বাংলাদেশ টেস্ট দলের দুর্বলতা তাহলে এই?

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২৮ জুন ২০২২, ২০:০১

বাংলাদেশ টেস্ট দলের দুর্বলতা তাহলে এই? – ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের ১০০ তম টেস্ট ম্যাচে হারের পর তৃতীয় দফায় বাংলাদেশের টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসান বলছেন, ‘বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি।’

এখানে প্রশ্ন উঠেছে যে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পেছনে কী কী বড় ভূমিকা পালন করে, সেসব চর্চা বাংলাদেশে হয় কিনা। নাকি ক্রিকেটাররা মাঠে ব্যর্থ হওয়ার পরে দায়টা ক্রিকেট সংস্কৃতির ওপর দিচ্ছেন।

টেস্ট ক্রিকেটে ১৩৪টি ম্যাচ খেলে ১০০টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। বাকি ম্যাচগুলোর মধ্যে ১৬টি টেস্টে জিতেছে, ১৮টি হয়েছে ড্র।

তবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেব করলে জয়ের সংখ্যা আরো কম, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই বাংলাদেশ আটটি টেস্ট জিতেছে। এর বাইরে শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি করে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চারটি টেস্ট ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘সাকিবকে আরো সময় দিতে হবে, দায়িত্ব পেয়েই কোনো ফ্লুক হবে না।’

তবে তিনি সাকিবের সাথে সুর মিলিয়েছেন, ‘টেস্ট কালচার আমাদের কখনোই ছিল না, গড়েও উঠেনি; টেস্ট কালচার তৈরি করা চাট্টিখানি কথা না।’

মাশরাফী বিন মুর্তজা জোর দিয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্বলতার দিকেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো শেফিল্ড শিল্ড বা রঞ্জি ট্রফির মতো টুর্নামেন্ট নেই। তাই একজন বিদেশী ক্রিকেটারকে খেলার অনুমতি দিলে কিছু সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।’

বাংলাদেশের হয়ে ৬৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলা তামিম ইকবাল নিঃসন্দেহে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের টেস্ট দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। তিনি ২ টেস্টে ৪ ইনিংসে তিনবার প্রায় নির্বিষ বল খেলতে গিয়ে উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন।

সাকিব দীর্ঘ দিন ধরে টেস্ট খেলছেন, কিন্তু প্রথম টেস্টে যখন বাংলাদেশ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছে তখন শেষ উইকেট জুটিতে সাকিব ৫০ করার পরেই বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গেছেন। ইনিংস ধরে রাখার বা উইকেটে সময় কাটানোর চেষ্টা দেখা যায়নি তার ব্যাটে।

বাংলাদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি বলেন, ‘আমার মনে হয় শুধু মুশফিক ছাড়া কেউই পরিপূর্ণ ক্রিকেটে মন নেই। তামিমের নানাবিধ সমস্যা, এই টি-টোয়েন্টি খেলবেন কি খেলবেন না। সাকিব পারিবারিক দিকটাতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। টেস্ট ক্রিকেটে এসব বড় ব্যাপার।’

এছাড়া টপ অর্ডারে নাজমুল হোসেন শান্তও কিছু ভালো শুরু করার পর খুবই অপ্রয়োজনীয় শট খেলে আউট হয়ে যান।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শট সিলেকশন নিয়ে একটা প্রশ্ন বরাবরই থেকে যায়। টেস্ট ক্রিকেটে ঠিক কোন সময় ধৈর্য্য ধরতে হবে, নতুন বলে ক্রিকেটটা কিভাবে খেলতে হবে এই বিষয়গুলো নিয়ে সবসময়ই একটা দুর্বলতা দেখা যায়।

তবে হুসেইনের মতে, শান্ত-জয়দের এই বয়সে এসে টেকনিক শেখানো বা পরিবর্তন করা যাবে না।

আবিদ হুসেইন সামি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের এ দল এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাবে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। সাধারণত কোনো বিকল্প দল সফরের আগেই খেলে আসে, সেখানে নিজেদের যাচাই করে।’

তিনি বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে নতুন বল পুরনো বলের হিসেবটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সেশনটা ব্যাট করে কাটিয়ে দিতে পারলে, লাঞ্চের পরে ব্যাট করা তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। বলও হালকা হতে শুরু করে, একদম আনকোরা ডিউক বলের যে ধার ও ঔজ্জ্বল্য থাকে তা কিছু ওভার খেলার পরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং এজন্য মাঝের ওভারগুলোতে ব্যাট করা তুলনামূলক সহজ হয়। কিন্তু এই টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ কোনোভাবেই কোনো ইনিংসেই ভালো ব্যাট করতে পারেনি।’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলগুলোও বাংলাদেশের নানা ধরনের দুর্বলতা খুব সহজেই মার্ক করেছে বলে মনে করেন সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি।

তিনি জানান, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুরঙ্গ লাকমাল বা কেমার রোচের বল যখন ফেস করে তখন কিন্তু তারা বিকেএসপির মাঠে বল করেন না। সেন্ট লুসিয়া বা বারবাডোজের উইকেটের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ঘরের মাটিতে পান না।’

সামি জানান, ‘শুধু এই সিরিজ না, ২০১৯ সালে ভারত সফর থেকে শুরু করে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের টপ অর্ডার ভালো করতে পারেনি। একদম ধারাবাহিকভাবেই ৫০ রানের ভেতর ৩-৪ উইকেট হারিয়ে একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এবং সেখান থেকে সামাল দিতে মুশফিকুর রহিম বা লিটন দাস কিছু ইনিংস খেলেছেন। এই টেস্ট সিরিজে মুশফিক ছুটিতে এবং লিটন দাস ঠিক নিজের সাম্প্রতিক ফর্ম অনুযায়ী খেলতে পারেননি, এজন্য বাংলাদেশের ব্যর্থতা আরো বেশি ফুটে উঠেছে।’

সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের কোচদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তারা চৌকষ নন খুব বেশি। ক্রিকেট শুধু মাঠের খেলা না, এখানে চিন্তারও খোরাক আছে। কোচদের শিক্ষা নেই বললেই চলে, গেম ডেভেলপমেন্টের কোচদের যে শিক্ষা সেটা আপডেট হয়নি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।’

তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট কূটনীতিতে একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারতের মতো দলগুলোর সাথে বেশি টেস্ট খেলতে না পারা। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাংলাদেশ শেষবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে খেলেছে ২০০২ সালে। ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ টেস্ট সফরে গিয়েছিল ২০১০ সালে। এমনকি টেস্ট খেলার দিক থেকেও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা অনেক পিছিয়ে আছেন।
মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের হয়ে নিয়মিত টেস্ট ক্রিকেট খেলেন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া দলে তার পরে অভিষিক্ত যেকোনো নিয়মিত ক্রিকেটার মুশফিকের চেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ মুশফিকের পাঁচ বছর পরে টেস্ট ক্রিকেট খেলা শুরু করে তার চেয়ে তিন টেস্ট বেশি খেলেছেন। এর মধ্যে আবার প্রায় এক বছরের মতো নিষিদ্ধও ছিলেন তিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের শীর্ষ ক্রিকেটাররা নিয়মিত ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। যেমন ভারতের টেস্ট ক্রিকেটাররা রঞ্জি ট্রফি খেলেন নিয়মিত। এমনকি শচীন টেন্ডুলকারও ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত ভারতের ঘরোয়া চার দিনের ক্রিকেট ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। সম্প্রতি ফর্ম হারানো চেতেশ্বর পুজারা নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলেন।’

আবিদ হুসেইন সামি বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে পেস বোলিং সবসময়ই একটা মাথাব্যথার কারণ। বাংলাদেশে আদতেই প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের হুমকি দেয়ার মতো পেস বোলার নেই। শুধু সিলেট বিভাগ থেকেই পেস বোলার উঠে আসছেন ইবাদত, রাহী, খালেদ।’

এই তিনজনের মতো বোলার আর কোনো বিভাগে নেই বলছেন সামি।

তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা মিলিয়েই বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করা হয়ে উঠছে না। সাকিবের কথাতেও উঠে এসেছে, টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য যে চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রয়োজন সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দেখাতে পারেননি।’

সূত্র : বিবিসি