টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ!

Daily Nayadiganta

টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ! – ছবি : নয়া দিগন্ত

কালো টাকা অর্থনীতিরই অংশ বটে তবে অর্থনীতির মস্তিষ্কে টিউমারের মতো এই টিউমার সরাতে হবে, নয়তো রোগী (অর্থনীতি) মারা পড়বে-রোহিনটন মিস্ত্রি

আমাদের এফসিএ অর্থমন্ত্রী এ কথাটি মনে হয় ভালোভাবেই জানেন! অথচ কোনোরূপ বাছবিচার ছাড়াই আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। তিনি এ কাজটি করেছেন তার ভাষা ধার করে বলা যায় ‘অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতার সাথে’। এক দিকে তিনি যেমন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে মধ্যবিত্ত করদাতাদের একটু রেহাই দেয়ার জন্য ব্যক্তি শ্রেণীর আয়করমুক্তসীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে করে এই করোনাকালে একটু হলেও স্বস্তি পাবেন তারা।

করপোরেট কর কমিয়ে বড় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপকেও সুবিধা দেয়া হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের ওপর থেকে কিছু শুল্কও কমানো হয়েছে। এটিও একটি সুসংবাদ বটে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু তারপর একটি প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাবে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে বিশাল টার্গেট ধরা হয়েছে, তা আদায়ের কৌশল কী নির্ধারণ করলেন অর্থমন্ত্রী। কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এই অর্থ কী আদায় করতে পারবে এনবিআর। ‘পারবো না’, এ কথাটি আর কারো নয়, এনবিআর চেয়ারম্যানের। তিনি গেল মাসে অর্থ সচিবকে পত্র মারফত জানিয়ে দিয়েছেন, এই টার্গেট অর্জন করা যাবে না।
এনবিআর পারবে না, তা হলে উপায়, অর্থমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর বেশি ভরসা রেখেছেন। এ খাত থেকে ঋণ লক্ষ করা হয়েছে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। যদি রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না হয়, তবে ব্যাংক থেকে ঋণের মাত্রা লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তখন বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তাদের কী হবে তা কিন্তু বলেননি অর্থমন্ত্রী।

প্রবৃদ্ধি কিভাবে আসবে : শুধু কি তাই, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক ‘বাঘা বাঘা’ সংস্থাগুলো যেখানে হিসাব কষে বলে দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেড় থেকে দুই শতাংশের ঘরে আটকে থাকবে। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু কিসের ওপর ভিত্তি করে এই প্রবৃদ্ধি হবে তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি অর্থমন্ত্রী। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে কর্মসংস্থান কত করতে হবে, বিনিয়োগ কত হবে তারও কোনো হিসাব দেননি অর্থমন্ত্রী।

আর এ বিষয় নিয়েই গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বেলা ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাজেট পেশ করলেন। প্রথমবার বাজেট পেশ করার সময় তিনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। বাজেট পেশ করার একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ বোধ করলে বেরিয়ে যান। বাজেট বক্তৃতার বাকি অংশ পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি চান এবং কিছু অংশ পঠিত বলে গণ্য করার অনুরোধ জানান। স্পিকার তাতে অনুমতি দেন। অর্থমন্ত্রী তার সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতার কিছু অংশ ডিজিটাল পদ্ধতি উপস্থাপন করেন। বাজেটের সেøাগান হচ্ছে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’।

এর আগে ৪৯তম বাজেট মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এই বিশেষ বৈঠক হয় জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা কক্ষে। করোনাভাইরাসের কারণে এই বৈঠক হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায়। মন্ত্রিসভার মাত্র ১১ জন সদস্য বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ছিলেন কয়েকজন সিনিয়র সচিব ও সচিব।

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, ‘দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের আগামী ১ জুলাই, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।’

পুঁজিবাজারেও খাটানো যাবে কালো টাকা : শুধু জমি ফ্ল্যাটে নয় ডুবন্ত পুঁজিবাজারেও কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিন মাসের লকডাউনসহ কিছু শর্তসাপেক্ষে আগামী ১ জুলাই, ২০২০ থেকে ৩০ জুন, ২০২১ এর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে এবং ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।

কেন কালো টাকা সাদার করার সুযোগ দিয়েছেন তারও কিন্তু একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে করদাতাদের রিটার্ন দাখিলে অজ্ঞতার কারণে তাদের কিছু অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নের ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি আয়কর অধ্যাদেশে আয়কর প্রণোদনা সংক্রান্ত দু’টি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করছি।

টাকা কোথা থেকে আসবে : নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৬ শতাংশ রাজস্ব আয় থেকে আসবে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে ৮.৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে এনবিআর মাধ্যমে কর হিসেবে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯.৮১ শতাংশ। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৮ শতাংশের বেশি। আর এই অর্থ আদায় করতে হলে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি করতে হবে ৫০ ভাগ হারে। আদৌ যা কখনো সম্ভব নয়। কারণ এর আগে একবার মাত্র রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ শতাংশ। অন্যান্য সময়ে যা ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে।

গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, যা এক লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৯৪ শতাংশের মতো বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল এক লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা এক লাখ ৯ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আয়কর ও মুনাফার ওপর কর থেকে এক লাখ তিন হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ দুই হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা।

এ ছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, রফতানি শুল্ক থেকে ৫৫ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে তিন হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় তা সংশোধন করে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু এটিও অর্জন করা সম্ভব হবে না। টেনে আড়াই লাখ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হতে পারে। অর্থমন্ত্রী সংসদের সামনে যে বাজেট তুলে ধরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মতো।
২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সংশোধনে তা পাঁচ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা চেষ্টা করা হলেও এই ঘাটতি এখন সাড়ে ৫ শতাংশ।

আগামী অর্থবছরে ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। দেশীয় খাতের ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও কোভিড-১৯ দুর্যোগের মধ্যে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। আর মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

বাজেট বক্তৃতার উপসংহারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। পাশাপাশি দেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র জোগানের জন্য অর্থনীতির চাকাও সচল রাখা।’ এই জন্য তিনি আল্লাহ তায়ালার সহায়তা চেয়েছেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা আল-বাকারাহর ১৫৫ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেছেন যে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই, মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসলহানির মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও’।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অন্যায়কারী ও সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালো বাসেন না। ভালোবাসেন না অসৎ ব্যক্তিদেরও। তার প্রমাণ-
‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন ওর সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদের সৎকর্ম করতে আদেশ করি; কিন্তু ওরা সেখানে অসৎ কর্ম করে, তখন তার ওপর শাস্তি ন্যায়সংগত হয়ে যায় ও আমি তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করি,’ -সুরা বনি ইসরাইল : ১৬ (কুরআন সূত্র-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-২৭০)

আমরা জানিনা, করোনার মাধ্যমে আমরা সেই শাস্তি পেতে যাচ্ছি কি না। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।