সমকালীন প্রসঙ্গ: একদল হায়েনা ও একটি গর্ভবতী গণ্ডারণীর কাহিনী

Daily Nayadiganta
একদল হায়েনা ও একটি গর্ভবতী গণ্ডারণীর কাহিনী – প্রতীকী ছবি

বন্যপ্রাণীদের হিংস্রতা ও স্বভাবচরিত্র নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখার সময় হঠাৎ করেই আজকের শিরোনামটির কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল। দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সীমাহীন উদাসীনতা এবং দুর্নীতিবাজদের মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লম্ফন নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে ইদানীং প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

 

অবস্থার এমনই প্রেক্ষাপটে আমি অনুসন্ধান করা শুরু করলাম প্রকৃতির সবচেয়ে কম অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণীর এবং প্রথমেই যাকে পেলাম তার নাম গণ্ডার। এরপর আমি সবচেয়ে নিষ্ঠুর, সবচেয়ে হিংস্র এবং ভয়ঙ্কর প্রাণীদের নাম এবং স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর আরম্ভ করলাম এবং এই তালিকায় হায়েনাদের দেখতে পেয়ে আবার নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছিল, প্রকৃতির সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও নির্মম প্রাণীটি কখন এবং কিভাবে গণ্ডারদের ওপর আক্রমণ চালায়! আমার উৎসুক মনের তাড়না এবং সর্বাত্মক চেষ্টায় কাক্সিক্ষত একটি প্রামাণ্যচিত্র পেয়ে গেলাম যা দেখার পর আমাদের দেশ-কালের অনুভূতিহীন মানব-মানবীদের নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমি যদি আপনাদেরকে সেই প্রামাণ্যচিত্রের কিছু খণ্ডচিত্র বর্ণনা করি তবে আপনারাও আতঙ্কিত না হয়ে পারবেন না।

হায়েনার দলের চিৎকার কিংবা তাদের পরবর্তী নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে পশু তো দূরের কথা কোনো মনুষ্য মস্তিষ্কও কল্পনা করতে অক্ষম। আমি ভয়-আতঙ্ক ও বিস্ময়ভরা চোখে দেখলাম যে, একটি হায়েনা এক কামড়ে গণ্ডারটির লেজ ছিঁড়ে ফেলল। কিন্তু তার পরও আহত গণ্ডারণী কোনো টুঁ শব্দ করল না। সে শুধু একবার ঘাড় বাঁকিয়ে পশ্চাৎ দিকে তাকানোর চেষ্টা করল মাত্র। এরপর একটি হায়েনা লাফ দিয়ে গণ্ডারণীর জননেন্দ্রিতে কামড় বসিয়ে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিলো। ফলে আহত স্থানের রক্ত প্রবল বেগে ফিনকি দিয়ে বেরুতে আরম্ভ করল। এই দৃশ্য দেখে হায়েনাদের উল্লাস বেড়ে গেল। তারা লাফিয়ে লাফিয়ে রক্তাক্ত স্থান থেকে কামড় বসিয়ে মাংস ছিঁড়ে নিতে আরম্ভ করল।

আহত গণ্ডারণী আর্ত চিৎকার শুরু করল কিন্তু তা দলের জন্য কোনো গণ্ডারের কানে পৌঁছাল না। তারা আগের মতো নির্বিকারচিত্তে রোদ পোহাতে থাকল এবং ভুলেও আর্তচিৎকাররত স্বগোত্রীয় জানোয়ারটি দিকে ফিরেও তাকালো না। এ অবস্থায় হায়েনাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়ল। বাঁচার আশায় গণ্ডারণী পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছু দূর এগোনোর পর আর পারল না। আহত শরীর এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সে জমিনে লুটিয়ে পড়ল। তার রক্ত ও মাংসের গন্ধ সম্ভবত আশপাশের হায়েনার দলের নিকট পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে দলে দলে নতুন হায়েনা এসে বিশালদেহী গর্ভবতী গণ্ডারণীর দেহটি সাবাড় করতে আরম্ভ করল।

উল্লিখিত ঘটনার সাথে আমাদের সমাজের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার রেশ আমাকে কিভাবে অবসন্ন করে তুলছে তার কয়েকটি উদাহরণ দিলেই সম্মানিত পাঠক আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারবেন। গত বেশ কয়েক দিন ধরেই দেশের টেলিভিশনগুলোতে একটি দুর্নীতির খবর একযোগে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। রাজধানীর গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন একটি মার্কেট থেকে কে কিভাবে এবং কখন প্রায় ৭০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেছে তার খবর প্রচারিত হচ্ছে। মার্কেটটির হাজার হাজার দোকান মালিক তথ্যপ্রমাণসহ রাস্তায় নেমে অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আহাজারি করছেন, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো কর্তা কিংবা সংস্থা এত্তবড় জলজ্যান্ত রাহাজানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তাদের হস্ত মোবারক বা কদম মোবারক একটু নাড়াচাড়া করেছেন অথবা আকারে-ইঙ্গিতে একটু ফিসফাস করেছেন এমনটি আমরা শুনতে পাইনি। ফলে রাহাজানির জঙ্গলের হায়েনারা কী পরিমাণ উল্লাসনৃত্য শুরু করেছে এবং আগামী দিনে তাদের হিংস্র থাবা কোথায় কার ওপর কিভাবে পড়বে এই চিন্তায় আমি পেরেশান হয়ে পড়েছি।

রাষ্ট্রের কাছে আমি যে ন্যায়বিচার আশা করি এবং প্রয়োজনে আশ্রয় নেয়ার চিন্তা করি তা ক্রমেই ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়ে পড়ছে। আমি এখন ভেবে পাচ্ছি না, কোনটি রেখে কোনটি বলব অথবা কার কাছে গিয়ে কার বিরুদ্ধে বিচার দেবো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন আমাদের দেশে তার কাউন্টার পার্টের সাথে ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বন্ধুত্বের বাণী শোনাচ্ছিলেন তখন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত বাংলাদেশী দরিদ্র যুবক জাহিদুলের লাশ পড়েছিল কাঁটাতারের নিচে। ঘটনা শুধু এখানেই শেষ নয়, দুই প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্মিত হাস্যময় বদন নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যায় ভারত একতরফা দায়ী নয়! আমাদের কিছু দুষ্ট ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সীমান্তের ওপারে যায় এবং তাদের কাছে অস্ত্র থাকে। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ভয়ের চোটে গুলি করে থাকে।

তিনি আরো বলেন, অপরাধীরা সেখানে বোমা নিয়ে যাবে। বন্দুক নিয়ে যাবে। বিএসএফের ওপর আক্রমণ করবে। এটা তো ঠিক নয়। তাছাড়া যেটাকে বর্ডার কিলিং বলা হয় সেটি আসলে কিলিং ইনসাইড ইন্ডিয়া। দুষ্টরা ভারতের ভেতরে গিয়ে আক্রমণ করে এবং ভারত আত্মরক্ষার্থে তাদের ভূখণ্ডের মধ্যে গুলি করে দুষ্টদের মেরে ফেলার পর এ দেশের লোকজন সেটিকে বর্ডার কিলিং বলে ফেলেন! সূত্র : মানবজমিন, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্যের আগে আরো একটি বক্তব্য সারা দেশে রীতিমতো আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। সেবারও তিনি অর্থপূর্ণ মুচকি হাসিতে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন যে, তার হাতে একটি তালিকা এসেছে যেখানে উল্লেখ রয়েছে, কারা কারা বেগমপাড়াতে অর্থাৎ কানাডাতে বাড়ি গাড়ি করেছেন এবং দেশ থেকে অঢেল অর্থ পাচার করেছেন।

তিনি তালিকায় বর্ণিত টাকা পাচারকারীদের পরিচয় জানার পর বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন। কারণ তার ধারণা ছিল তালিকায় হয়তো রাজনীতিবিদ অথবা ব্যবসায়ীদের নাম থাকবে। কিন্তু বাস্তবে যাদের নাম ছিল তাদের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সবাই আশা করেছিল, অভিযুক্ত আমলাদের পদচ্যুত ও গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু সেটি তো হয়ইনি বরং উল্টো অভিযুক্তদের কেউ কেউ পদোন্নতি লাভ করেছেন, কারো কারো সাহস শক্তি বেড়ে গেছে এবং অনেক দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আমাদের সমাজের নানাবিধ অনাচার, ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি অনিয়ম, রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতি সহ্য করতে করতে আমরা কতটা অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি এবং সমাজের হায়েনারূপী দুর্বৃত্তরা কতটা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে তার একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব।

বাস্তব যে ঘটনাটি বলব সেটি ঘটেছে মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায়। যার সাথে ঘটেছে তিনি সমাজের বিত্তবান সম্মানিত এবং প্রভাবশালী হিসেবে বহুদিন ধরে সর্বজন স্বীকৃত। ভদ্রলোক যখন আমার কাছে ঘটনাটি বললেন তখন আমার বারবার গণ্ডারের দল, অরণ্য এবং হায়েনার পালের কথা মনে পড়ছিল। ভদ্রলোকের নিজের মুখে সে রাতের কাহিনী শুনলেই আপনারা খুব সহজে পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারবেন।

ঘটনার রাতে আমি আমার কিশোর পুত্রকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম, যেখানে আমি গত ২৫ বছর ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছি। যে সড়কে আমার বাসস্থান সেটি এখন রীতিমতো ভিআইপি এলাকা। সড়কের মাথায় সর্বদা দশ-বারোজন পুলিশ বসা থাকে। সড়কে যেসব বাড়ি রয়েছে যেগুলোর মধ্যে একটিতে থাকেন একজন ভিভিআইপি যার বাড়ির সামনে দু’জন পুলিশ সর্বদা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যান্য কয়েকটি বাড়িতে ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্তা ও পুলিশ কর্তারা থাকেন যারা সবসময় পুলিশের প্রটোকল নিয়ে চলেন এবং অস্ত্রধারী বডিগার্ড তাদের ঘিরে রাখে। কয়েকটি বাড়িতে ভয়ঙ্কর পোষা কুকুর রয়েছে এবং রয়েছে অনেক দারোয়ান। এ ছাড়া রাস্তায় দশ-বারোটি বেওয়ারিশ কুকুর অনেকটা পোষা কুকুরের মতোই ঘোরাফেরা করে এবং অচেনা লোক দেখলে ঘেউ ঘেউ করে। ফলে এমন একটি স্থানে বসবাস করতে পেরে আমি নিজেকে নিরাপদ ভাবতাম।

ঘটনার রাতে আমার গাড়িটি যখন গলিপথে ঢুকল তখন অদূরে একটি পিকআপ ভ্যান মাঝপথ দখল করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ড্রাইভার ট্রাফিক বিধিমতে ডিপার লাইট জ্বালিয়ে পিকআপটিকে সাইডে যাওয়ার সিগন্যাল দিলো। পিকাপ সরে গেলে আমরা স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি চালিয়ে যেই না বাসার গ্যারেজে ঢুকলাম ওমনি একটি মোটরসাইকেলে দুই যুবক এসে গাড়ির পেছনে জোরে থাপ্পড় দিতে দিতে বলল- ধর শালারে- এই শালারপুত- এই খানকির পুত নাম। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এবং আমার কিশোর পুত্র রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। আমার জীবনে এ ধরনের ঘটনা কোনো কালে ঘটেনি এবং কোনো দিন এমনতরো দৃশ্য দেখিনি। ফলে পুরো পরিস্থিতি আন্দাজ করতে আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে আশপাশে তাকালাম। আমাদের বাড়ির দু-তিনজন দারোয়ান এবং চার-পাঁচজন ড্রাইভার পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল। পাশের বাড়িগুলোর দশ-বারোজন দারোয়ান, ততোধিক ড্রাইভার এবং পুলিশ তামাশা দেখতে থাকল। অন্যান্য সময় রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরগুলো থাকে- সে রাতে তারাও কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। আমি যুবকদের জিজ্ঞাসা করলাম- কী হয়েছে। তারা বলল, আপনার কিছু হয়নি। আপনার ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামতে বলুন। ওকে মারব! ও বেয়াদবের মতো ডিপার লাইট জ্বালাল কেন। আমরা ওমুক দলের তমুক নেতা-গত ছয় সাত মাস ধরে আয় রোজগার নেই। মাথায় রক্ত চেপে থাকে।

শালারপুত ড্রাইভাররা যদি লাইট জ্বালিয়ে আমাদের ওপর ফেলে তবে রক্তে আগুন ধরে যায়। আমি যুবকদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারলাম না। তারা ড্রাইভারকে না মেরে কোথাও যাবে না। আমি তাদের দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার কথা বললাম। এতে তারা আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল এবং নেতাদের বাপ-মা তুলে অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করল। তারা আমাকে ড্রাইভারের পক্ষ নিতে নিষেধ করল। অন্যথায় গাড়ি ভেঙে ফেলার হুমকি দিলো। আমার হঠাৎ আইজি সাহেব, র‌্যাব বা নিউ মার্কেট থানার ওসির কথা মনে পড়ল। কিন্তু যুবকদের রণমূর্তি এবং উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের নীরবতা দেখে কিছু বলতে সাহস পেলাম না। এরই মধ্যে একজন ড্রাইভার আমার ড্রাইভারকে কী যেন চোখের ইশারায় ইঙ্গিত দিলো। ড্রাইভার আমাকে বাসায় যেতে বলল। পরে শুনলাম, যুবকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার পর সিনক্রিয়েট করে ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা, পথচারীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে এবং মহল্লার সবাই সেটি জানে এবং অবনত মস্তকে মান্য করে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য