ভোটের উৎসাহে ভাটা নগরবাসীর

২১ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও ভোট নিয়ে আগ্রহে ভাটা দেখা যাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই অধিকাংশ এলাকায় ব্যালটবাক্স ভরে রাখার ঘটনা ঘটে। এসব খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় ভোটে উৎসাহ নেই নগরবাসীর।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে বলে জনগণ বিশ্বাস পাচ্ছে না। জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না, নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে কি না, যে প্রার্থীকে ভোট দিতে চায় তাকে ভোট দিতে পারবে কি না।

ইভিএমে ব্যাপক জালিয়াতির সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইভিএম সম্পর্কে জনগণের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা নিজেরাই ভোট দিয়ে দিতে পারে। সাধারণত একটি বুথে একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ইভিএম মেশিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। তাকে সহযোগিতার জন্য থাকেন দুইজন পোলিং অফিসার। আর ভোটকক্ষে উপস্থিত থাকেন বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টরা। একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্মার্টকার্ড বা ফিঙ্গার প্রিন্ট দ্বারা কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটার শনাক্তের পর তিনি ভোটদানের জন্য বিবেচিত হবেন।

এ সময় ভোটকক্ষের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বা প্রভাবশালী প্রার্থীর এজেন্ট অনেক ক্ষেত্রে জোরপূর্বক গোপনকক্ষে স্থাপিত ব্যালট ইউনিটে পছন্দের প্রতীকে কনফার্ম বাটনে চাপ দেয়ার উদাহরণ আছে। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত ভোটারকে ভোট না দিয়েই ফিরে আসতে হবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মিললে এক শতাংশ ভোটারকে ভোট দেয়ার ক্ষমতা পাবেন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা। এটিও অপব্যবহারের প্রবল আশঙ্কা আছে।

ভোটাররা বলছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভোটগুলোতে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে রাখার ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রে প্রবেশ করে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, ভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে এসব অভিযোগ লিখিত ও মৌখিকভাবে এলেও তারা সরকারের একপ্রকার সহযোগীর ভূমিকা পালন করে অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ইভিএমেও জালভোট দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে আস্থাহীনতায় ইভিএমে ভোটারদের উপস্থিতিও অনেকাংশ কমেছে। কেননা ভোটকেন্দ্রে ভোটদানের সুরক্ষা ঘাটতির কারণে ভোটদানে মানুষের অনীহা রয়েছে। ইভিএম ত্রুটিমুক্ত হতে পারে; কিন্তু শতভাগ সুরক্ষিত নয় বলে স্বীকার করেছেন ইসি কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইভিএম-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ইসি কর্মকর্তা জানান, ইভিএমের দু’টি ইউনিট; একটি কন্ট্রোল ইউনিট এবং অন্যটি ব্যালট ইউনিট। এর মধ্যে ব্যালট ইউনিটটি অরক্ষিত। কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচিংয়ের পর গোপনকক্ষে সংরক্ষিত ব্যালট ইউনিটে গিয়ে একজনের ভোট দিয়ে দিতে পারেন অন্যজন। কেননা কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা থাকলেও ব্যালট ইউনিটে তা নেই।

বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময় সারা দেশে অর্ধশতাধিক প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ভোটে অনিয়মে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং ভোটের কাজে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা সুষ্ঠু ভোটের জন্য সহায়ক ছিল না।

ভোট-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাবশালী এবং সমাজসেবী, শিক্ষিত, স্থানীয় জনপ্রিয়রা প্রার্থী হতেন; কিন্তু এখন দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় তারা দূরে সরে যাচ্ছেন। এর পরেও নির্বাচিত হয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ না করলে হামলা-মামলার ভয় থাকে।

এ ছাড়াও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে ব্যবহার করে ভোটকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ইসির প্রতি মানুষের আস্থা নেই। কাজেই মানুষ অযথা ভোট নিয়ে ভাবতে আগ্রহী নয়।

নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের ১০ দিন আগে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠক ডেকেছে নির্বাচন কমিশন। আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে আগামীকাল বুধবারের এই বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনারও উপস্থিত থাকবেন।

বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, মহাপুলিশ পরিদর্শক, বিজিবি মহাপরিচালক, র‌্যাব-আনসার ও ভিডিপি /ডিজিএফআই/ এনএসআই মহাপরিচালক; এসবির অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, দুই রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং সব সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।