by Farhad Mazhar 27 June 2022
২০১৫ সালে ‘এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ রেলসেতু’ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’-এর একশত বছর পূর্ণ হয়। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক সেটা বানায়। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনের লুন্ঠন, নিপীড়ন ও শোষণের চিহ্ন ও ইতিহাস ধারণ করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হিজ এক্সিলেন্সি দি ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া ‘ব্যারন হার্ডিঞ্জ পেনসুরস্ট’ পাকশি খুলে দিলেন। ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার নতুন গৌরব রচিত হোল। উত্তর বাংলার সঙ্গে দক্ষিণের যোগাযোগ খুলে গেল। ব্রিজটি বানাতে সেই সময় খরচ হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১ ‘শ ৬৪ ভারতীয় রুপি।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১০-১৯১৬ ভারতের ভাইসরয় ছিলেন। তার নামে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আমরাও পদ্মা ব্রিজের জন্য ফ্যসিস্ট শাসনের গৌরবজনক ইতিহাস মনে রাখব।
যারা দাবি করেন ভাল কে ভাল বলতে হবে, তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই। ব্রিজ ইংরেজরাও বানিয়েছে, গণবিরোধী রাষ্ট্র এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রও বানায়। কিন্তু তর্ক ব্রিজ নিয়ে না। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়া। যদি ব্রিজই মূল বিষয় হোত তাহলে ইংরেজের বিরুদ্ধে আমাদের আর লড়বার দরকার ছিল না। । যদি ইংরেজের গোলামির যুগের ভালটা স্বীকার করি, ফ্যাসিস্ট শক্তির ভালটা অস্বীকার করব কেন? কিন্তু প্রশংসা, আপত্তি বা তর্ক ব্রিজ নিয়ে নয়। সেই তর্ক চিনাদের সাথেও করা যাবে। আপত্তি ব্রিজ দেখিয়ে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত করার সমস্যা। ফ্যাসিজম নিপাত যাক।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। কেন ইংরেজ এই মহৎ কাজ করল? ১৮৮৯ সালে সেই সময়ের ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সাথে আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও উত্তরবঙ্গের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরির তাগিদ বোধ করে। ঔপনিবেশিক লুন্ঠনকে আরও দ্রুত ও প্রশস্ত করা এবং ঔপনিবেশিক শাসনকে ভূগোল ব্যাপী বিস্তৃত ও কেন্দ্রীভূত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৮৮৯ সালেই প্রথম ব্রিজটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। দীর্ঘ ১৯ বছর পর ব্রিজটি বানাবার মঞ্জুরী কবুল হয়।
একশ সাত বছর পর পদ্মার ওপর আরেকটি ব্রিজ বানাল চিনারা। কিন্তু টাকা দিল বাংলাদেশের জনগণ। কেন? যেন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি দাবি করতে পারে ‘আমরা এই ব্রিজ বানিয়েছি’। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চল যুক্ত হোল। তবে আসলে যুক্ত হোল কলকাতা-ঢাকা-ত্রিপুরা ও ভারতের পূর্বাঞ্চল। চিনারা বুদ্ধিমান জাতি। তারা বাংলাদেশীদের টাকায় তাদের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের কাজ আগাম করিয়ে নিল। দক্ষিণ এশিয়ায় — বিশেষত ভারতের পূর্বাঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম এখন সহজ হবে। বলা বাহুল্য প্রতিযোগিতা থাকবে তবে হিন্দুত্ববাদী দিল্লীও এই কানেক্টিভিটির সুবিধা নেবে।
জয়শংকর খারাপ বলেন নি, তিনি বলেছেন চিনের সঙ্গে ভারতের সমস্যা আছে বটে, তবে আমরা তা ম্যানেজ করতে পারবো। অর্থাৎ দিল্লি ও বেইজিং মিলে বাংলার আরও বারোটা বাজাবার কাজ এখন ভালভাবেই ঘটবে ও চলবে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পরে বেয়াকুব ও বেয়াক্কেল ‘বাঙালি’ আরও কোনঠাসা হবে।
কলকাতার বাবুরা দেখলাম খুব উৎফুল্ল। তারা বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির সমর্থক সবসময়ই। নির্বাচন না দেওয়া, বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন – ইত্যাদি নানান কারণে তারা ইদানীং অল্প একটু শরমন্দা হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা ব্রিজ নিয়ে এখন আবার চাঙা। ভাব এরকম! দেখ, বাংলাদেশ কি করে ফেলল! পদ্মার ওপর ব্রিজ দিয়ে দিল! পদ্মার ওপর এটা অবশ্য তিন নাম্বার ব্রিজ। এখন কতো সুবিধা হবে!
সুবিধা অবশ্যই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে কার সুবিধা আর কার ক্ষতি? নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে চিনাদের দিয়ে ব্রিজ বানানো আর নিজের অবকাঠামো নির্মাণের জ্ঞান বা টেকনলজি আয়ত্ব করে নিজেরা ব্রিজ বানানোর মধ্যে ফারাক আকাশ আর পাতাল।
অতএব আমাদের টাকায় ব্রিজ হয়েছে, তাই না? তো কার টাকায় হবে?
টাকা দিয়ে ব্রিজ কেনা বা টেকনলজি প্রদর্শন কোন উপকার করতে পারে না, কারন একটি দেশের উন্নতি রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া থেকে আলাদা না। উন্নতি স্রেফ টেকনলজি বা ব্রিজ বানিয়ে হয় এটা গোলাম ও মূর্খ জনগোষ্ঠির চিন্তা। যারা মোবাইল পকেটে পেয়ে ভাবে তারা স্টিভ জব বা বিল গেইটস হয়ে গিয়েছে! বাপরে!
তবুও ব্রিজ বানানো হয়েছে, বেশ। কিন্তু ব্রিজ দেখিয়ে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন ও বৈধতা নির্ণয়ের প্রপাগাণ্ডা অতিশয় খারাপ। ইংরেজও এই কাজ করে নি। তবে ইংরেজের দালালেরা করেছে।
তবে ইতিহাস অনেক রসিক, ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে, হার্ডিঞ্জ কাজে আসে নি। ফ্যাসিস্ট শাসনও চিরস্থায়ী না।