২৫ জানুয়ারী ইতিহাসের কালো দিবস: বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেখ মুজিব নয়া কিসিমের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

 আমার দেশ
২৪ জানুয়ারী ২০২৩

শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের সব অধিকার হরণ করেছিলেন

শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের সব অধিকার হরণ করেছিলেন

অলিউল্লাহ নোমান

২৫ জানুয়ারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিবস। এই দিনেই শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১১মিনিটে জাতীয় সংসদে পাস করেছিলেন কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনী। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পদদলিত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এদিনে।

মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের সব অধিকার হরণ করেছিলেন। পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানের অনুকরণে সংসদীয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল সংবিধানের মূলনীতি।

৩ বছরের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান এই সংবিধানের মূল চরিত্র থেকে সরে আসেন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক দলীয় বাকশাল গঠন করেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে গঠন করা হয়েছিল একটি মাত্র দল। এমন কি শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকেও বিলুপ্ত করা হয়েছিল বাকশালের মধ্যে।

বাকশাল গঠনের পাশাপাশি সংসদীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। বাকশালী শাসনের আওতায় রাষ্ট্রপতির হাতে দেশের সকল ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল। কোন রকমের নির্বাচন ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং দেশের সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। রাষ্ট্রপতি হয়েই শেষ নয়। চতুর্থ সংশোধনীতে আরো অন্তর্ভুক্ত করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ন্যায়। অর্থাৎ মানুষের ভোট না নিয়েই আজীবন তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকবেন। যেভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিরা দায়িত্ব পালন করেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালের শাসনের সমালোচনা যাতে কেউ করতে না পারেন, এজন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পাশাপাশি সভা-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সব রকমের গণমাধ্যম। চারটি মাত্র পত্রিকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল বাকশালের গুণকীর্তন করার জন্য। দেশের সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ায় হাজারো সাংবাদিক বেকার হয়েছিলেন। অনেকেই জীবীকার তাগিদে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল গঠন করে সকল ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইন নামে একটি কালো আইন তৈরি করেছিলেন। এই আইনে যখন যাকে ইচ্ছা তাকেই আটক করার বিধান রাখা হয়েছিল। বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছিলেন তখন হাজারো মানুষ। একদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, আরেক দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের তৈরি করা রক্ষীবাহিনীকে দেওয়া হয়েছিল আগাম ইনডেমনিটি। রক্ষীবাহিনীকে ইনডেমনিটি দিয়ে যে কোন সময় যাকে ইচ্ছা তাঁকে আটক এবং যে কোন জায়গায় বিনা পরোয়ানায় ইচ্ছামত তল্লাশির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীকে নির্যাতনে কেউ নিহত হলেও বিচার চাওয়ার সুযোগ ছিল না ইনডেমনিটির কারণে। শেখ মুজিবুর রহমানই ইতিহাসে প্রথম অগ্রিম ইনডেমনিটি দিয়ে রক্ষীবাহিনীকে নির্যাতনের লাইসেন্স দিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নে তখন মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ৩০ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে ও নির্যাতনে নিহত হতে হয়েছেন। এসব অত্যাচার ও নির্যাতনের দায়ে নিহতদের পরিবার আজো বিচার চাইতে পারেনি।

কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের সকল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতির হাতে। শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত ছিল সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের চাকুরি। এক কথায় শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাই ছিল আইন। তিনি যা মনে করতেন সেটাই আইন বলে বিবেচিত হত।

আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করা হলেও বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের নেতাদের লুটপাট আর অত্যাচারে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছিল তখন। দ্রব্যমূল্য বেড়ে মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল ক্রয় ক্ষমতা। এতে দেশ এক চরম দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমলে। রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে কুকুর ও মানুষের মধ্যে খাবার নিয়ে টানাটানির দৃশ্য তখন বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। টাকার অভাবে কাফনের পরিবর্তে কলাপাতা দিয়ে লাশ দাফনের খবরও প্রকাশিত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে। দু:শাসনকে স্থায়ী রূপ দিতেই শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদের সব পথ বন্ধ করে দিতে সভা-সমাবেশের নিষিদ্ধ করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করে প্রেসিডেন্ট শাসনের নামে নয়া কিসিমের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর এই রাজতন্ত্রের নাম ছিল বাকশাল।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন নিয়ে আওয়ামী পত্রিকা গুলো কোন শব্দ করতে নারাজ। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা ও আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাদের পিতার শপথ গ্রহনের দিনটিকে তারা প্রকাশ্যে স্মরণ করতে চায় না। এক দলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যিনি মানুষের সকল অধিকার হরণ করেছিলেন, কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ১১ মিনিটে যিনি সংবিধানের কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনী পাস করেছিলেন জাতীয় সংসদে সেই দিনটি হচ্ছে ৫ জানুয়ারী। এটি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কের তিলক হয়ে আছে। গণতন্ত্র ও সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায় বিচারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে মাত্র ৩ বছরের মাথায় মানুষ হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দু:শাসন।

২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ‘নবরূপে বাকশাল’ শিরোনামে সম্পাদকীয় মন্তব্য কলাম লিখেছিলেন। শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পিতার মত সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করে নবরূপে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।