বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন এস কে সিনহা

বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন এস কে সিনহা

বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন এস কে সিনহা

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, মামলার রায়ের বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, একটি বিশ্বস্ত চক্রের মাধ্যমে এস কে সিনহা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ওই অর্থ পাঠান। সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক রণজিতের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ কানাডাপ্রবাসী অচিন্ত কুমার ও অভিবাসন আইনজীবী মেজর (অব.) সুধীর সাহার মাধ্যমে মেয়ে আশা সিনহার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় থাকা মেয়ে সূচনা সিনহার অ্যাকাউন্টেও অর্থ পাচার করেছেন তিনি। দুই মেয়ের কাছে পাঠানো অর্থের পরিমাণ তিন কোটি ১৭ লাখ টাকা,  যা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত। ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই অর্থ তিনি অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় পাচার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে সম্প্রতি তিনি একটি বাড়িও কিনেছেন। এ ছাড়া নিজের ও ভাইয়ের নামে প্লট বরাদ্দে প্রভাববিস্তার, প্লটের মূল্য পরিশোধ না করা, ওয়ান/ইলেভেনের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকারের আদায় করা অর্থ পুনরায় ফেরত দিতে উৎকোচ গ্রহণ, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থের সন্ধান, দুদকের তদন্তে বাধাসহ অন্তত ১২টি অভিযোগ উঠেছে সিনহার বিরুদ্ধে।

সূত্র জানায়, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়ের অ্যাকাউন্টস অফিসারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যবিবরণী, কানাডায় পাঠানো টাকার ব্যাংক কনফারমেশন এসএমএসের স্ট্ক্রিনশট, কানাডায় অবস্থান করা মেয়ে আশা সিনহার অর্থপ্রাপ্তির এসএমএস, অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো অর্থের কনফারমেশন ই-মেইল, ইন্দোনেশিয়ার পেনিন ব্যাংক থেকে সূচনা সিনহার অ্যাকাউন্টে পাঠানো অর্থের ডিপোজিট ফরম থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিনহার অর্থ পাচারের বিষয়টি গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে।

ওই গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, হুন্ডির মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম দফায় কানাডায় পাঁচ হাজার ডলার পাঠান এস কে সিনহা। পরের মাসের ৫ জুন আরও আট হাজার ডলার পাচার করেন তিনি। ওই বছরের ১৩ জুলাই আরও ১০ হাজার ডলার পাঠান। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কানাডায় ৩৬ হাজার ডলার পাচার করা হয়। এ ছাড়া সিনহার সুপ্রিম কোর্ট শাখার ব্যক্তিগত বেতন অ্যাকাউন্টে এমন ২৬টি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার মধ্যে ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর সিনহার হিসাব নম্বরে পে-অর্ডারের মাধ্যমে চার কোটি টাকা জমা হয়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, জনৈক নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গুলশানের ফারমার্স ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নিরঞ্জন তার ঠিকানা হিসেবে প্রধান বিচারপতির উত্তরার বাসার নম্বর উল্লেখ করেন। ৮ নভেম্বর নিরঞ্জন সাহা তার ওই হিসাব নম্বর (০১৭৩৫০০১৫৭২২৪) থেকে সিনহার হিসাব নম্বরে (০০৯২০৪৬) দুই কোটি টাকার পে-অর্ডার প্রেরণ করেন। সেটি সিনহার বেতন অ্যাকাউন্টে (৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫) জমা হয় ৯ নভেম্বর। অন্যদিকে, জনৈক শাহজাহান ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আরেকটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। তার ঠিকানা হিসেবেও সিনহার উত্তরার বাসার নম্বর দেখানো হয়। শাহজাহান ৮ নভেম্বর তার হিসাব নম্বর থেকে দুই কোটি টাকার একটি পে-অর্ডার সিনহার নামে প্রেরণ করেন, যা সিনহার বেতন অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নিরঞ্জন সাহা ও শাহজাহানের কোনো পাসপোর্ট বা টিআইএন নম্বর নেই। এ ধরনের দু’জন ব্যক্তির কাছ থেকে সিনহার হিসাব নম্বরে চার কোটি টাকার লেনদেনকে রহস্যজনক বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা।

সূত্র জানায়, ওয়ান/ইলেভেনের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এক হাজার ২৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে পৃথক রিট আবেদন করে। রিটের রায়ে সরকারের আদায় করা অর্থের কিছু অংশ (৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা) ৯০ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার আদেশের বিনিময়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন বিচারপতি সিনহা।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের একটি গুরুতর অসদাচরণ-সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত চলছিল। চিঠি দিয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত না করার নির্দেশ দেন এস কে সিনহা। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি জাপানে একটি সেমিনারে গিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে বলে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া তিনি বিগত সংসদে বিনা ভোটে নির্বাচিত ১৫৩ সংসদ সদস্যের পদ বাতিলের চক্রান্ত করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একজন আইনজীবীকে দিয়ে রিট আবেদন করানোর পরিকল্পনা ছিল তার। সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়ে ইসলামী দলগুলো দাবি জানিয়ে এলেও তা অপসারণ করে পুনরায় সেটি এনেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপন করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন এস কে সিনহা। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর পরিবার তাদের আপিল মামলা শুনানিকালে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান এস কে সিনহা। ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে তার অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টোবর বিদেশে যাওয়ার আগে বিচারপতি সিনহা সাংবাদিকদের জানান, তিনি অসুস্থ নন। ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় বিব্রত হয়ে তিনি বিদেশ যাচ্ছেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর তার ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও দেশে না ফিরে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিচারপতি সিনহা। পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তখন বলা হয়, এসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর সিনহার সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন। সম্প্রতি ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম :রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রোসি’ শীর্ষক আত্মজীবনী প্রকাশের পর আবার বিতর্কের জন্ম দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা।

Daily Samakal is believed to be a press outlet for Bangladesh Government intelligence agency