নির্বাচন কমিশন. উপমহাদেশের বাস্তবতা, নেপাল ও আমরা

এম সাখাওয়াত হোসেন

election-commission

আমি বর্তমানে একটি গবেষণার কাজ করছি। বিষয়, নির্বাচনী প্রশাসন: নির্বাচন কমিশন এবং সহযোগীদের ভূমিকা। নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হচ্ছে। গবেষণায় প্রাসঙ্গিকভাবে এই উপমহাদেশের কয়েকটি দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করতে হচ্ছে। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান নেপাল। তিনটি দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় কাছাকাছি। শুধু একটু ব্যতিক্রম নেপালের ব্যবস্থাপনায়, যেখানে প্রকৃতপক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা মাত্র এক দশকেরও কম সময়ের; তারপরও ইতিমধ্যেই নেপালের গণতন্ত্রে বহু মত বহু পথের সমাবেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড় দলগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট দলের প্রতিনিধিত্ব বর্তমান সংসদে রয়েছে। 

সংসদের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রধান তিনটি দল ছাড়াও ১২২টিদল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং এমনটা সম্ভব হয়েছে ভোটের মিশ্র প্রক্রিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ (এফপিটিপি) এবং আনুপাতিক হারে (পিআর) ব্যবস্থাপনার কারণে।

নেপালের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত ২০০৮ সালের এবং হালের ২০১৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের অগাধ বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন প্রত্যক্ষ করা এবং নেপালের নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে জানার সুযোগ হয়েছিল। ওই সময়েও গৃহযুদ্ধউত্তর নেপালের নবগঠিত এবং পুরোনো পার্টি মিলে ১২০টির ওপরে ছোটবড় দল অংশগ্রহণ করেছিল এবং নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো ধরনের নেতিবাচক ধারণাও কোনো দল বা গোষ্ঠী পোষণ করেনি।

ওই নির্বাচনে প্রায় ১০ বছর যুদ্ধরত গেরিলা সংগঠন মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির জয় হয়েছিল এবং প্রথম গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে 

ওই দলের এককালের গেরিলা নেতা পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ড প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ওই একই দল তৃতীয় বৃহত্তম দলে নেমে আসে। তবে রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও পুষ্প কমল দহল প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন।

সম্প্রতি আমার গবেষণার বিষয়টি নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে নেপালের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও দুটি দলের প্রধান, যাঁরা পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এবং সদ্য সাবেক বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। 

নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (ইউএমএল) কেপি শর্মা ওলি এবং একসময়ের মাওবাদী নেতা বর্তমানে নয়াশক্তি পার্টির কনভেনর বাবুরাম ভট্টরাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় যে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, তা হলো নেপালের গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং তার জন্য অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। যদিও সবাই একমত যে নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ভোটের মিশ্র পদ্ধতির কারণে কিছুটা জটিল। তবে যেহেতু নেপালে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন রয়েছে এবং প্রথম থেকেই একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তা গঠিত হয়, তাই কমিশনের প্রতি সব কটি দল সাধারণ মানুষের আস্থার অভাব নেই। 

সর্বসম্মতিতে প্রণীত আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার কারণে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত ওঠেনি।

নেপালের নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনা কার্যপদ্ধতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু বিবেচনায় নিয়েই নেপালের সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার নীলকান্ত উপ্রিতি বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আয়োধি প্রাসাদ ইয়াদবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কয়েকটি পরিবর্তনীয় (variabls) উপাদান নিয়ে আলোচনাকালে প্রথমেই আলোচিত হয় নির্বাচন কমিশনের কার্যক্ষমতা বিশ্বাসযোগ্যতার উপাদান নিয়োগপদ্ধতি এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে। 

আমার একটি পরিবর্তনীয় উপাদান নির্বাচন কমিশনের ওপরে আস্থার সংকটের অন্যতম কারণ নিয়োগপদ্ধতির কোনো প্রচলিত আইন না থাকা, যা আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। এই উপমহাদেশের যে কয়েকটি দেশের নির্বাচনী শাসনব্যবস্থা নিয়ে আমার গবেষণা, তার মধ্যে নেপাল পাকিস্তানে সংবিধানে সন্নিবেশিত অথবা আলাদা আইনের মাধ্যমে বর্ণিত নিয়োগপদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারত বাংলাদেশের সংবিধানে আইন প্রণয়নের বিষয় উল্লেখ থাকলেও তা করা হয়নি।

তবে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের আগে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান একটি বাছাই কমিটি গঠন করে নিবন্ধিত সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে ওই নিয়োগের এবং বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তিদের তালিকা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তা থেকেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা পরিচালনা নিয়ে নানা মহলে আলোচিতসমালোচিত হন।

যা হোক, নেপালের নিয়োগপদ্ধতি সংবিধান মোতাবেক একটি কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ওই কাউন্সিল শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, অন্যান্য সাংবিধানিক পদেও নিয়োগের জন্য বাছাই করে থাকে। নেপালের কনস্টিটিউশন কাউন্সিলের প্রধান থাকেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য সদস্যরা হলেন প্রধান বিচারপতি, সংসদের নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের চেয়ারপারসন, কয়েকজন মন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা। এই কাউন্সিলের সুপারিশকৃত নামের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধান অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। 

নেপালের সংবিধান মোতাবেক প্রধান অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার বছর মেয়াদ অথবা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকতে পারেন, তবে পরবর্তী সময়ে বয়সের সময়সীমা সাপেক্ষে জ্যেষ্ঠ কমিশনার প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি হলেও বয়সসীমায় অবসর গ্রহণ করবেন। ভারতের মতো নেপালকেও সাধারণত জ্যেষ্ঠ কমিশনার হতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২০০৭ সালে কমিশনার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

পাকিস্তানে নির্বাচন কমিশনে ১৯৭৩ সালের সংবিধানের সংশোধনী মোতাবেক সম্পূর্ণ কমিশন বিচার বিভাগের সাবেক কর্মরত বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত। তিন বছর মেয়াদে একজন সাবেক আপিল বিভাগের বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বাকি চার সদস্য পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের উচ্চ আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে নিয়োজিত হন। পদ্ধতিতে প্রতিটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা।

পাকিস্তানের নিয়োগপদ্ধতি যেভাবে বিন্যাসিত, তাতে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রধান ১২ সদস্যবিশিষ্ট সংসদীয় কমিটির কাছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে সংসদীয় কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য নাম পাঠিয়ে দেয়। সংসদীয় কমিটি সমানুপাতে সরকারি বিরোধী দলের সদস্য দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে একতৃতীয়াংশ সিনেটের সদস্য থাকেন। কমিটি গঠিত হয় স্পিকারের মাধ্যমে।

ভারতের সংবিধানের ৩২৪ ধারায় সংসদ দ্বারা একটি আলাদা আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও আইন প্রণয়ন করা হয়নি। ভারতে প্রথম থেকেই রাষ্ট্রপতি দ্বারা কমিশন গঠিত হয়, তবে ৬৫ বছর বয়স এবং বছরের মাথায় একজন সদস্যকে অবসরে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কমিশনার বয়স মেয়াদ থাকা সাপেক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োজিত হয়ে থাকেন। কারণেই ভারতে নেপালে নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তবে ভারতের নির্বাচনপদ্ধতি কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়লেও খোদ নির্বাচন কমিশনাররা মনে করেন, সংবিধান মোতাবেক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিয়োগই সর্বোত্তম। বিষয়টি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেশি তাঁর রচিত পুস্তক আনডকুমেন্টেড ওয়ান্ডার (পাতা ৪০) উল্লেখ করেছেন। তিনি বহুবিধ কারণে ভারতের নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া কোনো চ্যালেঞ্জ না হওয়াকেঅলৌকিক ঘটনাবলে উল্লেখ করেছেন।

যা হোক, নির্বাচন কমিশন অতিগুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যার কারণে সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে বিশেষভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। এবং কারণেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে, যেসব গণতান্ত্রিক দেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করার বিষয়টি সংবিধানবিধৌত। আমাদের মতো দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক ভিত দুর্বল, গণতন্ত্রের সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী নয়, সেখানে সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার উদ্যোগও সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে।

একটি নিরপেক্ষ কার্যক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠনে শরিকদের সহযোগিতা ন্যূনতম ঐকমত্যের, আইন অবর্তমানে, মাধ্যমে গঠিত হলে কমিশনের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়ে অটুট থাকে, তেমনি সহায়ক শক্তিগুলো থেকে সহযোগিতা পেতে সুবিধা হয়। আমাদের দেশে পর্যন্ত ১১টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, যার মধ্যে শুধু একটি কমিশন অ্যাডহক ব্যবস্থাপনায় বাছাই কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত অনুমোদনে গঠিত হলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। বাকি সব কমিশন নিয়েই কমবেশি বিতর্ক হয়েছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো, এই বিতর্ক হ্রাস করতে সংবিধানে উল্লেখিত আইন তৈরি না করা পর্যন্ত সর্বদলীয় অথবা ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে গঠিত হওয়া। 

অবশ্য নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। অপেক্ষা করতে হবে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কীভাবে নিয়োগ দেন, যাতে বিতর্কের জায়গাটি সংকুচিত হয় এবং নবগঠিত নির্বাচন কমিশন সরকার, সরকারি দলসহ অন্যান্য দলের আকাঙ্ক্ষা পূরণকল্পে একটি অবাধ, স্বচ্ছ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে। তবে ধরনের নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে করা কঠিন হয়ে পড়ে, যদি সহায়ক শক্তিগুলো সহায়ক না হয়।

আমরা আশা করি যে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে, যাতে শুরু থেকে নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থার জায়গায় পরিণত হয়। উপমহাদেশের প্রায় একই সামাজিক সংস্কৃতির ধারক অন্যান্য দেশ পারলে আমরা পারব না কেন?

এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার কলাম লেখক৷