ভালো নেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তরা

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি

মানিক মুনতাসির

ভালো নেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তরা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মাসিক আয়ের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ায়

ভালো নেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তরা

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি সব সময়ই নিম্ন ও মধ্য শ্রেণির মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। এবার সেটা একটু বেশিই হয়েছে। কেননা গত কয়েক মাস ধরে পিয়াজসহ অন্যান্য সবজির বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। পিয়াজের দাম তো ইতিহাসের রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। তার মতে, আগে মানুষ সব ধরনের মসলার পেছনে যা ব্যয় হতো এখন তারও চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে শুধু পিয়াজের পেছনে। আর আয় বৈষম্য তো আমাদের অর্থনীতির একটি পুরনো ইস্যু। কেননা আমাদের সম্পদগুলো অল্প কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত। ফলে যাদের সম্পদ বেশি তারাই ধনী হচ্ছেন। আর যাদের সম্পদ কম বা সম্পদ নেই তারা আরও গরিব হচ্ছেন।

কেস স্টাডি-১ : খায়রুল হোসেন। বেসরকারি ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা। পরিবারের চাপে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। এখন যা বেতন পান তার একটা বড় অংশ দিয়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করেন। বাকি অংশ দিয়ে বাড়ি ভাড়া দেন। এরপর যা থাকে তা দিয়ে কোনো রকমে সন্তানের স্কুলের বেতন আর মাসিক হিসাবের চাল কেনেন। মাস শেষ হওয়ার আগেই হাত খালি হয়ে যায়। ফলে ধার-কর্য করে চলতে হয় মাসের শেষ সপ্তাহ। এটা এখন প্রায় তিন বছর ধরেই হয়ে আসছে। এরপর হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিতে ঋণ করা ছাড়া কোনো পথও খোলা থাকে না।কেস স্টাডি-২ : রমজান মিয়া রং মিস্ত্রির কাজ করেন। সারা মাসে আয় করেন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। থাকেন খিলগাঁও বউবাজার এলাকায়। দুই রুমের আধা পাকা বাড়ির ভাড়া ৮ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের জন্য আরও ২ হাজার টাকা। এক মেয়ে স্কুলে যায়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। বই কাগজ কলম টিফিন সবই সরকারিভাবে দেওয়া হয়। ফলে মেয়ের স্কুলের পেছনে খরচ নেই বললেই চলে। কিন্তু একজন হাউস টিউটর রেখেছেন। সেখানে প্রতি মাসে গুনতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। পক্ষঘাতগ্রস্ত মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হয় প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা। মাসে খুব বেশি হলে ৪ থেকে ৫ দিন মাছ কিংবা মাংস কিনতে পারেন পরিবারের সদস্যদের জন্য। তাও তেলাপিয়া কিংবা নলা মাছ আর বয়লার মুরগি। কথা প্রসঙ্গে রমজান জানালেন, কোরবানি ছাড়া গরুর মাংস প্লেটে জোটে না।

সরকারি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান টিসিবি এর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর তথ্যমতে, গত এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ। ফলে তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ১০-১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস, নিত্যপণ্য, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ব্যয় বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার বাড়তি ব্যয়। এসব ব্যয় মেটাতে কমে যাচ্ছে সঞ্চয়। নিম্ন আয়ের মানুষ বড় কোনো অসুখ না হলে চিকিৎসা নিচ্ছে না। এমন কি বেশিরভাগ নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ সাধারণ কোনো শারীরিক সমস্যায় চিকিৎসকের কাছে যান না। বরং তারা ফার্মেসিতে গিয়ে সমস্যার কথা বলে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ নিচ্ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে অন্য জটিলতা। অপেক্ষাকৃত কমদামি, মানহীন কিংবা ভেজাল ওষুধের শিকার হচ্ছেন এই শ্রেণির মানুষ। যা মানুষের শরীরে বড় ধরনের সংক্রমণ সৃষ্টি করছে।

ক্যাবের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ১৫টি পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা মূল্য পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গেল ২০১৯ সালে পণ্য ও সেবা মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এক বছরে আটা ময়দার দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, মাংসের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ, মুরগির দাম ৬ শতাংশ, মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ। এককভাবে পিয়াজের দাম বেড়েছে ৭২ শতাংশ। এ ছাড়াও সবজির দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ বছর ভরা শীতকালেও ৫০ টাকার কমে কোনো সবজি পাওয়া যায়নি। এখনো সবচেয়ে কমদামি সবজির মুলার কেজি ২০ টাকা। কাঁচা মরিচের কেজি এখনো ৬০ থেকে ৮০ টাকা। আর পিয়াজের কেজি ১০০-১৫০ টাকা। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ডিসেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে তা আরেক ধাপ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশে। যা নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মূল্যস্ফীতির হিসাবে গরমিল রয়েছে। জানা গেছে, ঢাকায় বছরে দুই বার বাড়ি ভাড়া বাড়ান মালিকরা। এতে এক বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে বারবার জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বাড়ায় বেড়েছে বাস ভাড়া। ফলে বেড়েছে মানুষের যাতায়াত খরচ। অন্যদিকে শিল্প কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়ায় বেড়েছে পণ্যমূল্যও। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন জীবনে। বছর শেষ হতে না হতেই বাড়ে সন্তানদের স্কুলের বেতন। এ ছাড়া রাজধানীর বেসরকারি স্কুলগুলো আছে পুনঃভর্তির খরচ। আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের খরচ তো হরগামেশাই বাড়ে। যেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। অর্থনীতিতে যে সূচক দিয়ে আয় ও সম্পদের বৈষম্য পরিমাপ করা হয় তাকে বলে গিনি কো-ইফিসিয়েন্ট। ওই সূচক অনুসারে ২০১০ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের আয় ছিল দেশের মোট আয়ের দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে তা কমে মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০১০ সালে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় ছিল মোট আয়ের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। এ ছাড়া শুধু আয় নয়, সম্পদে বৈষম্য আরও বেশি।