“মনের পশু কোরবানি” দেয়ার প্রবক্তা আসলে কারা ? 

“মনের পশু কোরবানি” দেয়ার প্রবক্তা আসলে কারা ?
===================================
এক. .
মুসলিম উম্মাহর এক অসহায় জনপদের নারী ও শিশুদের লাশ পাশে নিয়ে আমরা কুরবানির ঈদ পালন করছি । এটা আমাদের বিবেককে একটুও নাড়া দিচ্ছে না । বরং রাজপরিবারের এক শক্তিশালী সদস্য এই ঈদকে জাতির জীবনে সবচেয়ে খুশীর ঈদ হিসাবে ঘোষণা করেছেন । এই অত্যধিক খুশীর কারণ অষ্ট্রেলিয়াকে ক্রিকেট খেলায় আমরা হারিয়েছি । ক্রিকেটের আনন্দ আমাদের সাম্প্রতিক বন্যার সকল যাতনা ও কষ্টকেও যেন ঢেকে দিয়েছে । ক্রিকেট এখন জাতির জন্যে ব্যথা নাশক আফিম হয়ে পড়েছে ।

দয়া করে এই অধমকে আবার ক্রিকেটের রাজাকার বা এমন কিছিমের কিছু ভেবে বসবেন না । আমি খেলাধূলাকে খেলাধূলার জায়গাতেই রাখতে চাই । জাতির এই ক্রিকেট উন্মাদনা দিয়ে ২৫ শে ফেব্রুয়ারীর পিলখানার বেদনাকেও ঢেকে ফেলা হয়েছে । এগুলো কি নিছক কাকতালীয় , নাকি একটা রোডম্যাপ ধরে এগুলো করা হচ্ছে , তা বোধগম্য হচ্ছে না ।

খেলাধূলা এখন শুধু রাজনীতিতে নয় , আমাদের ধর্মীয়বোধকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে । ক্রিকেটের আনন্দকে এখন ধর্মীয় উৎসবের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে । প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটার শাকিবকে যেভাবে মুখে মিষ্টি তুলে দিয়েছে , একজন শাশুড়ি তার প্রিয় মেয়ে জামাইকেও তেমন করে মুখে খাবার তুলে দেয় না । কারণ মেয়েকে প্রচন্ড সোহাগ করলেও শাশুডিদেরকেও মেয়ে জামাইদের সম্মুখে একটু গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হয় । এটা শুধু আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিকতার নিরিখেই অশোভন নয় – প্রধানমন্ত্রীর পদ ও প্রটোকলের জন্যেও বেশ বেমানান । পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান কোনও নাগরিকের কোনও বিশেষ কৃতিত্বের জন্যে উচ্ছসিত হয়ে মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন – এমন দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছেন কি না জানি না । বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছে – সেটা আরও অচিন্তনীয় ব্যাপার !

আমরা এখন ক্রিকেটের বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘ বনের পশু মনের পশু ‘ কোরবানি দেয়া শুরু করেছি । মনের পশুকে বলি দেয়ার এই তত্ত্বটি কোথা থেকে এলো জানি না ।
কোরবানির সময় এলেই এদেশের এক শ্রেণীর অতি বিবেকবান গোষ্ঠীর পশুপ্রেম মাথাচাড়া দিয়ে উঠে । সারা বছর মাংসভোজী থাকলেও বছরের এসময়ে এসে এরা মাত্রাধিক পশুপ্রেমি হয়ে পড়েন । কেউ কেউ কোরবানি না দিয়ে সেই টাকা খরচ করে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন । বন্যার্তদের সাহায্য করার নিমিত্তে এদের অন্য কোনও সোর্স আর চোখে পড়ে না । এদের চোখ পড়ে খালি কোরবানির বাজেটে , হজ্বের বাজেটে । নানা কাজে রাষ্ট্রীয় সম্পদের নয়ছয় করা হচ্ছে , কথায় কথায় কলকাতা , দিল্লী , সিঙ্গাপুর , ব্যাংকক , দুবাই , লন্ডন যাচ্ছে । সেগুলো এই মানবতাবাদীদের চোখে পড়ে না , এদের উদ্দেশ্যে কোনও উপদেশ থাকে না । এই গোষ্ঠীটিই মূলত: মনের পশু বলি দেয়ার তত্ত্বটি আমদানী করেছেন ।

অথচ যাকে অনুসরন করে এই উৎসবের শুরু সেই ইব্রাহিম (আ:) এর কর্মকান্ডে ‘ বনের পশু -মনের পশু ‘ তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । খুঁজে পাওয়া যায় অন্য কিছু । কবি কাজি নজরুল ইসলাম তার কোরবানি নামক কবিতায় কোরবানির এই উদ্দেশ্যটি চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন । দেখুন সেই ‘কোরবানি ‘ কবিতার কয়েকটি লাইন ,

” ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন !
দুর্বল! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন !
ধ্বনি উঠে রণি’ দূর বাণীর, –
আজিকার এ খুন কোরবানীর !
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির সেরা আজি !- রহমান কি রুদ্র নন ?
ব্যাস ! চুপ খামোশ রোদন !
আজ শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে , শির দে বৎস” শোন !
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন । ”

যুগ যুগ ধরে বাবা ইব্রাহিমদের উপর আল্লাহর চিরন্তন নির্দেশ – তোমাদের ছেলেদের সত্য ও ন্যায়ের পথে উৎসর্গ কর। কবি চমত্কারভাবে সেই নির্দেশটি ফুটিয়ে তুলেছেন ,

“এয়্ ইবরাহীম্ আজ কোরবানী কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন !”
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন।

এই কোরবানি মা হাজেরাদের শেখাচ্ছে নিজ নিজ ইসমাইলদের সাজিয়ে দিতে। কবির কথায় ,
” এতে মা রাখে পুত্র পণ !
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরা’লো বলির পূত বসন !
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদবোধন। ”

কাজেই ” মনের পশু বনের পশুর ” ভাবালুতা নয় – নমরুদ -ফেরাউন সম্বলিত বাস্তব জগতের একটি কঠিন প্রেরণা জড়িয়ে আছে এই উৎসবটিতে । নমরুদ – ফেরাউনরা যত দিন এই দুনিয়ায় টিকে থাকবে , ততদিনই এদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণাটি জাগ্রত রাখতে হবে । কোরবানির শিক্ষা মূলত এটাই । সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে , আজ ফেরাউন নমরুদের চরগণই – ” মনের পশু বনের পশু ‘ এই তত্ত্ব হাজির করেছে ।

সবাই ভালো থাকুন । নিরাপদে থাকুন । কোরবানির মূল স্পিরিটে উজ্জীবিত থাকুন । সবাইকে ঈদ মোবারক ।