব বেশি দোষারোপ করা যাবে না। রাষ্ট্র যাকে সাব্যস্ত করেছে কসাই কাদের হিসেবে, পরিবার বলছে, ‘না, তিনি কসাই কাদের নন। তিনি কাদের মোল্লা।’ পরিবারের যুক্তি, ১৯৭১-এর সেই কসাই কাদের কোনোভাবেই ১৯৭২ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করতে পারে না। মানুষের স্মৃতিশক্তি এতটুকু সজীব থাকাবস্থায় উদয়ন স্কুলে সেই কসাই কাদের শিক্ষকতা করতে পারে না।

রাষ্ট্র বলছে, অপরাধ সংঘটনের সময় অভিযুক্ত সালাহ্উদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশে ছিলেন। সাপোর্টিং ডকুমেন্টসহ পরিবার বলছে, অভিযুক্ত সেই সময় দেশেই ছিলেন না। দেশ ও বিদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা সেই সুযোগটি পাননি। সমাজের একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এ ধরনের সংবাদগুলো শফিক রেহমানের কাছে পৌঁছেছে। এসব সংবাদ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি যদি তার মৃত্যুদণ্ডবিরোধী ক্যাম্পেইনটি আরো জোরেশোরে শুরু করেন তবে মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাকে রাজাকার বলা সম্ভব, কিন্তু কখনোই মতলববাজ বলা যাবে না। কারণ কোনো মতলববাজ কখনোই জনপ্রিয় ভাবনার বাইরে এ ধরনের ঝুঁকি কখনোই নেন না।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পুরো পশ্চিমা জগৎ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সেখানকার প্রায় সব দেশই নিজেদের জুডিশিয়াল সিস্টেমে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি বাতিল করে দিয়েছে। এরা বলেনি যে, আগে অমুকের শাস্তিটা হয়ে যাক, তার পরেই মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা হবে। কারণ যখনই কোনো দেশে এটি করা হয়েছে, তখন কেউ না কেউ তাৎক্ষণিকভাবে বেনিফিটেড হয়েছে। প্রকৃত কোনো মানবতাবাদী কখনোই এসব বিষয় গণনা করে মানবতার আহ্বানে সাড়া দেন না। কাজেই শফিক রেহমানকে উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা ও মানবিক প্রজ্ঞা গাফফার চৌধুরীদের কখনোই হবে না। বিশ্বমানবতার জন্য উপদ্রব বা আপদদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানবতার এই মশালটি শফিক রেহমানের মতো দুয়েকজন মানুষই জ্বালিয়ে রেখেছেন।
শফিক রেহমানের লেখার সাথে যাদের পরিচয় আছে তারা জানেন কোনো তথ্য বা সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ছাড়া তিনি কখনোই কিছু লিখেন না। তার লেখা পড়ে যে কারো মনে হবে যে, তিনি জীবন্ত তথ্যভাণ্ডার। তথ্যের রসালো উপস্থাপনায় ‘দিনের পর দিন’ খ্যাত শফিক রেহমানের জুড়ি নেই। বিরক্তিকর ও গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক কলামকে তিনি সরস ও জীবন্ত করে তুলেছেন। এ দেশের সাংবাদিকতায় কলামের এই ধারাটি বলতে গেলে তিনিই প্রবর্তন করেছেন।

একজন কলামিস্ট হিসেবে গাফফার চৌধুরী অন্য একজনের লেখার সমালোচনা করতেই পারেন। তিনি শফিক রেহমানের বই থেকে একটি বাক্যও উদ্ধৃত করে বলতে পারেননি যে এই তথ্যটি ভুল বা এই বক্তব্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। তার চেয়ে বরং নিজেদের চেতনায় সিক্ত সেই একই অভিযোগ বারবার করছেন। তার অভিযোগ, শফিক রেহমান একাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কখনোই কথা বলেননি। শফিক রেহমানসহ আমরা সবাই বারবার একটা কথা বলে এসেছি। সেই কথার জবাব এরা কখনোই দেয় না। ১৯৭১ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই হত্যাকাণ্ডের রুট কজ অ্যানালাইসিসসহ মূল ঘাতকদের নামটিকে ভাশুরের নামের মতো উহ্য করে ফেলা হয়েছে। মানবেতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মূলনায়ক ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর নামটি উচ্চারণ করা হয় না। উচ্চারণ করা হয় না ১৯৫ জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারের নাম যাদেরকে মূল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমাদের মনে সেই দাগটি দগদগে থাকাবস্থায় ভুট্টোর সাথে আমাদের জাতির জনক কেন এত ঘনিষ্ঠ হতে গেলেন? এবার জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বসেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাদের মাঝে যে দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে তাতে ঘৃণা বা ক্ষোভের লক্ষণ ছিল না।
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আজ যাদের বিচারের আয়োজন করা হয়েছে তারা ছিলেন সে সময়কার অক্সিলারি ফোর্স। মেইন ফোর্সের প্রধান নায়কদের বাদ দিয়ে অক্সিলারি ফোর্সের মধ্যম বা নি¤œস্তরের দায়িত্বশীলদের বিচার পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই বিচার অনেক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এমনকি তখন দালাল আইনে যে ৩৭ হাজারকে অভিযুক্ত ও কয়েক শ’র বিচার সম্পন্ন করা হয়েছিল আজকের মূল অভিযুক্তদের কেউ সেই তালিকাতেও ছিলেন না। কাজেই এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের খতম করার বিচার বা উপায় হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।

শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুক্তিটি হলো এর ভুল প্রয়োগ হতে পারে। ভুল সিদ্ধান্তের ওপর মৃত্যুদণ্ডের মতো কোনো শাস্তি একবার প্রয়োগ হয়ে গেলে তা আর সংশোধনের কোনো উপায় থাকে না। এর অনেকই হয়ে পড়ে স্রেফ জুডিশিয়াল কিলিং। শফিক রেহমান অনেক পরিশ্রম করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ধরনের অনেক উদাহরণ, তথ্য-উপাত্তসহ উল্লেখ করেছেন। তার উত্থাপিত সেসব যুক্তি খণ্ডনের শক্তি আবদুল গাফফার চৌধুরীর হবে না। কাজেই তিনি সহজ রাস্তা হিসেবে কুৎসা রটনা, বিশেষ চেতনা উদ্দীপিত করা ও ব্যক্তিগত চরিত্র হননের দিকেই অগ্রসর হয়েছেন।

কয়েক দিন আগে ইন্ডিয়ায় ‘জনতার হাতে’ বা ‘জনতার আদালতে’ আখলাক নামের এক মুসলিম ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এটি সেই জনতার আদালত যারা কারোর ফ্রিজে গরুর গোশত রাখাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করে। সেই দেশটির রফতানি এলাকার ডিপ ফ্রিজে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরুর গোশত সংরক্ষিত থাকে! এই বড় বড় রফতানিকারক ও আবার হিন্দু, এদের মধ্যে একজনও আবার হতভাগা আখলাকের স্বধর্মের নেই। বিশ্ববিবেকের উদ্দেশে আখলাকের মেয়ে একটি প্রশ্ন রেখেছিল, এখন যদি প্রমাণিত হয় যে আমাদের ফ্রিজে গরুর গোশত রাখা ছিল না, তবে কি আমার বাবাকে ফিরে পাবো? হতভাগা আখলাকের মেয়ের এই প্রশ্নটি বিশ্ববিবেককে নতুনভাবে নাড়া দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ইন্ডিয়ার প্রকৃত চিত্রটি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।

পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, আখলাক পরিবারের ফ্রিজে গরুর গোশত ছিল না, খাসির গোশত রাখা ছিল। কিন্তু তাতেও আখলাকের মেয়ে তার বাবাকে ফিরে পায়নি। এটা এমন এক শাস্তি যা একবার (প্রয়োগটি সাধারণ আদালতে হোক বা কোনো জনতার আদালতে হোক) ভুলভাবে প্রয়োগ করে ফেললে তা আর শোধরানোর উপায় থাকে না। শফিক রেহমানের মৃত্যুদণ্ডবিরোধী ক্যাম্পেইনের এটিই মূল কারণ।

এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বলয়টি অনেকটা ভেড়ার পালের মতো। এদের গুটিকয়েক যে দিকে যায়, বাদবাকি সবাই কোনোরূপ প্রশ্ন না করে সে দিকেই ছুটে চলে। সেই বিশেষ পাল থেকে যারা বেরিয়ে আসে বা আসতে চায় তাদের নামটি বুদ্ধিজীবী অথবা সুশীলসমাজের তালিকা থেকে কাটা পড়ে যায়। এমন নির্বুদ্ধিতার মাশুল এই পালচ্যুতদেরকে চড়া দামে আদায় করতে হয়। এই সুশীল বুদ্ধিজীবীদের পালটি দেশ থেকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে নির্বাসিত করে বাকশাল ও জঙ্গলের শাসন সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছে। গত ৪০-৪৫ বছরব্যাপী নাগ-নাগিণি নৃত্যের মাধ্যমে ১৫ কোটি মুসলমানের সন্তানকে এরা পুরাপুরি টোঁড়া সাপ বানিয়ে ফেলেছে। এখন এর ফসলটি ঘরে তুলতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা খুব বেশি দেরি করছেন না। তিনি ধার্মিক মুসলমানদের সবাইকে সৌদি আরব চলে যেতে বলেছেন। আলামত দেখে মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত এই দেশটিতে একদিন ফ্রিজে গরুর গোশত পাওয়ার অপরাধে আখলাকের মতো পরকালে না হলেও কমপক্ষে সৌদি আরবে যেতে হবে।

১৯৪৭ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দুই দু’বারের স্বাধীনতা অর্জনসহ পূর্ব বাংলার চাষাভুষার সন্তানদের যতটুকু ভূরাজনৈতিক অর্জন অর্জিত হয়েছিল, আজ একটি দলের চিরদিন ক্ষমতায় থাকার খায়েশে সবই তাদের চরণে উৎসর্গিত হয়েছে। মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ এই ভূখণ্ডে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই হুমকিটি দিয়ে সাম্প্রদায়িক বলে তিরস্কৃত হননি, কিন্তু যে বা যিনিই তার সেই কথাটি নিরামিষভাবেও উল্লেখ করতে যাবেন তিনিই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বলে গণ্য হবেন। কাজেই এ দেশের বুদ্ধিজীবীর পাল এ ব্যাপারে পিনপতন নিস্তব্ধতা পালন করবে।

কাজেই চিত্তটি একটু বেশিমাত্রায় শক্ত না হলে কারো পক্ষে এই দল থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমনই সাহস দেখিয়েছেন যায়যায়দিন খ্যাত সাংবাদিক ও বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান। এই ঘরানার অন্যদের যেমন করে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, নব্য রাজাকার, জঙ্গি এ ধরনের কিছু না কিছু উপাধি ধরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে, শফিক রেহমানের বেলায় সেই ফর্মুলাটি তেমনভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কাজেই এই বিশেষ বলয়টি শফিক রেহমানের প্রতি একটু অতিরিক্ত ক্রোধ পোষণ করেন। তাদের সেই ক্রোধের সাথে গাফফার চৌধুরীর মনে যোগ হয়েছে শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও পেশাগত ঈর্ষা। গাফফার চৌধুরীর মতে, আগে শফিক রেহমানের অনেক খ্যাতি ছিল, এখন আর নেই। আগে বেগম খালেদা জিয়ার দরবারে বেশ কদর ছিল, এখন তা-ও কমে গেছে। এই ধরনের ঈর্ষাযুক্ত শব্দে ভরপুর থাকে সাবেক বন্ধু শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে তার প্রতিটা লেখা। কিন্তু যেকোনো অনলাইন পত্রিকায় শফিক রেহমান এবং তার নিজের লেখার ওপরে পাঠক প্রতিক্রিয়া দেখলেই দু’জনের পাঠকপ্রিয়তা পরিমাপ যে কেউ করতে পারেন।

বন্ধু শফিক রেহমানের প্রতি গাফফার চৌধুরীর ঈর্ষান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গাফ্ফার চৌধুরী বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে জামায়াতে ইসলামের একটি মেসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কাজেই অনুমিত হয় যে, আশ্রয়দাতাকে খুশি করার জন্য বেশি বেশি জিহাদি (!) বই নাড়াচাড়া করতেন। সেই একই সময়ে শফিক রেহমান তার বিখ্যাত বাবা প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের বাসায় থেকে লন্ডন বা আমেরিকার কোনো বিখ্যাত ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতেন।

ঢাকায় এসে যাদের নুন প্রথম খেয়েছেন, আজ তাদের ফাঁসির জন্যই কোমর বেঁধে লেগে গেছেন গাফফার চৌধুরী। আবার এখন যাদের নুন খাচ্ছেন সেই পশ্চিমা চিন্তাধারা বা ভাবনার কাছাকাছিও তিনি যেতে পারছেন না। বরং সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই যিনি এ দেশে আধুনিকতা ও মানবিকতার অ্যান্টেনাটি যুগপৎ বহন করেছেন সেই চির তরুণ শফিক রেহমানের মানবিক আন্দোলনটিকে কালিমা লিপ্ত করার প্রয়াস পাচ্ছেন।

এই ক্ষুদ্র গবেষণার স্বার্থেই এই দুই ব্যক্তিত্বের মানসিক কাঠামো গঠনে তাদের আশপাশের পরিবেশটুকু একটু আলোচনায় টানতে হয়েছে। দেখা যায় একসময়ে খুবই নিরীহ, অন্যের অনুগ্রহপ্রাপ্ত মানুষই পরবর্তী সময়ে নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শফিক রেহমান এবং গাফফার চৌধুরীর দিকে তাকালে বিষয়টির সত্যতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

লেখালেখি না করলে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট শফিক রেহমানের জন্য পৃথিবীর যেকোনো দেশে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনে কোনো অসুবিধে হতো না। কারণ তার বিখ্যাত বাবা প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান তাকে লন্ডন থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পাস করিয়ে আনেন। ১৯৬৭ সালেই তিনি হোটেল সোনারগাঁওয়ে চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শফিক রেহমান প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক উভয় মিডিয়ায় তার প্রতিভা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

অন্য দিকে জীবনের অর্ধেক সময়ে পশ্চিমা আলোবাতাসে কাটালেও সেই ধরনের কোনো বাতাস জনাব গাফফারের মনে প্রাণে লেগেছে বলে মনে হয় না। তাকে দেখে রবি ঠাকুরের সেই কবিতাটি সামান্য পরিবর্তন করে বলতে হয়, ‘তব আলো বাতাসে আশ্রয় দিয়েছো ওহে ব্রিটিশ-জননী/রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’

ব্রিটিশ রাজ আলোবাতাস দিলেও এই ৪০ বছর তিনি কী খেয়ে কাটিয়েছেন, তা-ও বড় একটা প্রশ্ন। কারণ ১৯৭৬ সালের পর তার কোনো চাকরি বা ব্যবসার খবর তার বায়োডাটায় দেখা যায়নি। বরিশালের এক জমিদার পরিবারের কাছ থেকে চৌধুরী উপাধিটি গ্রহণ করলেও সেই জমিদার পরিবার থেকে কোনো সম্পদ নাকি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে নিতে পারেননি। তার পরেও তিনি লন্ডনে পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকটা জমিদারের মতোই (কোনো কামকাজ না করে) জীবন কাটিয়েছেন। কাজেই যেখান থেকেই আসুক না কেন, এটা সত্য যে তাকে একধরনের করুণার অর্থে তার জীবনটি অতিবাহিত করতে হয়েছে। ফলে তার সামগ্রিক মনোজগৎটি সেভাবেই গড়ে উঠেছে।

‘তুম্বি কাঁঠাল খায়া’ গল্পের মতো তিনিও মনে করেন যে, শফিক রেহমান জামায়াতের কাছ থেকে তেমনি কোনো খয়রাতের বিনিময়ে তার মৃত্যুদণ্ডবিরোধী ক্যাম্পেইনটি শুরু করেছেন। মানবিকতার স্পর্শের বাইরে যদি টাকা দিয়েই এসব করতে হতো, তবে জামায়াত শফিক রেহমান নয়, সম্ভবত গাফফার চৌধুরীর কাছেই আগে যেত। সত্য বললে কে উপকৃত হবে, এই গণনা বা ভয় থেকে কোনো সত্যের পূজারি তার সত্য উচ্চারণ থেকে বিরত হন না। সত্যের এই স্বাদটি আহরণ বা উপলব্ধি করা এসব গাফফারের ভাগ্যে কখনোই জোটে না।