মর‌গান : ভাগ্যের ফেরিওয়ালা

  • আফফান উসামা
  •  ২৯ জুন ২০২২, ০৬:৫১

মর‌গান : ভাগ্যের ফেরিওয়ালা – ছবি : সংগৃহীত

উঁচু তর্জনী মুহূর্তেই নামিয়ে হাত দুটি ডানার মতো মেলে যেদিন উড়ছিলেন রুবেল, মেতেছিলেন উল্লাসে, ভাসিয়েছিলেন উচ্ছ্বাসে; অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন সেদিনে ‘ইংলিশ ক্রিকেটের সলিলসমাধি হয়ে গেল বুঝি এডিলেড ওভালে!’ বাঙালির শিহরণ জাগানো সাফল্য যেদিন কাঁপিয়েছিল বিশ্বকে, ব্যর্থতার দগ্ধ দহন সেদিন কাঁদিয়ে ছিল ক্রিকেটের জন্মভূমিকে। ওই সামগ্রিক চিত্রটা বোঝাতে নাসের হুসাইনের সেই ভাষ্যটাই যথেষ্ট ‘ওয়ান অফ দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন বাংলাদেশ হিস্ট্রি, ওয়ান অফ দ্য লোয়েস্ট পয়েন্টস ইন ইংলিশ হিস্ট্রি।’

হয়তো সান্ত্বনা দিয়ে বলাই যেত, ‘ক্রিকেট তো এমনিই অনিশ্চয়তার খেলা। কখন কী ঘটে যায়, তা যায় না বলা।’ তবে তার জবাব দিতে প্রস্তুত পরিসংখ্যানের পাতা। ‘১৫-এর ক্রিকেট মহারণের সেই আসরে ব্রিটিশ ক্রিকেটের বিবর্ণ রূপ দেখেছিলো বিশ্ব৷ ক্রিকেট জন্মভূমির এমন মলিনতা যেন বড়ই নৃশংস, বড্ড করুণ দৃশ্য। ছয় ম্যাচের চারটিতেই হেরে যে বিদায় নিয়েছিল তারা।

বিষন্ন ব্রিটিশ আকাশে তখন শুধুই কালো মেঘ। আর্তনাদের করুণ সুর, হৃদয় যেন করছে এফোঁড়-ওফোঁড়। গল্পের ভূমিকা থেকে উপসংহার, সবটাই যেন শোকগাঁথা। সবাই বিভোর কিভাবে ভুলা যায় এই তিক্ত ব্যথা। নাবিক হয়ে বিধ্বস্ত জাহাজ কে পৌঁছাবে তীরে? এ যেন কবি নজরুলের “দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ/ ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

প্রশ্নটা যখন বড় হতে চলেছে, তখন আস্থা একজন ভিনদেশীতে। স্বপ্ন যার আকাশ সমান, আর সাহস যেন তার সীমানা পাড়। আর সাহসীরাই তো সফল হয়। ফলে বিপর্যস্ত দলটার খোলস পাল্টে নতুন মোড়কে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। দু’মাসেই বিশ্ব দেখল ইংলিশ ক্রিকেটের নতুন নমুনা। মাঠে নামে ওরা বাজিয়ে দামামা! যেন যুদ্ধে নেমেছে, প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করতেই হবে৷ হয়তো জেতো, নয়তো ভাগো…

ইংল্যান্ডের নতুন রূপের আগুনে পুড়ে ওই বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। আর সেই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেই ইংলিশরা তুলেছিল ৪০৮ রান! তারপর আরো চারবার ৪০০+ রান সংগ্রহ করে তারা। এই সময়ে শুধু ভারতই একবার ৪০০ পেরোতে পেরেছে। শুধু ৪০০-তেই আটকে নয়, দলীয় সর্বোচ্চ দুটি স্কোরও থ্রি লায়ন্সদেরই নামে! ৪৯৮ রানের সর্বোচ্চ স্কোরটা তো আজও স্মৃতিতে অম্লান।

যাহোক, সাহসী এই বিপ্লবে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এক আইরিশ। জন্মেছেন আয়ারল্যান্ডে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও শুরু আইরিশদের হয়েই। নেতৃত্বও দিয়েছেন দেশকে৷ আছে সেঞ্চুরিও। কিন্তু শৈশবের স্বপ্ন ছিল ইংলিশদের হয়ে খেলার। সেই স্বপ্ন পূরণে ২০০৯ সালে থিতু হয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সেই বছরই ডাক পেয়ে যান থ্রি লায়ন্সদের দলে। আর অধিনায়কত্বটা পেয়ে যান এলিস্টার কুকের ব্যর্থতার বদৌলতে ২০১৪ সালে, বিশ্বকাপ পর্বের পূর্বে।

ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন, নিজেকে প্রস্ফুটিত করবেন, একদিন পৃথিবী জানবে তার নাম। কিন্তু কখনো কি ভেবেছিলেন, একদিন বিশ্বসেরার শিরোপাটাও উঁচু করে ধরবেন? অথচ জাত্যাভিমান ভুলে গেছে, অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে; যখন দায়িত্ব দেয়া হলো তার হাতে, কত প্রশ্নই না উঠেছিল তাকে ঘিরে।

পরের গল্পটা তো সবার জানা? ভাষায় কি যায় তাকে প্রকাশ করা? শুধু ভাবেন, আজ থেকে এক যুগ আগে কোনো জ্যোতিষী যদি তাকে ২০১৯ বিশ্বকাপের বিশ্বজয়ী অধিনায়ক হবার ভবিষদ্বাণী করতেন, তবে তিনি নিজেই হয়তো সেটা হেসে উড়িয়ে দিতেন। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। জীবন কাকে কখন দাঁড় করিয়ে দেয়, তা কী আর বলা যায়! তবে তাকে ভাগ্যবান বলাই যায়। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তার নামটা চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। সাফল্যের মুকুট শিরে তার প্রতিচ্ছবি লেগে থাকবে চোখে। তবে তবুও দিনশেষে বলতে হচ্ছে ‘সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ মরগান!’