Minar Rashid – ফাদার, বায়োলজিকেল ফাদার এবং জাতির ভ্রান্তি 

ফাদার, বায়োলজিকেল ফাদার এবং জাতির ভ্রান্তি
=============================
( দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় কলাম )
১.
ফাদারের আগে বায়োলজিক্যাল শব্দটির ব্যবহার পশ্চিমা দেশগুলোতেই বেশি দেখা যায়। ওসব দেশে একজন জন্ম প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার কারণে ফাদার, অন্যজন কর্মের কারণে ফাদার হয়। অধিকাংশ সময় মাকেই ফাদারের এই কাজটি করতে হয়। ভোগবাদী এসব সমাজে নারী-পুরুষের ভোগের এই দায়টুকু নারীর কাঁধেই বেশি চাপে।
আধুনিক সভ্যতা নারীদের এক সোনার খাঁচায় বন্দী করে ফেলেছে। অন্য দিকে দরিদ্রতা, কুসংস্কার নারীদের বন্দী করেছে অন্য খাঁচায়। একটা মজার ব্যাপার হলো, আমরা যেমন ওসব দেশের নারীদের এই কিছিমের দুর্গতি নিয়ে হাহুতাশ করি, তেমনি নদীর ওই পারের বিবেকবান পুরুষেরা আমাদের নারীদের দুর্গতি নিয়ে হাহুতাশ করে। আমরা (নদীর এপার ওপার উভয়েই) কেউ নিজেদের নারীদের দিকে তাকাই না বা তাদের দুর্দশা লাঘবের চিন্তা করি না। এটাই মানবজাতির অন্যতম প্রধান সমস্যা। যাদের দরদে কাজ হবে তারা দরদ দেখাই না।
আগে আমাদের সমস্যা ছিল একমুখী। এখন আমাদের নারীরা উভয় খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়ছে। আগে আমাদের দেশে গড়পরতা প্রতিটি বায়োলজিক্যাল ফাদারই সত্যিকারের ফাদার হতেন। এই দুটোতে আমাদের সমাজে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। ইদানীং এই পার্থক্য চোখে পড়া শুরু হয়েছে।
বায়োলজিক্যাল ফাদার হতে তেমন শ্রম বা কষ্ট লাগে না; কিন্তু প্রকৃত ফাদার বা দায়িত্ববান পিতা হতে সেটা লাগে। কথাটি যেমন একজন ব্যক্তির বেলায় প্রযোজ্য, তেমনি বৃহত্তর পরিসরে একটি জাতির জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।

বাবা নামক প্রতিষ্ঠানটির সাথে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির একটা সুন্দর মিল রয়েছে। একজন দায়িত্ববান পিতার মতোই একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র তার জনগণকে দেখভাল করে থাকে। অর্থাৎ একজন মানুষের জন্য প্রথম বটগাছ তার বাবা। পরের বটগাছ তার রাষ্ট্র। একজন ব্যর্থ মানুষ তার নিজের জীবনের ব্যর্থতার জন্য এই দু’টি প্রতিষ্ঠানকেই দায়ী করে। ভুল জীবন দর্শনে তাড়িত হয়ে আমরা যেমন ব্যর্থ বাবা তৈরি করছি, তেমনি ভুল দর্শন এবং ডিফেক্টিভ চেতনায় তাড়িত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র তৈরি করছি।
সেই বোধ বা ভাবনা থেকেই জাতির পিতা বা ফাদার অব দা নেশন শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। হতভাগা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন বায়োলজিক্যাল ফাদার আলাদা হয়ে পড়তে পারে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে একটি জাতির ক্ষেত্রেও সেই পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।

২.
আমার এক ব্যাচমেটের করুণ কাহিনী দিয়ে ব্যক্তি পরিসরের আলোচনাটি শুরু করছি। আশা করি এটি আমাদের পুরো সমাজের জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ হবে। বন্ধুটি ছিল আসলে একজন জটিল মানসিক রোগী। তবে এক বাক্যের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমাদের বাকি ৪৫ জন ব্যাচমেটের লেগে গেছে দুই যুগ। কাদম্বিনী যেমন মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল, সে আগে মরে নাই। অনেকটা একই কিছিমে দুই যুগ পরে বন্ধুবান্ধবদের কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, সে একজন মানসিক রোগী ছিল। সবচেয়ে মুশকিলের বিষয় ছিল, সে নিজেও এটি স্বীকার করতে চাইত না। আমাদের সবার কাছে সে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রব। এই জটিলতার মাঝেও দু’জন বৃহৎ হৃদয়ের বন্ধু তাকে আগলে রেখে আমাদের বাদবাকিদের চক্ষু খুলে দিয়েছে।

আশির দশকের মাঝখানে মেরিন অ্যাকাডেমিতে চান্স পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বিভিন্ন বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া বা কাছাকাছি মানের ছেলেরাই মেরিন অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতেন। আমার এই বন্ধুটি নিঃসন্দেহে সেসব ভাগ্যবানেরই একজন ছিলেন।

ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় এবং আরো কিছু পারিবারিক বিপর্যয়ে তার মনোজগতটিতে এক বিশেষ ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষত তার আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি করেছিল। তখন তার মধ্যে হালকা অস্বাভাবিকতা দেখা গেলেও এটা নিয়ে কেউ তেমন গা করত না। কারণ এ ধরনের অস্বাভাবিকতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। অ্যাকাডেমিতে থাকা অবস্থায় সিনিয়র বা ব্যাচমেট এবং জাহাজে কয়েক বছর সেইলিংকালীন সময়ে সিনিয়র অফিসারেরা এগুলো তার ‘বাজে ব্যবহার’ বা ‘অশালীন আচরণ’ হিসেবে ধরে নিতেন।

তবে একজন সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, এর সব বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। গায়ের রঙ ফর্সা, শারীরিক ও মুখের গঠন চমৎকার, উচ্চতা ৬ ফুটের কাছাকাছি। অনেকটা নেভি সিগারেটের বিজ্ঞাপনের মতো। তারপর আবার খাঁটি সৈয়দ বংশের ছেলে। মার্চেন্ট নেভির এমন পাত্রের জন্য নব্বই দশকের প্রথমভাগে এ দেশে পাত্রীর অভাব ছিল না। ফলে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ডাক্তার মেয়েকে সহজেই বিয়ে করে ফেলে। মেয়ের বাবা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। দায়িত্বশীল বাবা হিসেবে মেয়ের জন্য একটি অপাত্র ঠিক করেছেন- বাহ্যদৃষ্টিতে তা বলা যাবে না।
কিন্তু বিয়ের পর টের পান, কী মারাত্মক গলদটি করেছেন। আগেই বলেছি, তার এই রোগটি আসলেই ভয়াবহ, যা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার আগেই মানুষকে বিরক্ত করে ফেলে।
তবে শ্বশুরবাড়ির লোকজন যতটুকু দেখেছেন, ব্যাচমেইট হিসেবে আমাদের পক্ষে ততটুকু দেখা বা জানা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সে কারো সাথে তেমন মিশত না কিংবা তার সাথে কেউ তেমন করে মিশতে চাইত না।

সেই ১৯৮৮-৮৯ সালের পরে আমার সাথেও তার আর দেখা হয়নি। যদিও জাহাজে অবস্থানকালে কয়েক দিন আমার বাসায় এসে সারা দিন কাটিয়েছে। স্বাভাবিক মানুষের মতোই বাসার অন্যদের সাথে গল্প করেছে, খেয়েছে। আমার ছেলেকে দেখে বলেছে, ‘আরে এ তো দেখি একদম বাপের মতোই হাঁটে’। ‘তার সম্পর্কে যেহেতু আগে থেকেই জানা আছে, আপদ তাড়ানোর নিমিত্তে সন্ধ্যার আগে আগে আমার স্ত্রী বললেন, ‘ভাই, আমি তো একটু বাইরে বের হবো। আপনি কী করবেন?’ তখন জবাব দেয়, ‘কোথায় যাবেন ভাবী? চলেন, আমিও সাথে যাই’।

এটা ছিল তার মোটামুটি মাইল্ড কিছিমের উপদ্রব। তার কিছু হিট উপদ্রবের কাহিনীও বন্ধু মহলে ছড়িয়ে আছে।

দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভালো একটি পেশায় আসা সত্ত্বেও মূল ধারা থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে বন্ধু-বান্ধব, জুনিয়র সিনিয়রদের কাছে ধারদেনা করতে গিয়ে অতি অল্প দিনেই সে সবার অতি অপ্রিয় পাত্র হয়ে পড়ে। তার এ ধরনের ভিক্টিম বা শিকারদের মধ্যে ব্যাচমেট তো রয়েছেই, আশপাশের ব্যাচের জুনিয়র-সিনিয়ররাও বাদ পড়েননি।
বন্ধু-বান্ধব চেনা-জানা জুনিয়র-সিনিয়র সবাইকেই এভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। কাউকে কাউকে এত জ্বালিয়েছে যে, আমরা বন্ধুরা সম্মিলিত উদ্যোগে যখনই কিছু করতে চেয়েছি, তার সেসব ভিক্টিম মারাত্মক ভেটো দিয়ে বসত। ফলে আমাদের নেয়া সেই ২০০০ সালের পরপর আগের অনেক উদ্যোগ বিফলে গেছে।

বন্ধু-বান্ধব সবাই জাহাজের চাকরি ও নিজ নিজ প্রফেশন এবং ছুটিতে এসে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সেই সময় এখনকার মতো ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসআপ ছিল না। আমাদের পক্ষে এত সবের খবর নেয়া সম্ভব ছিল না। শুধু বিভিন্নজনের কাছে তার কীর্তি কাহিনী শুনতে পেতাম, আর আফসোস করতাম।

নিঃসন্দেহে এই উপদ্রবের বেশি শিকার হয়েছে তার স্ত্রী এবং পরিবার। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের হলেও তার নিজের আত্মীয়স্বজন আজব কারণে এগিয়ে আসেননি। বরং এই আপদ শেষ হলে তার পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে, কোনো কোনো নিকটজনের মধ্যে এ ভাবনাটি কাজ করেছে বলে আমাদের পরবর্তী রুট কজ অ্যানালাইসিসে বেরিয়ে এসেছে। এমন হতভাগা আসলেই কম আছে। একজন রোগী ‘ক্রিমিনাল’ সাব্যস্ত হয়েছে।

যা হোক, প্রায় দুই যুগ পরে আমাদের মেজরিটি বন্ধু-বান্ধব ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হই যে, ওর সমস্যাটা মানসিক- সে ক্রিমিনাল বা ধান্ধাবাজ নয়, যেভাবে এতদিন আমরা তাকে চিত্রিত করে এসেছি। বোধোদয়ের পরপরই সবাই একটা ফান্ড সংগ্রহ করে ঢাকার একটি আধুনিক হাসপাতাল থেকে ওর সুচিকিৎসা করাই। সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার এক বোনের জিম্মায় রেখে আমরা সব ব্যাচমেট এখন তার সার্বিক ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছি। ব্যাচমেটদের বড় অংশ এগিয়ে আসায় আশা করছি, বাকি জীবনে তার আর কোনো অসুবিধা হবে না। মোটামুটি কমফর্টেবল একটি লাইফ সে চালিয়ে যেতে পারবে। ওকে কেন্দ্র করে এখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়েছে। আমাদের সবার মধ্যে একটা কমন কনসার্নের জায়গা খুঁজে পেয়েছি।

তার এই উত্তরণে উৎসাহিত হয়ে মূল উদ্যোক্তাদের কয়েকজন জীবন সিনেমার বাকি অংশ চিত্রায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। অর্থাৎ তার ভূতপূর্ব স্ত্রী এবং সন্তানের সাথে পুনর্মিলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ব্যাচের দুইজন হিরো নিজ নিজ হিরোইনদের সাথে নিয়ে সেই বাসায় গিয়ে হাজির হন। সেখানে গিয়ে আমাদের এই হিরো হিরোইনেরা আসল বাস্তবতার সম্মুখীন হন। বুঝতে পারেন যে, জীবনটা সিনেমার মতো পাটিগণিতের নিয়ম মেনে চলে না- রূঢ় বাস্তবতার বীজগণিত মেনে চলে। ওই বাসা থেকে ফিরে হিরোদের একজন সাহিত্যিক হয়ে পড়েছেন। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে, যেন এক মৃত আগ্নেয়গিরিকে জ্বালিয়ে এসেছেন। ওই পরিবার জীবন থেকে এই অধ্যায় মুছে ফেলেছে। জীবন পাতার সেই অধ্যায়গুলো আর খুলতে চায় না।
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তালাক হলেও এই মহীয়সী নারী আর বিয়ে করেননি। একমাত্র ছেলেকে বুকে জড়িয়ে একাকিত্বের জীবন বেছে নিয়েছেন। চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর বন্ধুটির আরেকটি কুকীর্তির কথা জানতে পারি। বন্ধুটি আরেকটি জীবন শুরু করেছিল; কিন্তু মাত্র ২১ দিনের মাথায় সেটিরও যবনিকাপাত ঘটে।

জানি না, আমার এই লেখাটি সেই মহীয়সী নারীর নজরে পড়ে কিনা। এতদিন পর তাকে এভাবে বিব্রত করার জন্য আমাদের ব্যাচের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি জানি, আমার আজকের এই সহানুভূতি তার ও ছেলের জীবনে ফেলে আসা কষ্টের মুহূর্তগুলোকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। জীবনের বন্দুক থেকে বুলেট একবার ছুড়ে ফেললে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। ভুক্তভোগীর এই ব্যথা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা অর্থাৎ ব্যাচমেট হিসেবে যা করার প্রয়োজন ছিল সেই সামাজিক দায়িত্বটি পালনে এই ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আজকের এই যোগাযোগব্যবস্থা তখন থাকলে হয়তোবা পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। এই ঘটনাটি পুরো সমাজের অসুস্থতা নিরাময়ে কাজে লাগবে বলেই শুধু এই কলামে তুলে ধরছি। সামাজিক দায়িত্ব থেকে গা বাঁচিয়ে তো থাকিই- অধিকন্তু পরচর্র্চা করে ভিক্টিমের জীবনকে বিষিয়ে তুলি। তার আশপাশে কারো আমার এই লেখাটি নজরে পড়লেও অনুরোধ, তাকে আর বিব্রত করবেন না। বরং মনে মনে একটা স্যালুট দেন।
আমার হতভাগা বন্ধুর প্রতি তার সাবেক স্ত্রী কিংবা বায়োলজিক্যাল সন্তানের সহানুভূতি জাগাতে বিষয়টি উল্লেখ করেছি, এরকম ভাবলে আমার উদ্দেশ্যের প্রতি চরম অবিচার করা হবে। বরং সেই সন্তানের প্রতি আমার উপদেশ, বাবা! এই মায়ের সামান্য কষ্টের কারণ হয়- এমন কিছু করো না। ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি এই অসুস্থ সমাজকে সুস্থ করার জন্য কিছু কাজ করো।’
চার পাশের সমাজ তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে আমাদের এই হতভাগা বন্ধুটি তার ডাক্তার স্ত্রী ও ডাক্তার ছেলে নিয়ে অত্যন্ত সুখী ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন কাটাতে পারত। অসুস্থ থাকা অবস্থায় আমার এই হতভাগা বন্ধুটি যতটুকু স্বস্তিতে ছিল, আজ সুস্থ হওয়ার পর সেটুকু থাকে কিনা- তা নিয়েও সঙ্গত কারণেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

৩.
মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের বায়োলজিক্যাল ফাদার। অর্থাৎ তারাই এই দেশটির জন্ম দিয়েছেন। জন্মদানের পর বাকি কাজটুকু করা তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই দায়িত্ব চেপেছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এখন প্রশ্ন, আমরা শুধু তাদের বায়োলজিক্যাল ফাদারস হিসেবে রাখব নাকি প্রকৃত ফাদারস বানাব? কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবহার করেই এই জাতিকে আমরা পঙ্গু বানাচ্ছি, স্বাধীনতার চেতনা দিয়েই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে জব্দ করে ফেলেছি !

যে উদ্দেশ্যে তারা এই দেশটির জন্ম দিয়েছেন সেই উদ্দেশ্য থেকে আমরা শুধু দূরে নই, তার পুরো বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছি। এটি আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হচ্ছে। একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র থেকে পাঁচটি স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় আমরা স্থান করে নিয়েছি। এটি তো মিথ্যা নয়, সামান্য অনুভূতিসম্পন্ন যে কেউ এর সত্যতা উপলব্ধি করবে, চাক্ষুষ দেখবে।
নাম না জানা, অস্তিত্বহীন বা কাল্পনিক প্রতিষ্ঠানের ততোধিক অবাস্তব প্রশংসা নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন, আর বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর শত শত উদ্বেগ ও তাদের মূল্যায়নকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। এদের কাউকে অপ্রিয় সত্য বলার জন্য ‘গোলামের পুত’ বলে গালি দিচ্ছেন।

দেশের মধ্যে কোটা সিস্টেম বাতিলের জন্য যে যৌক্তিক দাবি উঠেছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর এক ধমকেই থেমে গেছে বলে মালুম হচ্ছে। সমাজের অবহেলিত অংশকে টেনে তুলতে যে কোটা সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল, তা আজ পুরো জাতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বা সর্বোচ্চ দুই প্রজন্মকে এই বিশেষ সুবিধা দেয়া যেতে পারে।

কোটা সিস্টেম কখনোই চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। এর মাধ্যমে পুরো জাতিকে পঙ্গু করার একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোটা কখনোই দশ ভাগের ওপর থাকা ঠিক নয়। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে মতলববাজেরাই বেশি উপকৃত হয়। দেশের সর্বনাশ যা হওয়ার তাতো প্রত্যক্ষ করছি সবাই।

পুলিশ সদস্যদের অনেকে ইউনিফর্ম পরে যেভাবে রাস্তায় নর্তন-কুর্দন করেন, যেভাবে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য দেন, তা দেখে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই পুলিশ দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের প্যাদানি দেয়া যত সহজ, অসহায় ধর্ষিতা সীমাদের রক্ষা করা ততই কঠিন।

এসব কারণেই দরকার গণতন্ত্রের। যেখানে প্রধানমন্ত্রী জনগণের কথা শুনবেন, প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়ে জনগণ চুপ মেরে যাবে না। এটাই ছিল এ দেশের বায়োলজিক্যাল ফাদারদের স্বপ্ন। একটি রোগ যেমন আমার এই হতভাগা বন্ধুকে প্রকৃত ফাদার হতে বাধা দিয়েছে, তেমনি ‘চেতনা’ নামের একটি রোগ জাতির বায়োলজিক্যাল ফাদারদের প্রকৃত ফাদার হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে পড়েছে।
একই কথা মনে হয় ফাদার অব দা নেশন বা জাতির পিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি যেমন সুপুত্রের পিতা তেমনি কুপুত্রের পিতাও বটে। তাকে শুধু আওয়ামী লীগ কিংবা কিছু মতলববাজ বিরোধী দলের পিতা হিসেবেই রেখে দেয়া হয়েছে। বায়োলজিক্যাল ফাদার থেকে প্রকৃত ফাদার বানাতে কারা কারা প্রকৃত প্রতিবন্ধক তা ভেবে দেখা দরকার। বর্তমান কৌশলগত রাজনৈতিক ঐক্য, মতলব বা সুবিধা অপসারিত হলে কিংবা অবস্থা প্রতিকূলে গেলে তারাই আবার জাতির পিতাকে ‘হেয় করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ- সেই লক্ষণই ফুটে উঠেছে। বেগম জিয়াকে যে মতলববাজেরা বেশি গালিগালাজ করে, সেই তিনারাই একদিন বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে কঠিন গালি দিয়েছে, সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা দিয়েছে।

জাতির পিতার প্রতি কিংবা জাতির প্রতি যাদের প্রকৃত দরদ রয়েছে, তারা কখনোই এই জাতিকে দুই ভাগ করতে পারতেন না। একক জাতিসত্তার চমৎকার এই জাতিটিকে একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ বা সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারতেন না। কথিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বা মুলা ঝুলিয়ে দেশটিকে চরম বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

আজ দৃষ্টি ফেলুন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার দিকে। একই সাথে আমার এই বন্ধুর উদাহরণটি সামনে আনুন। আজ থেকে বিশ বছর আগে এই মহৎ উদ্যোগটি নিলে একটি চমৎকার পরিবারকে আমরা রক্ষা করতে পারতাম; কিন্তু দেরিতে বোধোদয় হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। সিরিয়া বা ইরাকের জনগণের বোধ ফিরলেও আর তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না যা আমরা এখনো পারি। একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শুধু পড়ে পড়ে মার খাবে, এটা কখনোই ভাববেন না।

এই অবস্থা থেকে ফেরার রাস্তাটি আমাদের সম্মুখে জ্বল জ্বল করছে। সেটি হলো, ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের জন্য আলোচনার টেবিল। অতীতে সবার ভুল হয়েছে- এটি স্বীকার করতে হবে। কার ভুল কম আর কার বেশি এর হিসেব করতে গেলে আমরা এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারব না।

একজন অপরজনকে ক্ষমা করতে হবে। এখনো এই ক্ষমা করা আমাদের পক্ষে যতটুকু সহজ, সিরিয়া বা ইরাকের জনগণের পক্ষে তত সহজ নয়। বিষয়টি যতই কঠিন হোক, আমাদের তা করতেই হবে এবং এখনই। ষোলো-সতেরো কোটি মানুষ এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমাদের এটুকু পারতেই হবে।

যারা জাতির পিতাকে শুধু বায়োলজিক্যাল পিতা বানিয়ে রেখেছেন, তাদেরই দায়িত্ব তাকে সত্যিকার অর্থে জাতির সবার জন্য বটগাছ বা পিতা বানানো। সংবিধান, আইন কিংবা এ ধরনের কোনো কিছু দিয়ে এই কাজ সম্ভব নয়।

2 COMMENTS

Comments are closed.