Four massacres by the Grand Coalition government

মহাজোটের চার গণহত্যা

P1_mohajoter-char-gonohotta

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত চার বছরে চারটি বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে। এসব গণহত্যায় জীবন গেছে নিরীহ মানুষ, পোশাক শ্রমিক, আলেম, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ ও বিডিআর সদস্যদের। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে আলেম-ওলামাদের। রোববার মাঝ রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জিকিররত আলেমদের বুকে একযোগে গুলি চালিয়েছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। চারদিক
থেকে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার রাউন্ড গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে বিঁধতে থাকে আলেমদের বুকে। গুলিবিদ্ধ পাখির মতো রক্তাক্ত অসংখ্য আলেমকে পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তায়। আলেমদের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর তসবিহ রক্তে ভিজে চুবচুব করছিল। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। এত রক্ত ধুয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি কর্মচারীদের। আল্লাহ-রাসুল (সা.)-এর ইজ্জত রক্ষার দাবি নিয়ে এসে এসব আলেমকে জীবন দিতে হলো।
রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন পড়ে আছে অনেকের নিথর দেহ। আবার অনেকে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছিলেন সরকারি বাহিনীর কাছে। বাধার কারণে ছবি তুলতে পারেনি ফটোসাংবাদিকরা। দিগন্ত টিভি কিছু কিছু ফুটেজ সরাসরি দেখাচ্ছিল বলে চ্যালেনটি তাত্ক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হয়। একই কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় ইসলামিক টিভির সম্প্রচার।
কত লোককে হত্যা করা হয়েছে, সে হিসাব এখনও মেলেনি। হেফাজতের দাবি, শত শত আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান হত্যা করা হয়েছে। একই দাবি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সবাই একমত যে, মহাজোট সরকারের এ গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যাকেও হার মানিয়েছে।
এদিকে গত মার্চে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে তৌহিদি জনতা মিছিল বের করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একশ’রও বেশি মানুষকে হত্যা করে। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও বেদনাদায়ক ট্র্যাজেডি পিলখানা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি। এতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় ডেকে নিয়ে শত শত নিরীহ গার্মেন্ট শ্রমিককে ভবন ধসে হত্যা করা হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও চলছে এ উদ্ধারকাজ। নিখোঁজ রয়েছে সহস্রাধিক শ্রমিক।
বিডিআর হত্যাযজ্ঞ : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দেড় মাসের মাথায় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও বেদনাদায়ক ট্র্যাজেডি বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞ। এতে প্রাণ হারায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। সেদিনের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো। সেসব পরিবার আজও কাঁদছেন। কেন এ হত্যাযজ্ঞ, এর নেপথ্যে কারা ছিল—এসব প্রশ্নের জবাব ও ট্র্যাজেডির নেপথ্য রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৫১ জন সামরিক কর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন। আর ২০০৯ সালে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র দু’দিনের বিদ্রোহে পিলখানায় ৫৭ জন কর্মরত সেনা কর্মকর্তা, একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, দু’জন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর জওয়ান, পিলখানার বাইরে সেনাবাহিনীর এক সিপাহি, এক পুলিশ কনস্টেবল ও তিন পথচারী নিহত হন। ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার সুয়্যারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়েছিল ৩ সেনা কর্মকর্তার লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি মাটিচাপা অবস্থায় পাওয়া গেছে লাশের স্তূপ। অর্ধশত সাহসী ও নির্ভীক সেনা কর্মকর্তার সারি সারি লাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ।
দরবার হলের সিসিটিভি’র রেকর্ড থেকে পাওয়া তথ্য ও তদন্ত অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২ মিনিটে পিলখানার দরবার হলে বিডিআরের বার্ষিক দরবার শুরু হয়। দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন। সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে ডিজি বক্তব্য দেয়ার সময় মঞ্চের বাম দিক থেকে অস্ত্র হাতে দরবার হলে প্রবেশ করেছিল একজন সিপাহি। তার পিছু পিছু প্রবেশ করে আরও দুজন। তাদের একজন দরবার হলে প্রবেশ করে ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার এম এ বারী অপর কয়েকজন কর্মকর্তার সহায়তায় তাকে নিরস্ত্র করেন। এরই মধ্যে দরবার হল থেকে বেরিয়ে যায় অন্য দুজন সিপাহি। তখন সিপাহিদের কেউ একজন ‘জাগো’ বলে চিত্কার শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র হাতে নিতে থাকে। আর এভাবেই শুরু সশস্ত্র বিদ্রোহের। সকাল সাড়ে নয়টায় ডিজি মে. জে শাকিল আহমদ নিজে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন করে সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। কিন্তু তার কথায় কেউ সাড়া দেননি। বিদ্রোহীরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে অস্ত্রাগার লুট করে। সকাল সাড়ে দশটায় বিদ্রোহীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দরবার হলে প্রবেশ করে এবং কর্মকর্তাদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দেয়। ওই সময় ডিজিকে বৃত্তাকারে ঘিরে মানবপ্রাচীর তৈরি করে কর্মকর্তারা মঞ্চের পেছন দিক থেকে বেরিয়ে আসেন। আনুমানিক সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা সারিবদ্ধভাবে দরবার হল থেকে বেরিয়ে কয়েক সিঁড়ি নামামাত্রই মুখোশ পরা কিছু ব্যক্তি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তেই ঢলে পড়েন ডিজিসহ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। ১১টায় বিদ্রোহীরা গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। ১১টা নাগাদ সেনাবাহিনীর একটি দল বিডিআর ৪ নম্বর ফটকের কাছে অবস্থান নেয়। এ সময় বিদ্রোহীরা প্রায় ১৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বাইরে থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে লিফলেট ছুড়ে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বিদ্রোহীরা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করে এবং হেলিকপ্টারটিতে ৬টি গুলি লাগে। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে বিদ্রোহীদের পক্ষে ৩ নম্বর গেটে একটি মিছিল বের হয়। এতে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী। তার ছেলে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটনও বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্ন তদন্ত ও স্বীকারোক্তিতে পাওয়া গেছে। এ কারণে লেদার লিটনকেও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়। দুপুর ১২টার পর বিদ্রোহীরা প্রায় ২০ মিনিট এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিদ্রোহীরা মাইকে ঘোষণা দেয়, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একা পিলখানায় যেতে হবে।
জানা গেছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাদা পতাকা নিয়ে ৪ নম্বর গেটে যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সরকারি দলের হুইপ মির্জা আজম। বেলা ৩টায় প্রতিমন্ত্রী নানক, এমপি ফজলে নূর তাপস ও হুইপ মির্জা আজমের সঙ্গে ৪ নম্বর ফটকে অবস্থানরত জওয়ানরা কথা বলতে রাজি হয়। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে যায়। যমুনার ওই বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পিলখানার ভেতরে জওয়ানরা ট্যাঙ্কে করে টহল ও মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে। কিছুক্ষণ পরপর তারা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়ায়। বিদ্রোহ শুরুর পর কিছু ব্যক্তি সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা, লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে; বহু নারীর শ্লীলতাহানি ঘটায়। এ তাণ্ডবলীলা চলতে থাকে দু’দিন ধরে। এর মধ্যে ভয়ে বিভিন্ন স্থানে পরিচয় গোপন করে লুকিয়ে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করতে থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে যমুনা থেকে বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি দলকে নিয়ে পিলখানায় ফেরেন তিনি। সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্রোহীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে গেজেট আকারে প্রকাশ করার দাবি জানায় এবং একইভাবে গুলি ছুড়ে ভীতি ছড়াতে থাকে। সন্ধ্যার পর পিলখানার বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গর্ত খুঁড়ে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পিলখানায় যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাত দেড়টায় বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্রসমর্পণ করে। উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় চলতে থাকা পরদিন বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বিকাল সোয়া ৪টায় এক ডজনের বেশি ট্যাঙ্ক ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় পিলখানার আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকা থেকে সব লোককে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিকাল ৫টায় বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ শুরু করে এবং পিলখানা থেকে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শত শত বিডিআর জওয়ান পিলখানা থেকে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টায় সমর্পণ করা অস্ত্র বুঝে নিতে পিলখানায় পুলিশ প্রবেশ করে। পরদিন ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ নিহত ও নিখোঁজদের লাশের সন্ধান শুরু করে। পিলখানা হাসপাতালের মরচুয়ারির পূর্বপাশে গণকবর থেকে একসঙ্গে বের করে আনা হয় ৩৮ সেনা কর্মকর্তার লাশ। সারি সারি লাশ দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। স্বজনহারাদের আহাজারিতে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয় তিন দিনের শোক।
সাঈদীর ফাঁসির রায় পরবর্তী গণহত্যা : ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ। রাস্তায় নেমে আসেন আলেম-ওলামা ও সাঈদী ভক্তরা। বিক্ষুব্ধ সাঈদী ভক্তদের ওপর ইতিহাসের বর্বর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী। এ হত্যাযজ্ঞ চলে সপ্তাহজুড়ে। এ সময় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সাতক্ষীরায় ৮ জামায়াত-শিবির, ১ আ.লীগ কর্মী ও ১০ সাধারণ নাগরিকসহ ১৯ জন, বগুড়ায় ৭ জামায়াত-শিবির, ৩ মহিলা ও ১ শিশুসহ ১৪ জন, রংপুরে ১ পুলিশ সদস্যসহ ৯ জন, গাইবান্ধায় চার পুলিশ সদস্যসহ ৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ৩ সহ ৭ জন, জয়পুরহাটে ৬, নোয়াখালীতে বিএনপি ও যুবদলের ২ জনসহ ৪ জন, রাজশাহীর বাঘায় ১ ও গোদাগাড়ীতে ২ জনসহ মোট ৩, সিরাজগঞ্জে ২, কক্সবাজারে ৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ যুবলীগ কর্মীসহ ৪ জন, লোহাগাড়ায় ১ পুলিশ সদস্যসহ ২ জন, সাতকানিয়ায় ১ এলডিপি কর্মীসহ ৩ এবং মৌলভীবাজার, নাটোর, রাজধানীর মিরপুর, দিনাজপুর, বাঁশখালী, সোনাইমুড়ী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কেরানীগঞ্জ, নীলফামারী, হরিণাকুণ্ড, সেনবাগ ও উল্লাপাড়ায় ১ জনকে হত্যা করা হয়। এ সময়ের মধ্যে পাঁচ সহস্রাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত আরও ২০ সহস্রাধিক ব্যক্তি। আহতদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীতে মারা যান।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের নির্বিচার গুলিবর্ষণে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এছাড়া শাসক দলের যুবলীগ-ছাত্রলীগের তাণ্ডবেও হত্যার শিকার হন অনেকে। একইভাবে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির হরতাল চলাকালে সৃষ্ট সহিংসতায় পুলিশসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন।
স্বাধীনতার পর মাত্র ৭ দিনে এতো হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা একে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, স্বাধীনতার পর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ এটি। যদিও গত দু’দিনে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হামলা চালিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে নিহত পরিবারগুলোর করুণ চিত্র পাওয়া গেছে। পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে নিহতদের পরিবার। সেখানে চলছে মাতম। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নিহতরা পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় পরিবারগুলোতে অনেকেই এখন না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেয়া তো দূরের কথা অধিকাংশ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক মামলা করায় তারা বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ নিরস্ত্র জনতাকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করলেও উল্টো পুলিশের শতাধিক মামলায় সারাদেশে লক্ষাধিক নাগরিককে আসামি করা হয়েছে। ফলে দেশজুড়ে চলছে পুলিশের গণগ্রেফতার অভিযান। অধিকাংশ এলাকায় এখন নাগরিকরা নিজ ভিটেবাড়ি ছাড়া হয়ে পালিয়ে যাযাবর জীবনযাপন করছেন। অনেক এলাকা এখন পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনের সহিংসতায় গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর আহতরা হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গেলে সেখানেও সরকারের পেটুয়া বাহিনী পুলিশ ও দলীয় ক্যাডাররা হামলা চালাচ্ছে।
সাভারে গণহত্যা : গত ২৪ এপ্রিল সাভারে সংগঠিত হয় আরেক গণহত্যা। এ গণহত্যার শিকার হন অসংখ্য গার্মেন্ট শ্রমিক। সাভার থানা যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড সোহেল রানা জোর করে শত শত গার্মেন্ট শ্রমিককে ব্যবহারে সম্পূর্ণঅনুপযোগী একটি ভবনে ঢুকিয়ে হত্যা করে। এ পর্যন্ত এ গণহত্যায় ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও উদ্ধার হচ্ছে মরদেহ।
রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়ার পর পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়। টিভি চ্যানেলেও বিপজ্জনক এ ভবন নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে। গণহত্যার দিন গার্মেন্ট শ্রমিকরা ঝঁকিপূর্ণ এ ভবনে কাজ করতে রাজি না হলে রানার পক্ষে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করা হয় ‘দু-একটি ফিলার ফাটলে কিছুই হয় না। আপনারা কাজে যোগ দিন।’ এরপরও কেউ কেউ কাজে যোগ দিতে না চাইলে তাদের পিটিয়ে কাজে পাঠানো হয়। গার্মেট মালিকরাও শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে দেয়া ও চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে হতদরিদ্র গার্মেন্ট কর্মীরা কাজে যোগ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধসে পড়ে অভিশপ্ত ৯তলাবিশিষ্ট ভবন রানা প্লাজা। চাপা পড়ে এ ভবনের পাঁচটি গার্মেন্টে কর্মরত ৫ হাজারের মতো শ্রমিক । এ মৃত্যুপুরী থেকে গতকাল পর্যন্ত ২৪৩৭ জনকে জীবিত এবং ৬৭৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। স্বজনরা ঘটনাস্থল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডসহ আশপাশের হাসপাতাল এবং মর্গে খুঁজে ফিরছেন তাদের। উদ্ধার কাজের সঙ্গে যুক্ত রেডক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন, গত দু’দিন ধরে উদ্ধারকৃত লাশগুলোর বেশিরভাগই পচে গেছে। লাশ বিকৃত হওয়ায় পোশাকের রঙ চেনার কোনো উপায় নেই। স্বজনরাও চিনতে পারছে না তাদের প্রিয় মানুষটিকে। তারপরও পকেটে থাকা মোবাইল ফোন এবং পরিচয়পত্র দেখে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা।
গত ৪৮ ঘণ্টার ঢাকা , সৃষ্টি করলো বর্বরতার নতুন ইতিহাস : গত ৪৮ ঘণ্টার ঢাকা সৃষ্টি করেছে নতুন বর্বরতার ইতিহাস। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে গত দু’দিন ধরে যেভাবে নির্বিচারে আলেমদের হত্যা করা হয়েছে দুনিয়ার ইাতহাসে এ নজির নেই। মাত্র ১৫ মিনিটের অপারেশনে অগণিত আলেমকে হত্যা ও আহত করা হয়েছে। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। এ সব আলেম নবীজির (স.) ইজ্জত রক্ষার দাবিতে ঢাকা অবরোধ করতে এসেছিলেন। অবরোধ শেষে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ওলামা-মাশায়েখরা সমাবেশ করছিলেন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। এ সমাবেশে যোগ দেন লাখ লাখ তৌহিদি জনতা। সমাবেশে আসার পথে আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগের বিবি অ্যাভিনিউর কার্যালয়ের সামনে মাদরাসার এক ছাত্রকে যুবলীগ ক্যাডাররা পিটিয়ে হত্যা করে। আহত হন আরও অনেকে। এরপর শুরু হয় উত্তেজনা।
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় গভীর রাতে। রাত আড়াইটার দিকে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত লাখো আলেম জিকির করছিলেন। কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। এরই মধ্যে হঠাত্ গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে মতিঝিল এলাকা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আলেমদের বুকে একযোগে গুলি চালায় র্যাব, পুলিশ, বিজেপি ও সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। চারদিক থেকে আসছিল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। হাজার হাজার রাউন্ড গুলি। তপ্ত বুলেট এসে বিঁধছিল আলেমদের বুকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে পায়রার মতো রক্তাক্ত অসংখ্য আলেম লুটিয়ে পড়েন রাজপথে। আলেমদের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর তসবি রক্তে ভিজে চুবচুব করছিল। মতিঝিলের পিচঢালা কালো রাস্তা আলেম-ওলামাদের রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। এত রক্ত ধুয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হিমশিম খেতে হয় সরকারি কর্মচারীদের। আল্লাহর রাসুলের ইজ্জত রক্ষার দাবি নিয়ে এসে এসব আলেমদের জীবন দিতে হলো।
রাত আড়াইটার দিকে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন পড়ে আছে অনেকের নিথর দেহ। আবার অনেকে বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন সরকারি বাহিনীর কাছে। অবশ্য এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো মতিঝিল এলাকা জনশূন্য করে ফেলা হয়। বাধার কারণে হতাহতের খুব একটা ছবি তুলতে পারেনি ফটো সাংবাদিকরা। দিগন্ত টিভি কিছু কিছু ফুটেজ সরাসরি দেখাচ্ছিল বলে ওই টিভি চ্যানেলটি তাত্ক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ গণহত্যা চলাকালে গুলি, টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা। এখানকার বাসা-বাড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা আশপাশের বিভিন্ন অলিগলিতে এমনকি গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই সব অলি-গলিতেও হানা দেয়।
মতিঝিলে গণহত্যাই শেষ নয়, গতকাল দিনভর তৌহিদি জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশ, বিজেপি ও সরকারি দলের ক্যাডারদের। এতে অন্তত ১৯ জন গণহত্যার শিকার হন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে। বাগেরহাটে হত্যা করা হয়েছে ২ জনকে।
Source: Amardesh Online

2 COMMENTS

  1. Politics apart, saddest part of Hefazat dead are that there is no one to even shed tears for them – most of these guys were innocent and naive activists who sincerely believed they were demonstrating to protect Islam, were orphans (yatims) living in madrassa run orphanages belonging to rural poor! Our so-called civil society, the harbingers of secularism and Bangla culture, the pall-bearers of human rights did not care, looked the other way and some even rejoiced.

    Bangladesh has truly become a failed state, we have failed morally -, completely and utterly!

Comments are closed.