দক্ষিন এশিয়ায় দাদাগিরি করবে চীন, ভারত নয়!

Qamrul Islam

wp-1469130093501

তিন/ চার দিন আগে মানবকন্ঠের একটি রিপোর্ট সেভ করে রেখেছিলাম- যার শিরোনাম ছিলো- ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন নয়। বিষয়টা নিয়ে লেখার সময় করতে পারি নাই, যদিও ভেবেছিলাম কেউ লিখবে, বাট অবাক করা কান্ড হলো নানা বিষয় নিয়ে লিখতে বললেও কেউ খোঁচাও দেয়নি। টাসকি খাইলাম। যাক এবারে টপিকে ঢোকা যাক।

সরকারীসূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে- নিশা দেশাইর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা না করা কৌশলগত হলেও ফোনো কথা বলেছেন। নিশার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে যুক্তরাষ্ট্র যা যা প্রস্তাব দিয়েছিল, বাংলাদেশের হাসিনা সরকার নাকি সবগুলোই নাকচ করে দিয়েছে। কি কি ছিল সে প্রম্তাব, শুনি-
১) জঙ্গি দমনে মার্কিন মেরিন সেনা মোতায়েন। নাকচ।
২) সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে বাংলাদেশের সর্বদলীয় সংলাপ (জামায়াতকে সাথে নিয়ে)। নাকচ।
৩) রাজনৈতিক পরিবেশ ঠিক করতে মধ্যবর্তী নির্বাচন। নাকচ।
খবরে লিখেছে, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একগুচ্ছ প্রস্তাবে রাজী নয় রাশিয়া, চীন ও ভারত। হাসিনার সরকার নাকি নিশাকে জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালের আগে নির্বাচনের কথা ভাবছে না সরকার। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে খালিমুখে যেতে হয়েছে!

আসেন একটু খাসভাবে আলোচনা করা যাক। আওয়ামী বলদগুলারে জানতে ইচ্ছা করে আমেরিকাকে অফ করতে গিয়ে ভারতকে ব্যবহার করা গেলে সেখানে কি চীন কখনও ঢুকবে? অবশ্যই না। তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে চীন রাশিয়া ইন্ডিয়া সবাই বাধা দিবে এমনটা ভাবার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারন নাই। বাংলাদেশ এত সেয়ানা হয়ে যায়নি যে, এদের সবাইকে একসাথে ব্যবহার করতে পারবে। কেননা বাংলাদেশের সঙ্গে স্বার্থের বিষয়ে এসব দেশ প্যারালাল। বাংলাদেশ নিয়ে মূলত চারটি পক্ষের প্রভাব লক্ষণীয়- ভারত, চীন, ‍যুক্তরাষ্ট্র, ও রাশিয়া। ভারত নিকট প্রতিবেশী এবং নানা স্বার্থে জড়িত, চীন ব্যবসায়িক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা বানিজ্য সহ বহুপাক্ষিক সম্পর্কে জড়িত, আর রাশিয়ার সম্পর্কটা এখন মূলত ব্যবসায়িক ও কিছু ক্ষেত্রে কারিগরি।

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের স্বার্থটা ব্যাপক, অন্য প্রতিবেশীদের চাইতে বেশী। কেননা সেভেন সিষ্টার্সের ঐক্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ন। এছাড়া যৌথ নদী, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট পাওয়া, ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত, বানিজ্য, মাদক-চোরাচালান ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত। তাই ভারত চায় বাংলাদেশ তাদের কতৃত্বে থাকুক। এ লক্ষে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করে নিতে পেরেছে ধরে নেয়া যায়। যার বদৌলতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনাভোটের নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় রিপিট করে। এটা ঘটাতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা কেবল ঢাকায়ই আসে নাই, ছুটে গিয়েছিল ওয়াশিংটন। সে সব এখন অতীত।

বর্তমানে এশিয়ায় ক্ষমতার বলয়ে চীনের সাথে পাল্লা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের। পূর্ব চীন সাগরে চীনের তৈরী কৃত্রিম দ্বীপের দখল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি ও হুমকিতে চীন কেনো কানই দিচ্ছে না। বরং তারা জানিয়ে দিয়েছে এটা তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, তাই এ নিয়ে আপোষ করবে না। কারন তাদের মূল লক্ষ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চীনা জাহাজের চালাচল নির্বিঘ্ন করা। এ পথ ধরেই চীনের জ্বালানী তেলের ৮০ ভাগ সরবরাহ আসে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের প্রায় এক–পঞ্চমাংশ। এ এলাকায় চীনের শক্তি বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়েছে ভারত। ভারত চেয়েছিল মার্কিন নৌজোটে ডাকতে, কিন্তু চীন হুশিয়ারী দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নৌ চুক্তি করলে তার ফল ভালো হবেনা, এমনকি সম্প্রতি পরিমানবিক সাপ্লায়ার জোটেও যেতে পারেনি ভারত।

ভারত মহাসাগরে চীন তাদের আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরে। এলক্ষে চীন ভারতকে ঘিরে ধরেছে মুক্তার মালার মত। শ্রীলংকার হাম্মামতোতা ও কলম্বোতে, পাকিস্তানের গোয়াদারে চীন সমুদ্র বন্দর নির্মান করেছে; এবং মায়নমারে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের কাজ শুরু চলছে। অন্যদিকে মালদ্বীপে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরী করছে চীন, যাতে আইন করে ওখানে চীনকে ভূমির মালিকানা দেয়া হচ্ছে। শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের বর্তমানে সরকার চীনের সমর্থন পুষ্ঠ। বাংলাদেশে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান করতে চাইলেও বাংলাদেশের হাসিনা সরকার চায় ভারতকে ব্যবহার করতে দিতে। চীন তাতে রাজী নয়, ফলে আপাতত সোনাদিয়া বন্ধ। মোটকথা ভারত মহাসাগর দখলের লক্ষে চীনের প্রস্ততি পূর্নোদ্যমে চলছে। সেক্ষেত্রে ভারত পত্রপত্রিকায় লিখছে ভারত মহাসগরে তাদের নৌবহর বাড়ানোর কথা। কিন্তু ভারতের এসব আওয়াজকে থোরাই কেয়ার করে ভারত মহাসগরে গত তিন মাসে অন্তত চার বার দেখা গেছে চীনা সাবমেরিন। কিছু সাবমেরিন মালাক্কা প্রণালীর নিকটস্থ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশে বিচরণ করতে দেখা যায়। যা মহাচিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে।

ভারতের উত্তরে লান্ডলকড দেশ নেপাল ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে চীনা সাহায্যে। চীন নেপালকে দিচ্ছে জ্বালানী সরবরাহ। চীন নেপালে শতাধিক হোটেল নির্মান থেকে শুরু করে নানাবিধ ইনফ্রাসটাকচারে হাত দিয়েছে। মোটকথা নেপাল এখন চীনের।

ভারতের চির শত্রু পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে রাশিয়ার সঙ্গে, এটা এক অভূতপুর্ব ঘটনা। চীনের সাথে পাকিস্তান গড়েছে বিশেষ সম্পর্ক। পাকিস্তানের গোয়েদরে চীন নির্মান করেছে সমুদ্র বন্দর। এর ফলে পশ্চিম চীনের দূরত্ব কমিয়ে ফেলেছে ১২ হাজার কিলোমিটার। ৪৬০০ কোটি ডলার ব্যয়ে চলছে ৩ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কের কাজ। করিডোর পাহারার নামে পাকিস্তানে নামছে ৩০০০ চীনা সৈন্য, যার একটা অংশ থাকবে আজাদ কাশ্মীর এলাকায়। এনিয়ে ভারত প্রতিবাদ করলেও গা মাখছে না দু’দেশ। চীনের পাঠানো ৩০০০ সেনার সঙ্গে করিডরে মোতায়েন থাকবে পাকিস্তানের নিজস্ব ৯ হাজার সৈন্যের তিনটি বিশেষ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড, এ ছাড়াও গঠন করা হয়েছে দু’টি বিশেষ আর্টিলারি রেজিমেন্ট। অর্থাৎ আরও ২০০০ সেনা। সব মিলিয়ে পাকিস্তান নিজেরা দিয়েছে ১১ হাজারের বাহিনী। চীনের বিমানবাহী নতুন ১১টি নৌবহরের ২টি পাচ্ছে পাকিস্তান।

বাংলাদেশ ও চীন সম্পর্ক নিয়ে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কেনা অস্ত্রে ৮২ ভাগ এসেছে চীন থেকে, যার মধ্যে রয়েছে জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান এবং অন্য নানা অস্ত্র। চীনের কাছ থেকে নতুন দু’টি ফ্রিগেট কিনছে বাংলাদেশ নেভী। ২০ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন সরবরাহ করবে চীন ২০১৯ সালের আগে। চীনের এ আয়োজনের বিপরীতে ভারতের কিছু ইনফ্রাস্টাচারে ঋন, যা ব্যবহারকারী তারা নিজেরাই। চীনের কারবারে ভারতের মাথা বিগড়ে যাওয়ার দশা। বাংলাদেশের উপর ভারতের আর একচেটিয়া প্রভাব থাকছে না, এমনই আভাস দিচ্ছেন চীনারা। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল, বার্মা, চারিদিক দিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলেছে চীন। মাঝখানে বাংলাদেশ নিয়ে একটু সামান্য জটিলতা আছে, এটাও থাকবে না। চীনারা পরিস্কার করেই বলে- বাংলাদেশ ফ্রেন্ডলি কান্ট্রি বাট বার্মা ইজ কাজিন।

সোয়া’শ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত, যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশী দরিদ্র, ৩১ ভাগ মানুষের দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা জাতিসংঘ নির্ধারিত অতি দরিদ্রের মানদণ্ড), ৬২ ভাগ মানুষ রাস্তায় মলত্যাগ করে, যেখানে প্রতিদিন মারা যায় ৫ হাজার শিশু। ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছে ভারতে। সেই ভারত বিশ্ব অর্থনীতির সুপার পাওয়ার চীনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হতে পারে (আমেরিকার কাছে চীন পাবে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার), কিন্তু কাজে কাজ কিছু হবে না। সামনে দক্ষিণ এশিয়ায় দাদাগিরি করবে চীন, ভারত নয়।

অন্যদিকে, ২০১৩ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সক্রিয় হতে, তবে ভারতকে না চটিয়ে। এরি মাঝে ২০১৪ সালের ভোটার বিহীন নির্বাচন হয়েছে, যেটাকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে অতি কারচুপিময় ইলেকশন। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় রহস্যময় হত্যাকান্ড, যার সর্বশেষ হলো গুলশান ও শোলাকিয়া। গুলশান সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপানের ৭ জন এবং ইতালির ৯ নাগরিক নিহত হয়, ফেরত চলে গেছে জাইকার সব কর্মী। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চলছে উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে বাংলাদেশে ঢুকতে, যদিও ভারত আপত্তি দিচ্ছে। কিন্তু ভারতের সাধ থাকলেও সাধ্য নাই, সেটা জানে যুক্তরাষ্ট্র। আরও জানে এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ ভারত-বিরোধী। ফলে ভারত দিয়ে আর বাংলাদেশ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত দেখা করার পরে হাসিনার তথ্যমন্ত্রী ইনু জানিয়েছে, চারটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বাংলাদেশের সাথে। এগুলো হলো- ‘সাইবার অপরাধ, সন্ত্রাস মোকাবিলা, গণতন্ত্র রক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন। গণতন্ত্র বিনির্মানে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়, তার মানে অত্র নিবন্ধের শুরুতে যে আওয়ামী নীতিনির্ধারকদের দেয়া খবর, সেটা সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্র অলরেডি – ইন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকট গতকালই বলেছেন, আমরা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রন করতে চাই না। তবে, গুলশানে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অংশ— এমন অভিমত ব্যক্ত করে বার্নিকাট বলেন, এ ধরনের সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ এবং এ দেশের অর্থনীতির স্বার্থে যথাযথ নিরাপত্তা কৌশল নেওয়া দরকার। তার মানে স্বচ্ছ তদন্ত হচ্ছে না। অতএব, হাসিনার ধরা নিশ্চিত।