ব্যাংক ডাকাতির একাল সেকাল

ব্যাংক ডাকাতির একাল সেকাল

ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্যাংক ডাকাতিও শুরু হয়েছে । ডাকাতদের পরনে লুঙ্গির পরিবর্তে প্যান্ট দেখলেই আমাদের পত্রিকাগুলো শিরোনাম করে বসে – ফিল্মি কায়দায় ডাকাতি ।অবশ্য ফিল্মি কায়দায় ব্যাংক ডাকাতির সাথে এক ধরণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি বা খান্দানি ভাব জড়িয়ে আছে । অনেক বড় ঘরের সন্তানেরাও এই ধরণের এডভ্যাঞ্চারে জড়িয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে ।

পুজিবাদের আস্তানা হিসাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে সৌখিন বামপন্থী ডাকাতগণ ডাবল আনন্দ পেতেন । বামপন্থীরাই এই সব ডাকাতিকে সর্বহারার নামে গ্ল্যামারাস করে তুলেছেন । বর্তমান সরকারটিকে মূলত বামপন্থীরাই দখল করে নিয়েছে । কোনও উদ্যোক্তাকে সুদখুরি মহাজন ডেকে আবার অন্য উদ্যোক্তাকে জঙ্গীবাদের সাহায্যদাতা অপবাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে নেয়া হচ্ছে ।

এদেশে ব্যাংক ডাকাতির কিছু ঐতিহাসিক পটভূমিও রয়েছে । ১৯৭১সালে এদেশের মানুষ যখন পাক হানাদারদের তাড়াতে জীবন মরন সংগ্রামে লিপ্ত , সেই সময়েই কারও কারও নজর ছিল তখনকার ব্যাংকগুলি লুটপাটের দিকে । এই সব মহামান্য ব্যক্তিগণ বিশেষ ব্রীফকেস নিয়ে ধবধবে সাদা পান্জাবী পড়ে কলকাতায় জয়বাংলা অফিসে হাজির হতেন । সেই ব্রীফকেসকে কিভাবে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতেন , সেই সব সরস বর্ণনা পরবর্তিতে অনেকের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ।

যাই হোক ধীরে ধীরে এই ব্যাংক ডাকাতির ধরণ ও প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন এসে গেছে । গত দশ বছরে সারা পৃথিবীতেই ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । কিন্তু ডিজিটাল শব্দটি নিয়ে আমাদের মত এমন হাস্যকর চেচামেচি পৃথিবীর কম জায়গায় হয় । অন্য কোন সেক্টর কতটুকু ডিজিটাল হয়েছে – তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ব্যাংক ডাকাতি এবং লুটপাটের জায়গাগুলি এনালগ থেকে শতভাগ ডিজিটাল হয়ে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । এখন ব্যাংক ডাকাতি করতে এনালগ যুগের ছালা , বস্তা কিংবা বন্দুকের দরকার পড়ে না । এখন শুধু ব্যাংকের কোন শাখায় গচ্ছিত সেই দিনের টাকা ডাকাতি হয় না -আস্ত ব্যাংকটিই ডাকাতি হয়ে যায় । এই ডাকাতরা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এত ক্ষমতাধর যে আমাদের অর্থমন্ত্রী মহাশয় এদের নাম নিতে ভয় পেয়ে তওবা তওবা বলে জিভ কেটেছেন ।

২০০৯ সালের পর ভিন্ন ধরণের ব্যাংক ডাকাতি শুরু হয়ে গেছে । স্কুলের সাধারণ শিক্ষিকা থেকে শুরু করে প্রাক্তন ছাত্র নেতারা কোনরূপ পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বড় বড় রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলির পরিচালক বনে গেছেন । ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে । হলমার্কের তানভীরের মত তিন হাজার টাকার গার্মেন্টস কর্মচারীকে কোনরূপ কোলেটারেল ছাড়াই চার হাজার কোটি টাকার লোন দেয়া হয়েছে । এই পরিমাণটিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন পি-নাট । সার্বিক লুটপাটের তুলনায় এটি ছিল আসলেই পি -নাট ।

পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এগুলি নিয়ে লেখালেখির পর হলমার্কের তানভীরকে জেল খানায় আটকানো হলেও এর পেছনে যে উপদেষ্টার নাম এসেছিল তিনি সহ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের একটা লোমও ছেড়া পড়ে নি । দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোও এই নামগুলি প্রকাশ করে নি । বরং সেই সব লুটেরাদের টক শোতে ডেকে জাতিকে বয়ান করার সুযোগ করে দেয় । আসলে এদের ভেতরের গিলা কলিজাও ডিজিটাল হয়ে গেছে । ফলে ঘেন্না পিত্তি লজ্জা শরম এদের মাঝে কিছু আর অবশিষ্ট নেই ।

সরকারী ব্যাংকগুলি খাওয়ার পর নজর পড়েছে বেসরকারী ব্যাংকগুলির প্রতি । বেসরকারী পর্যায়ে দুটি ব্যাংক অত্যন্ত সফল হয়েছে । সেই সফল দুটি ব্যাংকই এদের নজরে পড়ে গেছে । প্রথমে টার্গেট করা হয়েছে গ্রামীন ব্যাংককে । তারপর নজর পড়েছে ইসলামী ব্যাংকের প্রতি ।

এই সরকারের জমানায় গ্রামীন ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক হয়ে পড়েছে গরীবের ঘরে সুন্দরী বউয়ের মত । যারা দুর্নীতি নিয়ে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের মধ্যে এতদিন অন্যায্য তুলনা ( False equalization ) করে এসেছেন, বেগম জিয়া এবং হাসিনাকে একই মুদ্রার এপিঠ এপিঠ বলেছেন , তারাও এই বিষয়টির খুব গভীরে যেতে পারেন নি । আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্যে প্রধান দুটি দলই দায়ী হলেও রাজনৈতিক দর্শনে তাড়িত হয়ে ছলে বলে কৌশলে এভাবে প্রাইভেট প্রপার্টি হস্তগত করার বিষয়ে দুটি দলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে । আওয়ামী ভাবাপন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার প্রচুর এসেট বা সম্পদ এদেশে রয়েছে । বিএনপি তাদের দীর্ঘ সময়ের শাসন কালে তার একটাও দখল করে নি । এমনকি এরশাদের জাতীয় পার্টিরও এই বদনাম নেই ।

গরীবের বউকে হস্তগত করার আগে সেই গরীবের চরিত্র ও অক্ষমতা সম্পর্কে বদনাম ছড়িয়ে দেয়া হয় । পাবলিকের চোখ তখন মোড়লের কুটনামীর চেয়ে করিমের বিভিন্ন দোষত্রুটি বা অক্ষমতার আলোচনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে । নিজেদের অপ কর্মকে জায়েজ বা সমাজের কাছে সহনীয় বানানোর জন্যে মোড়ল গোছের লোকজন সালিশ বসাতো । এখন ডিজিটাল যুগে সালিশের পরিবর্তে বসেছে সেমিনার বা গোলটেবিল আলোচনা । দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীগণ সেই সব সেমিনারে উপস্থিত হয়ে জাতির কাছে বয়ান করেন এই দখল কর্মের মাধ্যমে জাতি কিভাবে উপকৃত হচ্ছে ।

মশকরা শব্দটির সাথেই চরম মশকরা শুরু হয়ে গেছে । নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যে বেগম খালেদা জিয়া তার কিছু প্রস্তাবনা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির নিকট পেশ করেছিলেন । তার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন , বেগম জিয়া জাতির সাথে ‘মশকরা’ করছেন ।

বেগম জিয়ার এটি মশকরা হয়েছে কিন্তু যারা ইসলামী অর্থনীতি (ও জীবনধারার অনেক অংশ) কে আজীবন মৌলবাদী অর্থনীতি বলে উপহাস করলেন , ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন , ইসলামী ব্যাংকের সাথে সাথে হাসপাতালকেও মৌলবাদী হাসপাতাল ডেকেছেন , রাতারাতি তারাই হয়ে গেছেন ইসলামী অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমঝদার ! এগুলি জাতির সাথে মশকরা হয় নি ।

মাস্তে মাস্তে করে যারা আস্ত জীবন পার করেছেন এবং এখনও তাই করছেন সেই আরস্ত খানরাই হয়ে পড়ছেন ইসলাম ও ইসলামী অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সেবক । মশকরা এখানেই শেষ হয় নি । ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথাও এরা জাতিকে শোনাচ্ছেন । এখন শুধু বাকি আছে সম্ভবত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটি জানানোর ।

ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের টাকা দিয়ে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে । ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক শামীম আফজাল এবং সরকার ঘরানা বুদ্ধিজীবীদের লাফালাফি দেখেও উক্ত দখলকর্মে সরকারের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে । আরস্তু খানরা দেশে এখন রবিন হুডের অর্থনীতি চালু করে দিয়েছেন । অর্থাৎ একজনের সম্পদ ছিনিয়ে অন্যজনকে দিবেন ।

দেশের অর্থনীতি ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর সরকারের এই অপকর্মটির বিরুদ্ধে দেশের সচেতন নাগরিকদের যেভাবে প্রতিবাদ করার কথা ছিল , বাস্তবে তা হয় নি । ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীদের মাথা থেকে সকল বুদ্ধি উধাও হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ।
তন্মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুকে লিখেছেন, জামায়াতে ইসলামী-মুক্ত করাটা হচ্ছে ভান-ভনিতা। আমি বিশ্বাস করি ইসলামী ব্যাংক দখল করা হয়েছে আসলে একে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য। ”

যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরুণ গবেষক ও লেখক শাফকাত রাব্বি অনিকের ফেইস বুক পোস্টিংটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ দিয়েছে । তার পুরো লেখাটিই তুলে ধরলে পাঠকগণ আরো উপকৃত হবেন । এই তরুণ লেখক ও গবেষক লিখেছেন ,

‘ ‘ দেশের সব চাইতে বড় বেসরকারী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে সরকারের দলীয় লোকজন দিয়ে দখল করে নেয়া হলো। এর আগে গ্রামীন ব্যাংকেও হাত দেয়া হয়েছে। এই ঘটনা গুলো ইতমধ্যেই গতানুগতিক ঘটনা হয়ে গেছে। এগুলোর দীর্ঘ মেয়াদী ফলাফল ভোগ করবে বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর।

১) যেকোন দেশের অর্থনীতি গতিময় রাখার একটা মূল উপাদান হলো সেই দেশের Ownership Law এবং Ownership Protection. মানে কোন প্রতিষ্টান বেসরকারী খাতে বানানোর পরে কোন দেশে সেই বেসরকারী প্রতিষ্টানের মালিকানা কতোটা নিরাপদ সেটার উপর সেই দেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভর করে। পৃথিবির সবচাইতে বিনিয়োগ বান্ধব Ownership Law এবং প্রটেকশন পাওয়া যায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিংগাপুর, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইডেন সহ গুরুত্বপূর্ন আরো কিছু অর্থনীতিতে। যে কেউ এইদেশ গুলোতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বানায় নিশ্চিত থাকতে পারে সেই মালিকানায় সরকার কোনদিন হাত দেবে না।

২) বিনিয়োগ দুই প্রকারের হয়। একটা হলো ইকুইটি (Equity) বিনিয়োগ (যেমন শেয়ার কেনা), আর একটা হলো Debt বা লোন বিনিয়োগ। বিদেশী সংস্থা বা ব্যাংক যখন debt investor হিসেবে আসে তখন তাদের ক্রেডিট কমিটি একটা রেটিং দেয়, ভালো রেটিং না থাকলে লোন পাওয়া যায় না। এই রেটিং এর ক্ষেত্রে বেসরকারী মালিকানা কতটা শক্তিশালী তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। যেসব দেশে গত ২৫ বছরে সরকার কর্রতৃক বেসরকারী প্রতিষ্টান অধিগ্রহনের ইতিহাস থাকে সে সব দেশের বেসরকারী বিনিয়োগের রেটিং অনেক দূর্বল হয়।

৩) গ্রামীন ব্যাংক কিংবা ইসলামী ব্যাংক অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। এই দুইটা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক ইতিহাস বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের বিদেশী লোন কিংবা ইকুইটি মার্কেট এক্সেস করার সুযোগ দীর্ঘ দিনের জন্যে কঠিন করে দিল। এই ব্যাপারটা বুঝার মতো লোক বাংলাদেশে কম থাকা স্বাভাবিক। কেননা সত্যিকার অর্থের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পরিবেশ এখানে নাই। কিন্তু থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।

৪) একাধিক বিদেশী ইনভেস্টর ইতোমধ্যেই তাদের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। যারা ছেড়েছে তাদের অনেকেই বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের অভিজ্ঞতা ব্যাংকিং সার্কেলে গল্প হিসেবে ঘুরতে থাকবে। ব্যানকিং সার্কেল্টা খুব ছোট এবং এই সার্কেল কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা সহজে ভুলে না।

ইসলামী ব্যাংক খেয়ে ফেলার মাধ্যমে চেতনার বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরের যে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি হলো, তার ক্ষতি চেতনার কারিগররা পোষাতে পারবে না।”

সত্যিই অনিকের এই বক্তব্যটি অনুধাবনের মত মেধা শামীম আফজাল এবং শাহরিয়ার কবিরদের নেই । এই চেতনাজীবীদের দৃষ্টিতে অনিকের মত তরুণ গবেষক ও লেখকরাও হয়ে পড়বেন রাজাকার । অথচ জাতির দুর্ভাগ্য এই মাপের লোকদের হাতে পড়েছে সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবি কাঠি । বিভিন্ন সভা সেমিনারে এদের বকবকানি সারা জাতিকে শুনতে হয় ।

কয়েক বছর আগে শিপ বিল্ডিং এ বাংলাদেশে একটি অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল । বর্তমান বিশ্ব মন্দার কারণে তা আবার হোঁচট খেয়েছে । তখন আমি নিজেও একজন বিদেশী উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্যে উৎসাহিত করি । বাংলাদেশের সস্তা শ্রম দিয়ে শ্রম ঘন এই শিল্পে কেমন লাভজনক হবে তা বুঝিয়ে বলি । আমার কথার জবাবে বলে , তোমার সবকিছু ঠিক আছে । তোমার বর্ণিত হিসাব দেখে আমি দারুনভাবে উচ্ছসিত ! কিন্তু বলো , এই বিরাট লাভের টাকা আমি তোমাদের দেশ থেকে ফেরত আনতে পারবো তো ? আমার এই বিনিয়োগ যদি তোমাদের দেশের অন্য কোন মাফিয়া গ্রুপ দখল করতে চায় তখন তোমাদের রাষ্ট্র এবং আইন কানুন তার কতটুকু প্রটেকশন দিতে পারবে ? আমার বিলিয়ন ডলার আরেকজন মিলিয়ন খরচ করে কুক্ষিগত করে ফেলবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় ?

মজার ব্যাপার হলো , ইন্ডিয়া তাদের দেশের কোন গ্রামীন ব্যাংক কিংবা ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা এরূপ ছলে বলে কলে কৌশলে কখনই দখল করবে না । কারণ তারা ভালো করেই জানে এর ফলে তাদের বিনিয়োগ বান্ধব রেটিং নিচে নেমে যাবে । কিন্তু এরাই আবার আমাদের চেতনাকে শানিত করে দিবে , উৎসাহ যোগাবে গ্রামীন ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক দখল করে নিতে ।

এই সব হিসাব যাতে যুব সমাজের মগজে ঢুকতে না পারে তজ্জন্যে নাহিদরা উদগ্রীব হয়ে আছেন দেশে জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়াতে । জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে নাহিদ -জাফররা যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন , তার পেছনের মাজেজা বোধ হয় এখানেই নিহিত রয়েছে । আসিফ নজরুলের উদ্বেগ এই নতুন প্রজন্মকে স্পর্শ করবে না , অনিক যা বোঝাতে চেয়েছেন ইয়াবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা প্রজন্মের বড় অংশের মগজে এই হিসাব কখনই ঢুকবে না । গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এরা সাধারণ মানের একজন এক্সিকিউটিভ হতে পারবে না । কারণ একটা লাইনও শুদ্ধ করে লিখতে পারবে না । আমরা এক্সিকিউটিভ আমদানী করব পাশের দেশ থেকে । কয়েক কোটি শ্রমিক গতর খেটে বাইরে থেকে যে ডলার আনবে , কয়েক লাখ এক্সিকিউটিভ সেই পরিমাণ ডলার নিয়ে যাবে । আরস্তু খানদের রবিনহুড অর্থনীতি সেদিকেই দেশটিকে নিয়ে যাচ্ছে । এগুলি নিয়ে যারাই কথা বলবে – তারাই হবে রাজাকার , জঙ্গী ।

আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা । এগুলি মানব জাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ । রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণেই কোটি কোটি মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে । নিজেদের জান , মাল সকল কিছুকে নিরাপদ ভাবতে পারে । সেই আশীর্বাদ এই হতভাগা জাতির জন্যে অভিশাপ হয়ে পড়ছে ।

কারণ সেই রাষ্ট্র যদি রক্ষকের ভূমিকা থেকে ভক্ষক হয়ে পড়ে তখন সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রশ্ন দেখা দেয় । রাষ্ট্র শক্তিকে এই ধরনের অপকর্মে নিয়োজিত করলে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারনাটিই মারাত্মক ধাক্কা খায় ।

শক্তিসালী সিভিল সোসাইটি ছাড়া একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না । এই ধরণের সিভিল সোসাইটির অভাবে আমরা বোধ হয় চূড়ান্ত ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হতে চলেছি । চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে দুটি পত্রিকা কিছু না দেখেই বাঘ বাঘ বলে চিৎকার দিয়েছেন , আজ সত্যিকারের বাঘ দেখেও সেই রাখাল বালকেরা চুপ মেরে গেছেন ।

ইসলামী ব্যাংককে নিয়ে সরকারের মানসিকতা অনেকটা সেই সুয়ো রাণীর মত মত যিনি দুয়ো রাণীর ছেলেকে পাঠিয়েছেন বাঘ শিকার করতে । সৎ ছেলে কিংবা বাঘ যেটিই মরুক সেটিতেই সুয়োরাণীর লাভ ।

সুয়ো রাণীর এই হিসাব এবার পাল্টে যেতে পারে । ইসলামী ব্যাংক ভক্ষণ সরকারের জন্যে মারাত্মক গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে । এই ব্যাংকটি যদি ধ্বংস হয়ে যায় তবে সরকারের লুটেরা চরিত্রের আরেকটি নমুনা প্রতিষ্ঠিত হবে ।

গ্রামীন ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক উভয়েই প্রচলিত ব্যাংকিং ধারার বাইরে একটি বিশেষায়িত ব্যাংক । গরীব মানুষ যাদের টাকা নেই তারা আবার ব্যাংক করে কিভাবে ? আর মোল্লার দৌড তো মসজিদ পর্যন্ত । ব্যাংকিং মোগলদের এই ধরনের নাক সিটকানোর বিপরীতে এই দুটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে । শুধু দাঁড়িয়েই যায় নি । এরা যথাক্রমে আন্তর্জাতিক পরিসরে সুনাম ছড়ানো ব্যাংক এবং দেশের বৃহত্তম বেসরকারী ব্যাংক হয়ে পড়েছে ।

কাজেই এটি যারা শুরু করেছেন বা আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন , ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক এটি তাদের শুধু জাগতিক সম্পদ নয় , এটি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি। রাষ্ট্রশক্তির অপ প্রয়োগে বা ছলে-বলে -কৌশলে এটি তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অন্যায়, মহা অন্যায় ।

আমাদের দেশের উন্নতি দেখে নাকি বিদেশিরা তাজ্জব (?) বনে গেছেন ! এই “তাজ্জব ” বনে যাবার খবর আবার আমরা শুনি সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মুখে । প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বের মানুষ অবাক হচ্ছে অন্য কিছু দেখে ।

ঢাকা থেকে পায়রা বন্ধ পর্যন্ত ২৪০ কিলোমিটারের একটি রেলপথ তৈরিতে খরচ ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি ডলার বা ষাট হাজার কোটি টাকা । মাত্র ১০ হাজার টাকার একটা ভুইফোড ব্রিটিশ কোম্পানীর সাথে এই কাজের জন্যে সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করেছে রেলওয়ে । এতে দেখা যায় কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ৩ কোটি ১২ লাখ ডলার বা প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা।

দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক সিঙ্গেল ট্র্যাকের লাইন, সিগন্যালিং ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ হয় সর্বোচ্চ ২৩ কোটি থেকে ৩১ কোটি টাকা। কোথায় ২৪৫ কোটি আর কোথায় ৩১ কোটি !

কাজেই এই ‘উন্নতি ‘ দেখে বিদেশিরা অবাক না হলে আর কী দেখে অবাক হবেন ? মূলত পুরো দেশটিই এদের হাতে হয়ে পড়েছে গণিমাতের মালের মত ।