পেঁয়াজ সংকট: বাজার সমস্যা বিশ্লেষণে আসল নায়ক অদৃশ্যই থেকে যায়

bonikbarta.net

ড. শামসুল আলম

সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০

পেঁয়াজের বাজার সাম্প্রতিক সময়ে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ভারতের পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে বাজারে আকস্মিক দাম বাড়তে শুরু করে তা ১০০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠেছিল। ২১ সেপ্টেম্বর বাজার পর্যবেক্ষণে দেখলাম দেশী শুকনা পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকায় স্থির রয়েছে। আগের এলসি খোলা ট্রাকগুলো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করেছে। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে। আমদানীকৃত পেঁয়াজের দাম আগের অবস্থানে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। আশা করছি চীন থেকেও পেঁয়াজ আসবে। আমাদের মোট আমদানির ১৫-১৯ শতাংশ আসে চীন থেকে, ভারত থেকে আসে ৭৫-৮০ শতাংশ। ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানির কারণেই আমাদের এত ভারতনির্ভরতা। ভারত কাছের দেশ হওয়ায় অবশ্যই পরিবহন খরচ কম পড়ে এবং আমাদের ও ভারতীয় পেঁয়াজের ধরনও একই। ভারতনির্ভরতা অর্থনৈতিক যুক্তিতেই, বন্ধুত্বের কারণে নয় অবশ্যই। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক যুক্তি দ্বারা, কূটনৈতিক সম্পর্কের ভূমিকা সম্ভবত গৌণ। গত বছরের পেঁয়াজ সংকট শুরু হয়েছিল ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে। সেটা ঘটেছিল অকস্মাৎ। অমনি শুরু হলো দেশে শত্রু খোঁজা। ৩৫-৪০ টাকা কেজি পেঁয়াজ হু-হু করে ২৫০-২৭৫-এ পৌঁছেছিল। শুরু হয়েছিল পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের আড়ত অনুসন্ধান, যতটুকু মনে পড়ে র্যাবও নেমে পড়েছিল মজুদদার খুঁজতে। ব্যবসায়ীদের ‘অতি মুনাফাখোর’ হিসেবে কিছু অর্থনীতিবিদ ‘কলাম লেখক’ তুলোধুনো করেছিলেন। কোনো পণ্যের দাম সংকট দেখা দিলেই বিশেষভাবে কৃষিপণ্যের জন্য মিডিয়াসহ কিছু কলামিস্ট ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও মজুদদারের দিকে নির্দেশ করে থাকেন। সরকারকে দায়ী করতে থাকেন মজুদারদের ঠিকমতো শায়েস্তা করতে পারে না বলে। বরাবর এমনটাই দেখে আসছি। বড় বড় ব্যবসায়ে সিন্ডিকেশন হয় না এমনটা বলি না। আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যেখানে সীমিতসংখ্যক আমদানি-রফতানিকারক (যেমন চিনি, খাবার তেল), সেখানে এর প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে ভোক্তাদের ভোগান্তির কারণ হতে পারে। তবে আবারো বলি, কৃষি প্রাথমিক পণ্যাদির ক্ষেত্রে—যেমন ধান-চাল-ভুট্টা, পেঁয়াজ, শাকসবজি, ডাল—বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট-বড় হাজার হাজার ব্যবসায়ী মানে পাইকার, ফড়িয়া, আড়তদার, মিলার মজুদদার, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকারী ও রফতানিকারক সারা দেশে বিস্তৃত। রয়েছে হাজার হাজার ব্যবসায়ী, আছে লাখ লাখ ভোক্তা। অর্থনীতিতে কৃষি সবচেয়ে বড় ব্যক্তি খাত। কৃষি প্রাথমিক পণ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে দেশব্যাপী প্রভাব পড়বে এমন সিন্ডিকেশন অসম্ভব। কৃষিপণ্য বাজার সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক এবং সামগ্রিকভাবে দক্ষ। কৃষিতে এমন মজুদদারগোষ্ঠী পাওয়া অসম্ভব, যারা সারা দেশে মূল্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থা পুরো অনুধাবন না করেই আমরা সব সংকটের দায়ভার মজুদদার, ব্যবসায়ী ও সরাসরি সরকারের ওপর আরোপ করতে চাই। এবারের পেঁয়াজ সংকটেও খুব একটা ব্যতিক্রম দেখছি না। কিছু পত্রিকা পেঁয়াজের দাম সংকটের জন্য দায়ী করছে সরকারকে এবং যুগপত্ভাবে ব্যবসায়ীদেরও। বলছে পেঁয়াজ সংকটের কারণ ‘বাজার তদারকির অভাব’, ‘ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার প্রবণতা’, ‘সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাব’, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানিসংক্রান্ত সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা নেই’, ‘সংকট দেখিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়ায়’, ‘কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধি’ ইত্যাদি। এমনকি ঢাকায় অবস্থিত ‘ইফপ্রি’ (IFPRI) প্রধান বলেছেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে’, ‘পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বাজারে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের অভিযান—দাম কমেনি’ (টিভি স্ক্রল)। উপরের পত্রিকায় উদ্ধৃতিগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান এই সংকটের মূল খলনায়ক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এবং ব্যবসায়ীগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতা। ব্যবসায়ী হলেও ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শব্দটি আমাদের দেশে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহূত হয়ে আসছে, যা অবশ্যই বাজারবান্ধব শব্দ নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থায় যদি ‘অতিমুনাফার’ সুযোগ থাকত, তবে লাখ-লাখ শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক সব মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে যেত। যেমন এক ‘দেশ’ গার্মেন্ট থেকে এখন ছোট-বড় সাড়ে সাত হাজার গার্মেন্ট হয়ে দেশকে বিশ্বে দ্বিতীয় রফতানিকারকে পরিণত করেছে।

এই মূল্য সংকটসংক্রান্ত আলোচনায় ‘দাম’ ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক শব্দ হলো ‘ঘাটতি’, ‘চাহিদা’ ও ‘সরবরাহ’। এই সংকটের মূল খেলার স্থানটি হলো ‘বাজার’। সংকটের নায়কও হচ্ছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বাজার’। বাজারকে না বুঝে সংকটের সমাধান টানা যায় না। যদিও-বা টানি তা অকার্যকরই থেকে যাবে। শুধু বারবার বাস্তবতাবহির্ভূত সমাধানগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে, যেমন এবারের সংকটের সময়ও হচ্ছে। সংকট সমাধানে বাজারকেই আগে বুঝতে হবে। বাজারকে বোঝার উপায় হলো সঠিক মোট চাহিদা ও সঠিক মোট সরবরাহ জানা এবং চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে পণ্যের দাম প্রতিফলিত হবে বাজারে। পণ্যমূল্য বাজারে ‘সংকেত’ দেয় কোন পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে দাম বাড়বে—অর্থনীতির সাধারণ পাঠ। অথচ সরবরাহ ঘাটতিতে দাম যখন ক্রমে বাড়তে থাকবে, আমাদের শুরু হয় শত্রু খোঁজা। বাজার হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, এর কারক বা কুশীলব কারা? বাজারের প্রধান কুশীলব তিন শ্রেণী—উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা। এই তিন কুশীলব যেন ফাউল না খেলে, তা দেখার জন্য তো একজন রেফারির প্রয়োজন। সেই রেফারি হলো সরকার। বাজার এবং বাজার অর্থনীতিতে সরকার কেবলই রেফারি, যে ওই তিন খেলোয়াড়শ্রেণীর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে (সংসদ) খেলার রুলস অব গেম বা নিয়মকানুন বেঁধে দেবে এবং খেলার নিয়মকানুন যেন সবাই মানে সেটি নিশ্চিত করবে। সরকার বাজার কার্যক্রম বা কুশীলবদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং সহযোগিতা করে। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকলে প্রয়োজনে লাল কার্ড দেখাতে পারে, যেমন ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী। সরকার যতটা সম্ভব নিজে খেলোয়াড় হবে না। হলে খেলা নিরপেক্ষ হয় না। দক্ষ রেফারি মানেই চমত্কার খেলা, সেখানে উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা সন্তুষ্ট থাকেন। রেফারি তিন কুশীলবের স্বার্থই রক্ষা করবে। বাজারের খেলা অবশ্যই টিমে খেলতে হবে। টিম অনেক বড় হতে হবে, যাতে অনেক অনেক ভালো খেলোয়াড় পাওয়া যায়। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় বিধায় মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সৃজনশীলতা সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ী কুশীলব একজন (মনোপলি), পাঁচজন বা দশজন হলে হবে না, যত বেশি হবে তত মঙ্গল। উৎপাদক, ব্যবসায়ী, ভোক্তাশ্রেণী তত উপকৃত হবে এবং কল্যাণ নিশ্চিত হবে। শোষণহীন বাজার ব্যবস্থার নিয়ামক হলো প্রতিযোগিতা। পণ্যবাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হলে কারো ঠকার সম্ভাবনা থাকে না। বাজার অর্থনীতির জন্য এই সরকার একটি চমত্কার উদ্যোগ নিয়েছে ‘প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন’ করে। রেফারি সরকার সর্বক্ষণ বাজার কার্যক্রমের ওপর চোখ রাখবে এই প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে। যেখানে বা যে পর্যায়েই হোক, প্রতিযোগিতা ব্যাহত হলেই সরকার পদক্ষেপ নেবে। কার্টেল সিন্ডিকেট কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে মনোপলি আচরণ করলেই তা ভেঙে দিতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে ‘অ্যান্টি মনোপলি ল’ কঠোর আইন প্রণয়ন করবে।

বাজার খেলায় ‘তথ্য’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর পেঁয়াজ সংকটের অন্যতম একটি কারণ ছিল তথ্য বিভ্রান্তি বা ঘাটতি। একটু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশনের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, গত বছর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। এ বছর মোট উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন এবং ডিএইর ভাষ্য মোতাবেক আমদানি হয় সাত লাখ টন। এদিকে বিবিএসের মতে, দেশে গৃহস্থালি পর্যায়ে পেঁয়াজের চাহিদা ১৮ লাখ ৭২ হাজার টন (২০১৯-২০ বর্ষে) এবং দেশে আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন। ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা ১৮ লাখ ৭২ হাজার টন, সেই সঙ্গে হোটেল-রেস্তোরাঁর চাহিদা আরো পাঁচ থেকে সাত লাখ টন হিসাবে নিলে দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা ২৫ থেকে ২৬ লাখ টনের বেশি নয়। ডিএইর হিসাবে উৎপাদন হলে (২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন) দেশে তো পেঁয়াজ ঘাটতি তেমন হওয়ার কথা নয়, তদুপরি সাড়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টন কেন আমদানি করতে হয়? ঘাটতির সঠিক তথ্য না পেলে ব্যবসায়ী আমদানির জন্য প্রস্তুতি নেবেন কিসের ভিত্তিতে? কৃষক পর্যায়ে দেশী পেঁয়াজ-রসুন সংরক্ষণ করা হয় এবং অমৌসুমে দাম বাড়লে নগদ টাকার জন্য বাজারে বিক্রি করে। অবশ্য সংরক্ষণের সময় কিছু পেঁয়াজ শুকিয়ে বা ছত্রাকে ধরে নষ্টও হয়ে যায়। সব উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্য বাজারের কুশীলবদের জানতে হবে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার বা আমদানি-রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। বাজারে সঠিক তথ্য দেয়ার দায়িত্ব রেফারির অর্থাৎ সরকারের। বাজারকে তার নিজস্ব পথে কাজ করতে দিতে হবে নতুবা হঠাৎ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে এবং কোনো না কোনো কুশীলবকে সবাই মিলে দোষ দিতে থাকব। ‘রেফারি সরকারের’ কাজ হলো ব্যবসায়ের সব পর্যায়ে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। আদর্শিকভাবে বলা যায়, আমদানির জন্য লাইসেন্স থাকবে কেন? যে আমদানিকারক হতে চায় হবে। যারা লাভ করতে পারবে না, ব্যবসা থেকে সরে যাবে। কৃষিপণ্যের মজুদদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার কার্যক্রম। এদের কারণেই অমৌসুমে ভোক্তারা কৃষিপণ্য পেয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীদের জন্যই ভোক্তারা দূর অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য নিজের এলাকায় পেয়ে থাকেন। পণ্য মজুদ কত দিনের জন্য করা যাবে—এমন কোনো আইন থাকা উচিত নয়, কেননা এতে বাজারের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দিন শেষে ভোক্তারা কষ্ট পান।

জরুরি পণ্য মজুদ আইন সেকেলে আইন। এটা সেই সময়ের আইন, যখন সরকার প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত এবং অর্থনীতি ছিল সার্বিক ঘাটতি অর্থনীতি। এমন কিছু থাকলে তা রহিত হওয়া উচিত। দাম বাড়তে থাকলে কিছু মজুদদার বাজারে পণ্য ছাড়বেই, কেননা সে মুনাফা অর্জনের জন্য মজুদ কার্যক্রম করে, পণ্য পচানোর জন্য নয়। কৃষক পর্যায়ে ‘রাখি’ ব্যবসাও একসময় জনপ্রিয় ছিল। পণ্য মজুদে যে ব্যবসায় এগিয়ে আসবে তাকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়াসহ সংরক্ষণ পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা ডিএই করতে পারে। কৃষিশস্য-পণ্য, মাছ, ডিম, পোলট্রিসহ সব উৎপাদন তথ্য জাতীয় স্ট্যাটেস্টিক্যাল সংস্থা বিবিএসকে প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া উচিত (স্ট্যাটেস্টিক্যাল আইনেই তা বলা আছে)। এটাই হবে বিবিএসকে শক্তিশালী করার অন্যতম উপায়। কেউ কেউ বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত কেন হঠাৎ রফতানি বন্ধ করে দেবে। বিক্রেতা, সে রাষ্ট্র হোক আর ব্যক্তি হোক, সে বিক্রয়ের ব্যাপারে স্বাধীন, যেমন ভোক্তা রাষ্ট্র হোক আর ব্যক্তি হোক ক্রয়ের ব্যাপারে সেও স্বাধীন। ব্যবসায় বন্ধুত্ব এবং ভাবাবেগের স্থান কোথায়? ‘সোস্যাল মিডিয়ায়’ দেখলাম আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরিরত অভিজ্ঞ এক পেশাজীবী বলছেন, ভারত থেকে আমাদের গাড়ি আমদানি বন্ধ করে চীন-জাপান থেকে গাড়ি আমদানি শুরু করা উচিত। বন্ধুত্বের জন্য নয়, অর্থনৈতিকভাবে ‘সাশ্রয়’ বা লাভ হয় বিধায়ই আমরা ভারত থেকে গাড়ি বা অন্য পণ্য আমদানি করি। এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ আমাদের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। কেননা আমরা ভারতে যা রফতানি করি, আমদানি করি তিন গুণেরও বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে আমাদের জনসংখ্যা ১ হাজার ২৬৫ জন, ভারতে জনসংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮২ জন। আমাদের আমদানি নির্ভরতাও আমাদের অধিক জনসংখ্যারই প্রতিফলন। আমদানি-রফতানি পুরো বাজার কার্যক্রম অর্থনীতির লাভ-অলাভ দিয়েই ঠিক হয়ে থাকে—কোথা থেকে আনব আর কোথায় বিক্রি করব।

আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্যেরই ঘাটতি আছে। থাকবেও। সব দেশেই প্রয়োজনের সব পণ্য উৎপাদন হয় না। কৃষিপণ্যের জন্য উপযোগী জমি, প্রযুক্তি, প্রতি একরে উৎপাদিকা এবং উন্মুক্ত আমদানি-রফতানি দেশে প্রতি মণে/টনে দাম আর অধিকন্তু ভরণ-পোষণের কৃষিতে গৃহচাহিদা দ্বারাই নির্ণীত হয়। উৎপাদক কোন ফসল কতটুকু করবেন বা কোন ফসল করলে মুনাফা হবে, জোর করে কৃষক-উৎপাদক দিয়ে পণ্য উৎপাদন করনো যায় না। ‘বাজার সংকেত’ (দাম) থেকেই তিনি বার্তা নেবেন কোন ফসলে কতটুকু জমি চাষ করবেন। দীর্ঘদিন থেকে আমাদের দেশে মসুর ডালের দাম প্রতি কেজি ১০০ টাকার উপরে থাকে, তবু মসুর ডালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছি না কেন? ডালের উৎপাদিকা এত কম, অসময়ে বৃষ্টি হয়ে প্রায় প্রতি বছর ডাল উৎপাদন নষ্ট হয়, তাই যতই দাম থাকুক, কৃষক মসুর ডাল উৎপাদনে যেতে তত আগ্রহী হন না। এটা বাজার বাস্তবতা। একে পরিবর্তন করতে হলে উৎপাদিকা বাড়ানোর প্রযুক্তি এবং বৈরী আবহাওয়া থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে, সেটা ভাবতে হবে। এ উদাহরণ টানছি এ কারণে যে বাজারদর বেশি হলেই যে কৃষক উৎপাদনে আকৃষ্ট হবেন এমন নয়। তবে বাজার পদ্ধতিকে অনুধাবন করতে হবে, বাজারের কুশীলবদের বিনা ভীতিতে কাজ করতে দিতে হবে, সঠিক তথ্যপ্রবাহ থাকতে হবে আর ভোক্তার জন্য পণ্যমানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যখন ঘাটতি অনুভূত হবে, মানে দাম বাড়বে, অবাধে আমদানির সুযোগ থাকবে। কর বসিয়ে আমদানি-রফতানি বাধাগ্রস্ত করা ঠিক নয়। মুক্তভাবে বাজারকে কাজ করতে দেয়াই হলো প্রকৃত সমাধান। এ নীতি অনুসৃত হলে বাজার রেফারিকে কেউ দোষ দিতে পারবে না। এতে দীর্ঘমেয়াদে সবার সর্বাধিক কল্যাণও নিশ্চিত হবে। সরকারকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে সবার কল্যাণ চিন্তা করে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সবার জন্য বাজারে ‘লেভেল প্লেয়িং’ ফিল্ড নিশ্চিত হয়।

 

. শামসুল আলম: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সদস্য (সিনিয়র সচিব), সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন