Religion’s turbine sometimes rotate without any wind

ধর্মের কল বাতাস ছাড়াও নড়ে

সবাই জানি যে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। কিন্তু কখনো কোনো কারণে বাতাস না পেলে ধর্মের সেই কলটি বাতাস ছাড়াও নড়ে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, প্রধানমন্ত্রীর ফার্স্ট কাজিন এবং বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগিনা শেখ সেলিমকে বিএনপি ও জামায়াত প্রয়োজনীয় বাতাসটুকু সরবরাহ করেছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। একইভাবে তিনি নিজ বংশের ওপর এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে ষড়যন্ত্র করবেন, জেনারেল শফিউল্লাহর সেই পাল্টা অভিযোগটিও কোনো সুস্থ বিবেকবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষ মেনে নেবে না। শেখ সেলিম ও শফিউল্লাহর মধ্যকার এ বাহাসটির প্রতি একধরনের কৌতুক মিশ্রিত কৌতূহল থাকলেও এটাকে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কিন্তু দেশবাসীর মনোযোগ পড়ছে শেখ সেলিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং ইনুর নেতৃত্বে জাসদের মধ্যকার বিতর্কটির ওপর।

শেখ সেলিমসহ আরো বেশ কয়েকজন নেতা বঙ্গবন্ধুকে খুন করার জন্য পরিবেশটি সৃষ্টির জন্য জাসদকে অভিযুক্ত করেছেন। তার পাল্টা হিসেবে ইনু জানিয়েছেন, জাতীয় চার নেতা ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গঠিত খন্দকার মোশতাক সরকারে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু জাসদের কোনো নেতাকর্মী সেই সরকারে যোগ দেননি। জাসদের কোনো নেতা মোশতাকের সাথে হাত মেলাননি। কারা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন তা আপনারা জানেন।

জাসদ সম্পর্কে শেখ সেলিম ও আওয়ামী নেতাদের কথা যেমন সত্য, তেমনি আওয়ামী নেতাদের সম্পর্কে ইনুর কথাটিও সমপরিমাণে সত্য। এ বিষয়টি নিয়ে গত বছর একটি কলাম লিখেছিলাম। সেই লেখার বিষয়বস্তু পাঠকদের কেউ কেউ তখন মেনে নিতে পারেননি। ইনু-শেখ সেলিমদের সাম্প্রতিক বিতর্কের পর আমার সেই যুক্তিগুলো সেসব পাঠকের কাছে আরেকটু গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হচ্ছে। ‘বেনিফিশিয়ারি মাত্রই হত্যাকারী নয়’ শিরোনামের সেই লেখাটিই আবারো পাঠকদের খেদমতে তুলে ধরা হলো।

সকল হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারী সেই হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি হলেও সকল বেনিফিশিয়ারি হত্যাকারী নয়। অনেকে বেনিফিশিয়ারি হন পরিবারের উত্তরাধিকারের হাত ধরে। অনেককেই আসতে হয় (দেশের স্বার্থে) নিহত ব্যক্তির শূন্যস্থান পূরণ করার নিমিত্তে। বেনিফিশিয়ারি মাত্রই ষড়যন্ত্রকারী- এ ধরনের সহজ ফর্মুলা শুধু ভয়ঙ্করভাবে ত্রুটিপূর্ণই নয়, নির্মম ও নিষ্ঠুরও বটে।

পৃথিবীতে সিংহাসন লাভের নিমিত্তে ভাই ভাইকে খুন করেছে, সন্তান পিতাকে খুন করেছে- এ রকম উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। সিরাজউদ্দৌলাকে তার মায়ের আপন বোনসহ নিকটাত্মীয়রাই ষড়যন্ত্র করে সিংহাসনচ্যুত ও হত্যা করেছিলেন। নেপালের এক রাজপুত্র এই সে দিন নিজের বাবা-মাসহ আরো অনেককে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। নিজের সন্তানকে চক্রান্ত করে হত্যার জন্য কেউ কেউ ইন্দিরা গান্ধীকেও সন্দেহ করেন। এমনকি নিজের মাকে হত্যা করার জন্য এর বেনিফিশিয়ারি হিসেবে রাজিব গান্ধীকেও সন্দেহের আওতার বাইরে রাখা হয়নি।

শেখ মুজিব ও তার তিন ছেলে বেঁচে থাকলে আর যাই হোক শেখ হাসিনা এবং তার রক্তের ধারা জয়-পুতুল কখনোই ক্ষমতার লাইন বরাবর আসতে পারতেন না; বরং শেখ কামাল অথবা শেখ জামালের রক্তের ধারা এই লাইনে চলে আসত। তখন সরকারপ্রধান হিসেবে জুনিয়র শেখ কামাল সংসদে বা জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে নিকটাত্মীয়দের যে তালিকা পেশ করতেন, কারা থাকত? শেখ হাসিনা তার নিকটাত্মীয়ের লিস্ট ঘোষণা করায় আজ শেখ সেলিম ও শেখ হেলাল প্রমুখ শেখগণ অপ্রস্তুত হয়েছেন বা মনের কোনায় ব্যথা পেয়েছেন।

মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের মানসিকতাসম্পন্ন শেখ মুজিব তার মেয়েকে কখনোই রাজনৈতিক জগতে আনতে চাননি। যত দূর সম্ভব লেখাপড়া শিখিয়ে সুপাত্রে পাত্রস্থ করেছেন। দেশ চালানোর জন্য তিনি নিজ হাতে যে তরুণদের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তৈরি করেছিলেন, তাদের অনেকেই বিয়ের উপযুক্ত থাকলেও এই রতœদের কারো হাতে নিজের মেয়েকে সোপর্দ করতে সাহস করেননি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা ছাত্রের কাছে। আজকে দেশটির করুণ অবস্থার কারণ সম্ভবত আমাদের এই অদ্ভুত মানসিকতা। যাদের হাতে দেশ ছেড়ে দিই, তাদের হাতে নিজের মেয়েকে ছেড়ে দিতে ভয় পাই!
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জিয়া মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। তা না হলে তাকেও (মুজিব হত্যায়) আসামি করতেন।
অথচ ইতিহাস বলে যে, ক্ষমতা তিনি (শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া) দখল করেননি। ক্ষমতা তার ওপর অর্পিত হয়েছিল। নান্দনিক ভাব ও ভাবনায় বলা যায়- তিনি ক্ষমতার প্রেমে পড়েননি, সেই প্রেম তার ওপর পড়েছিল।

১৫ আগস্টের সেই ঘটনার সময় তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বা সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। তখনকার সেনাপ্রধান যিনি তার কমান্ডার ইন চিফ নিজের বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে নিজে এগিয়ে না গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসার পরামর্শ রেখেছিলেন। এই সেনাপ্রধান মোশতাক ডাকিবা মাত্র অন্য দুই বাহিনী প্রধানসহ বঙ্গভবনে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। রক্ষীবাহিনীর রাজনৈতিক প্রধান তোফায়েল আহমেদসহ অন্যরাও নিজেদের রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই রক্ষীবাহিনী নৈতিকভাবে এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে, প্রয়োজনের মুহূর্তে একটা গুলিও ছুড়তে পারেনি।

চতুর মোশতাক বুঝেছিলেন, চরম অস্থিতিশীল মুহূর্তে কোনো বখতিয়ার খিলজি এগিয়ে এলে এই অথর্ব ও অদক্ষ সেনাপ্রধান তাকেও লক্ষণ সেনের মতো পেছনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এ ধরনের বিবেচনা বা গণনা থেকে তাকে বাদ দিলে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে জিয়া সেনাপ্রধান হয়ে পড়েন। তাকে (জিয়াকে) বিশেষ বিবেচনায় কাউকে ডিঙিয়ে নিচ থেকে ওপরে তুলে আনা হয়নি।

সেই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি বিশেষ দরদ পোষণ করা গান্ধীবাদী লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ তার একটি লেখায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে ১৫ আগস্টের পরের দিন বঙ্গভবনের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। মাত্র চার-পাঁচজন ছাড়া শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার সব সদস্যই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্যদের যিনি শপথ পাঠ করিয়েছিলেন, সেই এইচ টি ইমাম আজ প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীও মোশতাকের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। বর্তমান মন্ত্রিসভার কেউ কেউ সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের ওপর উঠে নেচেছিলেন। লন্ডন শহরটি ফারুক-রশিদের বন্দুকের নলের আওতার অনেক বাইরে ছিল। সেখানে বসে মালেক উকিল কী বলে এসেছিলেন, তা সবার জানা।
যারা সরাসরি এই হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অনেকের ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। তাদের সবার চেহারা ও পরিচিতি স্পষ্ট। তবে পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগের ভেতরের বড় একটা অংশ জড়িত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৫ আগস্টের হত্যার পরের দিন ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রদূত সমর সেন খোন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করেন। মুজিব হত্যার মাত্র কয়েক দিন পর মোশতাকের সাথে হাস্যবদনরত সেই ছবি দেখলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। এসবের মাঝে কোথাও আমরা জিয়াকে খুঁজে পাইনি। ওপরে যেসব ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে ( এইচ টি ইমাম, মালেক উকিল বা এম এ জি ওসমানী) তাদের সমপরিমাণ সম্পৃক্ততা বা দোষেও জিয়াকে অভিযুক্ত করা সম্ভব নয়।

যে সামরিক শাসনের ব্যাপারে তাকে অভিযুক্ত করা হয়, সেই সামরিক শাসন জারি করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক। এ জন্য জিয়াকে দোষারোপ করা যায় না। খুব বেশি হলে বলা যায়, জিয়া আমাদের ইতিহাসের এমন এক বরপুত্র, যার জন্য সব সময় সব কিছু যেন প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি শুধু সঠিক সময়ে সঠিক ভূমিকাটিই রেখে গেছেন।

তিনি (জিয়া) দেখলেন, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশটি দেশী-বিদেশী চক্রান্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ছে। জাহাজের তখনকার নেভিগেটরদের (সবাই আওয়ামী নেতা) পারস্পরিক কোন্দলে দেশরূপী জাহাজটি ক্রমান্বয়ে ডুবে যাচ্ছে। তিনি দেখলেন যে, এ অবস্থায় জাহাজের হাল না ধরলে জাহাজটি পাইরেটদের দখলেও চলে যেতে পারে। তাই এ জাহাজটি উদ্ধারের দায়িত্ব সিপাহি-জনতা যখন তার ওপর অর্পণ করেন, তখন তিনি পিছিয়ে থাকেননি। অপরাধ হলে এটিই তার একমাত্র অপরাধ।
তিনি যদি তখন পিছিয়ে থাকতেন বা দায়িত্ব নিতে গড়িমসি করতেন, তাহলে এই দেশরূপী জাহাজটি তখন সত্যিই ডুবে যেত অথবা তখনই অন্য একটি দেশের করদরাজ্যে পরিণত হয়ে পড়ত।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়ার ঘোষণা না এলে পাকিস্তানের হাত থেকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন হয়ে পড়ত তেমনি ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে জিয়ার এই ভূমিকা না থাকলে অন্য একটি দেশের লোলুপ দৃষ্টি থেকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ত।

কাজেই কোনো বিবেচনাতেই জিয়া ষড়যন্ত্রকারী নন, তিনি উদ্ধারকারী। তার এই কাজের প্রকৃত বেনিফিশিয়ারি এ দেশ ও দেশবাসী।
শাহজালাল, শাহ মাখদুম, শাহ পরানসহ শত শত পীর-দরবেশের পদধূলিতে পুণ্যময় হয়ে ওঠা এ ভূখণ্ডটির প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে, এসব ঘটনা তাই প্রমাণ করে। আমাদের কিছু পাপ ও ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহ তায়ালা মাঝে মধ্যে কিছু শাস্তি দেবেন, কিন্তু এ দেশ ও জাতিকে কখনোই ধ্বংস করে দেবেন না।
কাজেই এখন যে আঁধার দেখা যাচ্ছে, তাও অচিরেই কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে।