নষ্ট রাজনীতির যন্ত্রণা করোনার চেয়েও নির্মম!

নষ্ট রাজনীতির যন্ত্রণা করোনার চেয়েও নির্মম! – নয়া দিগন্ত

প্রথমে একটি ঐতিহাসিক কাহিনীর কথা আপনাদের বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মধ্যযুগের দুনিয়ায় যে শহরটি মাশরেক থেকে মাগরেব পর্যন্ত মশহুর ছিল সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে, সেটির নাম সমরকন্দ। ১২২০ সনের মার্চ মাসে এই শহরের ওপর যে খোদায়ী গজব নেমে এসেছিল, যার কারণে পুরো শহরটি মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। সেখানে মানুষতো দূরের কথা, কুকুর বেড়ালের মতো প্রাণীগুলোকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তী ১৫০ বছর পর সেখানে আবার নতুন করে বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। সমরকন্দর ওপর খোদায়ী গজবটির নাম ছিল চেঙ্গিস খান এবং সেটা তিনি নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন বারবার। সমরকন্দের ধ্বংস সাধনের আগে তিনি নগরবাসীকে জড়ো করে তাদের উদ্দেশে নিম্নলিখিত কথাগুলো বলেছিলেন-

সুলতান আলাউদ্দিন খুবই দুর্বলচিত্তের এবং ভীরু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এই শ্রেণীর মানুষেরা রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে যেরূপ অহঙ্কারী এবং দাম্ভিক হয়ে পড়ে সুলতান আলাউদ্দিন তাদের থেকে ব্যতিক্রম তো ছিলেনই না বরং তার দুষ্টবুদ্ধি, অমানবিক আচরণ, ভোগ বিলাস এবং অনৈতিক জীবনযাপনের কারণে তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম সাম্রাজ্যটির সর্বত্র অপরাজনীতি, দুর্নীতি এবং দুঃশাসন যেভাবে বাসা বেঁধেছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সাম্রাজ্যের আমির-ওমরাহ, দরবারি আলেম-ওলামা, সেনাপতি এবং অযোগ্য চাটুকারেরা একত্রে মিলে সমস্বরে সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্য নিত্যনতুন কুকর্ম আবিষ্কার করত। তাদের চাটুকারিতার কবলে পড়ে সুলতানের বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। তার জ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সমসাময়িক দুনিয়া সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি তার চাটুকারদের প্রবঞ্চনায় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট মনে করতেন এবং নিজের রাজ্যকে দুর্ভেদ্য দুর্গ মনে করতেন। দুনিয়ার কোনো শাসক-সেনাপতি বা বিজেতা যে তার রাজ্য আক্রমণ করতে পারে এরকম চিন্তা তার মনে কোনো কালে উদয় হয়নি।

তিনি চেঙ্গিস খানের বীরত্ব এবং মোঙ্গল বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য গতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ফলে চেঙ্গিস খান যখন তার দরবারে দূত পাঠালেন তিনি তখন অহঙ্কারবশত সেই দূতকে হত্যা করে নিহত ব্যক্তির খণ্ডিত মস্তক চেঙ্গিস খানকে ফেরত পাঠালেন। ফলে যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে পড়ল তিনি তখন তার সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক গভর্নরদের যুদ্ধ করার দায়িত্ব দিলেন এবং তার রাজধানীর দায়িত্ব তার মায়ের ওপর ন্যস্ত করলেন। এরপর তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্যে পালিয়ে গেলেন।

ইতিহাসে অনেক বিজেতা কর্তৃক শহর ধ্বংস হয়েছে, আবার অনেক শহর গড়ে উঠেছে। অনেক কাপুরুষের পতন হয়েছে এবং তাদের সমাধির ওপর বীর পুরুষদের বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে। হালাকু, তৈমুর, নাদির শাহ প্রমুখ বিজেতা কর্তৃক অনেক শহরে তাণ্ডব চলেছে কিন্তু চেঙ্গিস খান কর্তৃক খাওয়ারেজম সামাজ্য আক্রমণ এবং সেই সাম্রাজ্যের বড় বড় শহর নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে এমনটি আর দ্বিতীয়বার ঘটেনি কোনোকালে। সমরকন্দ ছাড়াও বোখারা এবং রাজধানী গুরগঞ্জির অস্তিত্ব মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। চেঙ্গিস খান কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত বেশির ভাগ শহরে যুগ-যুগান্তর কিংবা শতাব্দীকাল পরে হলেও নতুন করে বসতি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন পারস্যের রাজধানী পার্সিপোলিশের মতো গুরগঞ্জে আজ অবধি বসতি স্থাপিত হয়নি।

ইতিহাসের হাজারো অপরাজনীতি-অপশাসন এবং নির্মম ও নৃশংস ধ্বংসলীলাগুলোর মধ্যে নিকৃষ্টতার বিচারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে ১২২০ সালের মধ্যএশিয়া এবং পারস্য অঞ্চল অধ্যুষিত খাওয়েরেজম সাম্রাজ্যের কালা-কানুন। অন্য দিকে, যে বীভৎস ঘটনা-দুর্ঘটনার মাধ্যমে সাম্রাজ্যটির পতন ঘটেছিল তা যেমন অন্য কোথাও ঘটেনি। তেমনি চেঙ্গিস খানের হাজারো বিজয় অভিযানে যে নির্মমতার কথা আমরা জানতে পারি সেগুলোকে একত্র করলেও খাওয়েরেজমের নির্মমতার পিরামিডের উচ্চতা স্পর্শ করতে পারবে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, চেঙ্গিস খান কেন খাওয়েরেজমের প্রতি এতটা বিক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয়ত! মধ্যযুগের সবচেয়ে বৃহত্তম সাম্রাজ্যটির রাজা-বাদশাহ, আমির ওমরাহ এবং জনগণ এমন কি ভয়াবহ পাপ করেছিল, যার কারণে বিধাতার অভিশাপরূপে চেঙ্গিসীয় তাণ্ডবে সেখানকার সবকিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল!

ইতিহাসবিদরা উল্লেখিত বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করে যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা হলো, মধ্যযুগে পৃথিবীর রাজনীতি একদিকে যেমন যুদ্ধ-বিগ্রহে ভরপুর ছিল। তেমনি সুশাসন ন্যায়বিচার এবং নীতি নৈতিকতাপূর্ণ রাজনীতি অর্থনীতি এবং সামাজিক বিধিব্যবস্থার কারণে বহু দেশে কিংবদন্তির শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ফলে সুশাসন সমৃদ্ধ অঞ্চলে মধ্যযুগে যেসব জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্য এবং স্থাপত্যকলার চর্চা হয়েছে সেসব সুকীর্তির ঝলক বর্তমান আধুনিক সভ্যতাকেও বিস্ময়ে বিমূঢ় করে তোলে। অন্য দিকে, যেসব দেশে মানুষের অধিকার পদদলিত করা হয়েছে এবং জনগণ যখন পদদলিত থাকার মধ্যেই নিজেদের বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে তখন সেসব স্থানে প্রকৃতির প্রতিশোধ নেমে এসেছে। কারণ প্রকৃতি মানুষের কিছু কর্ম কখনোই বরদাস্ত করতে পারে না। কোনো একটি মানুষ্যরূপী শ্রেণী বা জাতিগোষ্ঠী যখন পাশবিক আচরণ শুরু করে এবং অন্যান্য মানুষকে পশুবৎ ধ্যানজ্ঞান করে দমন পীড়ন চালায় এবং নির্যাতিতরা সেই পাশবিকতার কবলে পড়ে নিজেরাও পশু হয়ে যায় তখন প্রকৃতি সেই জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন অনুভব করে না। যার রসায়নে খাওয়েরেজম ট্র্যাজেডি ঘটেছিল।

খাওয়েরেজম সাম্রাজ্যের পতনের মূলে যে অপরাজনীতি বা নষ্ট রাজনীতি যেভাবে নেয়ামক হিসেবে কাজ করেছে অনুরূপ ঘটনা পৃথিবীর যে-প্রান্তে যখনই ঘটেছে ঠিক তখনই সেখানে বিধাতার অভিশাপ চেঙ্গিস খানের আদলে নানা রকম বিপর্যয় নেমে এসেছে। মানব জীবনে রাজনীতি হলো মানবিকতা এবং মূল্যবোধের সর্বোচ্চ স্তর। সুতরাং সেই স্তরে যদি পচন ধরে তবে তা যে দুর্গন্ধ ছড়ায় বা ব্যথা বেদনার সৃষ্টি করে তা কোনো রোগবালাই দ্বারা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক অপরাজনীতি মানুষকে কতটা বেদনাহত করে তুলেছে অথবা অপরাজনীতির কবলে পড়ে আমরা কতটা বিবেকহীন অনুভূতিহীন অথবা কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি তা করোনা সাম্রাজ্ঞী ডা: সাবরিনার নাচের মুদ্রা, শাড়ির রঙ এবং শরীরের ভাঁজের প্রতি মানুষের আগ্রহ বনাম মরণব্যাধি করোনার আতঙ্কের মধ্যকার আপেক্ষিকতা বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারব।

সাবরিনার পাশাপাশি করোনা শাহেদের নৌকা আরোহণে পলায়ন নাটক। পলিস করা জুতা পায়ে, পিস্তল কোমরে বেঁধে ময়লাযুক্ত বোরকা পরে যে ফটোসুট আমরা দেখছি সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিদ্যাবুদ্ধি বা সাহস যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি তা যেমন সত্য, তেমনি যারা পুতুলনাচের ইতিকথা রচনা করেন এবং যারা পুতুল দিয়ে খেলেন তারা ধরেই নেন যে, অবোধ বালক- বালিকারা ছাড়া সাধারণত পুতুলনাচ কেউ দেখে না। কাজেই পুতুলনাচের সংলাপ, পুতুলের লম্ফঝম্ফ, পুতুলের চেহারা-সুরত, পোশাক পরিচ্ছদ এবং ঢং সাজসজ্জা সবসময় নির্বোধ বালক-বালিকাদের মেজাজ-মর্জি, রুচি-অভিরুচি এবং বিনোদনের কথা চিন্তাভাবনা করেই রচনা করা হয়। সুতরাং পুতুলনাচের মঞ্চের সামনের দর্শক এবং পেছনের কলাকুশলীদের মধ্যে যে একটি ভাবের সম্মিলন থাকে ঠিক তেমনি অবস্থা সৃষ্টি হয় সমাজে যখন বড় বড় মানুষকে কর্তাব্যক্তিরা নির্বোধ বলে ধ্যানজ্ঞান করে এবং যখন যা ইচ্ছে তা বলার বা করার জন্য কোনো লজ্জা শরম-ভয় বা দ্বিধা সঙ্কোচ অনুভব করে না।

আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির পদত্যাগ, শাহেদ-সাবরিনার গ্রেফতার, অতীতকালে পাপিয়া-সম্রাট গংদের গ্রেফতার ইত্যাদি বায়স্কোপ দেখে যারা আবেগে আপ্লুত হতে পারি তাদের জন্য করোনাভীতি, চলমান অর্থসঙ্কট, বন্যা এবং কোটি কোটি কর্মহীন মানুষের নিদারুণ কষ্ট কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু যারা মনে করেন সবচেয়ে বড় নাটের গুরুর টিকিটি স্পর্শ না করে কেবল তার চেলা-চামুণ্ডাকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে মূলত মহল বিশেষকে বাঁচানোর জন্য কিংবা যারা মনে করেন যে, অপরাজনীতির কুশীলব বা কুলাঙ্গারদের কারণে দেশের মধ্যে আমরা যে বিপদে পড়েছি তা বিগত কয়েক শতাব্দীতে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটেনি অথবা এদের কারণে যারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আমরা যেভাবে অপমাণিত ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছি তা আমাদের জাতির হাজার বছরের ইতিহাস কোনো দিন ঘটেনি, তারা অর্থাৎ এই ধরনের চিন্তাশীল মানুষেরা করোনা আতঙ্কের পাশাপাশি যে মনোবেদনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তা তাদের একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।

আমাদের দেশের নষ্ট রাজনীতি মানুষের মন-মস্তিষ্ক এবং জবানকে কতটা কলঙ্কিত করেছে তা আপনি অনুধাবন করতে পারবেন যদি একটি বিশেষ শ্রেণী বা গোত্রের লোকজনের দিকে লক্ষ করেন। সেই গোত্রের শিক্ষিত জন যারা হার্ভার্ড, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বা জন হপকিন্সের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন, তাদের কিছু কথাবার্তা, আচরণ এবং রং ঢং যদি লক্ষ করেন এবং একই বিষয়ে সেই গোত্রের মুচি-চাড়াল-চণ্ডালদের কথাবার্তা আচরণ এবং রং ঢং বিবেচনায় আনেন তবে বুঝতে পারবেন যে সেখানে সবার সবকিছু একরকম হয়ে গেছে। সব মানুষের বাস্তব রং যেমন লাল তেমনি ওদেরও সব কিছু একই রকম হয়ে গেছে। প্রকৃতিতে এই রকম অদ্ভুত ঘটনা তখনই ঘটে যখন যেখানে গণতন্ত্র থাকে না, ব্যক্তিপুজোকে বেঁচে থাকার অবলম্বন বলে প্রচার করা হয় এবং মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলা, লিখা, চিন্তা করা বা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে নিষ্ঠুরভাবে হরণ করা হয়।

নষ্ট রাজনীতির বিষ মানুষের মন-মস্তিষ্কে ভর করলে তার শরীরের লক্ষ কোটি কোষের মধ্যে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সর্বকালের নিকৃষ্ট রোগগুলো কেবল মানবশরীরের নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অপরাজনীতির বিষ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অপরাজনীতি দ্বারা আক্রান্ত দেশ-জাতি বা গোত্রের লোকদের একাংশের জীবন করোনা, প্লেগ-গুটিবসন্ত প্রভৃতি মহামারী রোগবালাইয়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর ও বেদনাদায়ক হয়ে পড়ে। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রয়োজন হয়, তেমনি অপরাজনীতির হোতাদের বিরুদ্ধে প্রতিকার লাভের জন্যও ভ্যাকসিন দরকার পড়ে এবং সেই ভ্যাকসিন কোনো সাধারণ ভ্যাকসিন নয়। অপরাজনীতি নির্মূলের জন্য সর্বকালের সবচেয়ে কার্যকর ভ্যাকসিনটি কিভাবে প্রকৃতি এই জমিনের ওপর প্রয়োগ করেছিল তা আমরা চেঙ্গিস খান অথবা হালাকু খানের জীবনকাহিনী থেকে জানতে পারি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য