A basket that lost its bottom and a woman who lost her clothing

 Minar Rashid

তলা খোয়ানো ঝুড়ি আর বস্ত্র খোয়ানো নারী

(দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আজকের উপসম্পাদকীয় কলাম)

১৯৭৩ সালে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে কয়েকজন ছাত্রী অপহৃত হয়ে সম্ভ্রম খুইয়েছিলেন। ২০০০ সালে নিউ ইয়ারের প্রথম প্রহরে টিএসসির মোড়ে বাঁধন নামের একটি মেয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েকজন নারীর বস্ত্রহরণ পুরো জাতিকে স্তম্ভিত ও হতবাক করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে ছবি এসেছে, তা দেখে শরীর ও মন শিহরিত হলেও ‘গোপালিশ’ নামে খ্যাত পুলিশের ভাষ্য শুনে তা আবার হিম হয়ে গেছে।

আজ অনেকের মনে প্রশ্ন, এ ধরনের ঘটনা শুধু একটি বিশেষ দল ক্ষমতায় এলেই কেন বেশি সংঘটিত হয়? এই বিশেষ হরমোনটি কেন শুধু এই বিশেষ সময়টিতেই ক্ষমতাবানদের ইন্দ্রিয়ে বেশি করে নিঃসরিত হয়? পরিমল ও সেঞ্চুরিয়ান মানিকদের মাথায় কেন এই বিশেষ সময়েই এমন করে রক্ত উঠে বসে?

উত্তরটি যত কঠিন ও অপ্রিয় হোক, সমাজের গ্রন্থি ঠিক রাখতে তা উচ্চারণ করতেই হবে। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র না থাকলে অর্থনীতির তলা যেমন ছেদা হয়ে যায়, তেমনি নারীদের বস্ত্রও এক কায়দায় হরণ হয়ে যায়। আমাদের দেশে শেয়ারবাজারের দু’টি ভয়াবহ ধস সংঘটিত হয়েছে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান কথিত বাজিকরদের জমানায় । ৩০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্ব খুইয়েছেন; অথচ এদের কেউ রাস্তায় নামতে পারেননি।
ফ্যাসিবাদ বা বাকশালের সম্মুখে শুধু নারীরাই অবলা হয়ে পড়েন না, পুরো দেশই দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এটি হঠাৎ ঘটে যাওয়া কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয়, বরং একটি সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্স।

এখানে ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা গোষ্ঠীগত ত্রুটির চেয়ে সিস্টেমের ত্রুটিই বেশি দায়ী বলে মনে হয়। সিস্টেম ত্রুটিপূর্ণ (যে সিস্টেমের ফলে সমাজের একটা অংশ সব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে উঠে যায়) হলে তার ভেতরের ব্যক্তিরা কখনোই শুদ্ধভাবে কাজ করতে পারে না। পয়লা বৈশাখে নারীর বস্ত্রহরণ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নামে যন্ত্রটির তেমনি এক গলদ বা ত্রুটি নির্দেশ করছে। তা হলো আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র বা সমাজ নামে মেশিনের একটি Tell tale holec. এই ছিদ্রপথে যে গরলটি দেখা যাচ্ছে, তা আসলে পুরো মেশিনের এক মারাত্মক ডিফেক্ট বা ত্রুটির খবর জানান দিচ্ছে মাত্র। কেন যেন আমরা সেই ত্রুটির ভেতরের খবর নিতে চাই না।

এ ধরনের ডিফেক্ট স্পষ্ট হওয়ার পর বিজ্ঞ প্রকৌশলীদের কর্তব্য হলো, মেশিনটা যথাযথ মেরামত করা, যাতে সম্ভাব্য ডিজাস্টারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু তা না করে কেউ যদি সেই Tell tale hole এর মুখটি সিলগালা করে দেন এবং প্রশান্ত মনে সেই ইঞ্জিনটি নিয়ে আকাশে উড়েন কিংবা সমুদ্র পাড়ি দেন, তবে তাকে কে কী বলবেন জানি না। কিন্তু জাতি বা রাষ্ট্র নামে বাহনটিকে আমরা এদের হাতেই অর্পণ করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি। জানি না, এই জাতির হুঁশ কখন ফিরবে কিংবা আদৌ ফিরবে কি না। কয়েক দিন আগে ‘তৃতীয় মাত্রা’য় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর বিলাপ অনেককেই স্পর্শ করেছে। তিনি ৬৭ জন অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন রেখেছেন। সাতটি পদ খালি না থাকলেও এই পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ৬৭ জনকে! এই ৬৭ জনের মধ্যে আবার ৪৬ জনই হলেন একটি সম্প্রদায়ের সদস্য। তাদের জন্য মোট পদের ৭০ ভাগ বণ্টন কতটুকু ন্যায্য হয়েছে, তা বলার মতো সাহস এ দেশের কারো আছে কি? এই ন্যায্য কথাটুকু বলতে গেলে নূরে আলম সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিত্বকেও কি সাম্প্রদায়িক খেতাব গ্রহণ করতে হবে? নারীর বস্ত্র হরণকারীদের প্রশ্রয় আর এসব অন্যায্য প্রমোশন- দুটোই বিরাট অন্যায়।
নারীর বস্ত্রহরণ বা বস্ত্র নিয়ে টানাটানির অসংখ্য ঘটনা এই দেশে সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের অনেক ঐতিহাসিক টানাটানি জাতির মনে দাগ কেটে রয়েছে। তবে এগুলো সবই হিংস্র রূপ পরিগ্রহ করেনি। অনেকগুলোই স্নিগ্ধ প্রেমের উপাখ্যান রচনা করেছে। বান্ধবীর বাবার সাথে প্রেম করে সেই আঙ্কেলকে বিয়ে করেছিলেন বিনোদন জগতের জনৈক নায়িকা। জাতি যখন আজ প্রেমের ডিজ-অর্ডারে ভুগছে, তখন সেই নায়িকাই প্রেমের স্নিগ্ধ বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। পয়লা বৈশাখের লম্পটদের উদ্দেশে এক স্নিগ্ধ ও আবেদনময় পরামর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন, ‘লম্পট হবেন না, ভালো লাগলে প্রেমিক হতে চেষ্টা করুন’।

এই ভাবধারায় সিক্ত হয়ে এক সাবেক প্রেসিডেন্ট (সাবেক কবিও বটে) প্রকাশ্য জনসভায় পরস্ত্রীর শাড়ির আঁচল নিয়ে আনমনে খেলা করেছেন। এমন একটা উজ্জ্বল ঘটনাও আমাদের গৌরব ও গর্বের রেকর্ড বুকে রয়েছে।

পয়লা বৈশাখে নারীর বস্ত্রহরণ নিয়ে অপরাপর কবিদের মতো অবশ্য তেমন কোনো পদ্য রচনা করেননি তসলিমা নাসরিন। তিনি তার নিজের গদ্যেই লিখেছেন, ‘পুরুষরা জনসমক্ষে মেয়েদের খেতে গেলেই আপত্তি, আড়ালে কায়দা করে খেলে আপত্তি নেই।’ কয়েক বছর আগে এ ধরনের ‘কায়দা করে খাওয়ার’ কিছু স্যাম্পল বা নমুনা নিজের জীবন থেকে তুলে ধরে প্রথমে ভূমিকম্প ও পরে শত ফুট উঁচু সুনামি সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।

এই তসলিমা যখন পরিবার নামে গাছটির গোড়া ধরে টানাটানি বা খোঁচাখুঁচি শুরু করে দেন, তখন যারা এই গাছটির আগডালে বা মগডালে বসেছিলেন, তারা হি হি করে হাসতে থাকেন। ছেলেরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে পারলে একই ধরনের কাজ মেয়েরা কেন করতে পারবে না? ১৩-১৪ বছরের ভাইটি ইচ্ছেমতো বক্ষদেশ উদোম রাখতে পারলে সে কেন পারবে না, মা কেন তাকে অহেতুক অতিরিক্ত কাপড় পরতে চাপাচাপি করেন? তার এই কিসিমের প্রশ্ন শুনে পুরো সমাজ প্রমাদ গুনলেও উচ্ছ্বসিত ও উল্লসিত হয়ে পড়ে মূল ছেড়ে মগডালে বসা সেই পুরুষকুল। কারণ তার এই বিষাক্ত তীর শুধু গোড়া ধরে থাকা পুরুষকুলের গতরে বিঁধছিল।

কিন্তু এই কাঁচামরিচের ঝালটুকু এই খেলারামরা টের পায়নি। একদা যাকে খনি ভেবেছিল, সেই বালিকা যে আড়ালে আবডালে তাদের অচ্ছেদ্য সুতা দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল, তা মালুম করতে পারেনি। এক সময় সেই সুতা ধরেও টান মারে। খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে ডালগুলোও ঝাঁকানো শুরু করে দেয়। তখন মগডালে বসে থাকা পুরুষকুল সত্যিই বেকায়দায় পড়ে যায়। একে একে নাম ধরে কোন হোটেলে, কোন পার্কে, কোন রেস্টুরেন্টে, কোন দিনে, কোন তারিখে, কোন সময়ে কোন মগডালের কোন পাখি তার পানে কোন তরিকায় কতটুকু অ্যাডভান্স করেছিল, তার সরস ও রগরগে বর্ণনা দিয়ে বসে। তখন কেউ কেউ কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলা দিয়ে খোয়া যাওয়া ইজ্জত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। বিভিন্ন কারণে মন ভারী করা এই পৃথিবীটাও সেদিন মন খুলে দাঁত বের করে অনেকক্ষণ হেসেছিল।

এই লেখিকার হতাশা বা মনোবেদনার কারণটি স্পষ্ট। কারণ তিনি করুণ চোখে দেখতে পাচ্ছেন যে, একদা যারা কায়দা করে তার বস্ত্র খুলতে চেয়েছিল, সেই খেলারামদের কেউ কেউ এখন কমিটির পৌরোহিত্য করছেন। দেশের সবচেয়ে সচেতন অংশ ঢাকাবাসীকে আধুনিক ও মানবিক নগর পিতা বেছে নেয়ার সুপরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের সমর্থিত সেই মেয়রপ্রার্থী পাঁচ দিন পর নারীদের এই বস্ত্রহরণ নিয়ে মুখ খুলেছেন। এই শ্রেণীটির কথা ও কাজের মিলও দারুণ তৃপ্তিদায়ক। যে মেয়র আলোকিত ঢাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তারই এক সঙ্গী বেগম জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পুরুষ জাতি সম্পর্কে এই লেখিকার অভিজ্ঞতা অন্ধের হাতি দেখার মতো। তার আশপাশের ও সমগোত্রীয় পুরুষ থেকেই তিনি তার জীবনের সব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন বলেই মনে হয়। যে পুরুষের কাছে গিয়েছেন- সেই যদি বস্ত্রহরণের সুযোগ খোঁজে, তাহলে তার আর কি-ই বা করার আছে? সর্বশেষ বোমা ফাটিয়েছেন, তারা দুই বোন যুগপৎ এই হক সাহেবের না-হক প্রেমে মজেছিলেন।

এক পুরুষের অপরাধ দুনিয়ার তাবৎ পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার এই বাতিক নিঃসন্দেহে ত্রুটিপূর্ণ। তবে শতভাগ রাজনীতিনিরপেক্ষ। কিন্তু পয়লা বৈশাখের বস্ত্রহরণ নিয়ে এ দেশের বিশেষ ঘরানার মিডিয়া ও তাদের কুশীলবদের ভূমিকা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ভাসুরের চেহারা স্পষ্ট হওয়ার পর তার নাম না নিয়ে সব পুরুষের ঘাড়ে চাপানোর কোশেশ করছেন।

এক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও স্বনামধন্য লেখক লিখেছেন, পুরুষকে মানুষ করো, বাঙালিকে সভ্য। লেখক মহোদয় তাবৎ পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

একটি নর্দমার কিছু পুঁটি মাছ সহজেই ধরে ফেলে ভেতরের সব তেল বের করে ফেলা যেত। আইনের শাসনসম্পন্ন প্রতিটি সভ্য জাতি তাই করে থাকে। কিন্তু আমাদের ভাবজগতের এই মহাঋষিরা কিছু কালপ্রিটকে পুরুষতন্ত্রের মহাসাগরে ছেড়ে দিয়ে পুরো জাতিকে ভাবের সেই অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়ানো শুরু করেছেন। মতলববাজ আরেকটি গ্রুপ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর জন্য চাপদাড়িওয়ালা মানুষ খোঁজা শুরু করেছেন।

এদেরই আমরা আমাদের বোধ ও ভাবনার একেক মহীপাল বানিয়ে রেখেছি। এদের এসব ভারিক্কি মন্তব্য দেখে এক মায়ের সেই নাবালক ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। অনেক মেয়ের পর সেই মায়ের কোলে একটি ছেলে এসেছে। মা এই ছেলেটিকে অত্যধিক স্নেহ ও আদর করেন। ছেলের মুখ থেকে একটি কথা বের হয়, আর আহ্লাদি মা সবাইকে জানিয়ে বলেন, দেখো, আমার সক্রেটিস অ্যারিস্টটল কী জ্ঞানের কথাই না শোনাচ্ছে। মায়ের এ ধরনের তারিফ শুনতে শুনতে ছেলেটির ভাবসাবে এক ধরনের ভারিক্কি চলে এসেছে।

এমন সময় তার এক মেয়ের দাম্পত্য কলহের খবর আসে। মা তার এই মহাজ্ঞানী ছেলেকে ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধান করতে পাঠান। এক সদস্যের সেই অনুসন্ধান টিমের কাজ সমাপ্ত করে মায়ের কাছে রিপোর্ট করে, ‘মা, তোমার জামাইয়ের কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার এই ফাজিল মেয়ের। বুঝছো মা, আমি রাতে চোখ বন্ধ করে দুলাভাই ও বুবুর সাথেই শুয়ে থাকি। একটু পরে দেখি, বুবু অহেতুক দুলাভাইকে বিরক্ত করা শুরু করে দেয়। এক সময় দুলাভাই আর টিকতে না পেরে শুরু করল চরম মারামারি। এখন বলো, দোষটা কার?’

আহ্লাদি মায়ের এই কৃতী সন্তানের মতোই আমরা কিছু অ্যারিস্টটল সক্রেটিস সৃষ্টি করেছি। তারাও এই নাবালক ছেলের মতো ভারিক্কি নিয়ে জাতিকে বিভিন্ন সমস্যার কারণ বাতলে দেয়। এই নাবালক ঘরানার অ্যারিস্টটল সক্রেটিসরা মানবজাতির ও মানব সমাজের অনেক গোপন রহস্য মালুম করতে না পেরে খালি খালি বুধোর ওপর উদোর দোষ চাপিয়ে দেয়।