জাহিদের নতুন আবিস্কার কোয়ান্টাম চুম্বক

জাহিদের নতুন আবিস্কার কোয়ান্টাম চুম্বক

ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার বিশ্বে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

 প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮       Daily Samakal

ইজাজ আহমেদ মিলন
জাহিদের নতুন আবিস্কার কোয়ান্টাম চুম্বক

ড. জাহিদ হাসান তাপস

বছর তিন আগে ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ নামে এক অধরা কণার অস্তিত্ব আবিস্কার করে গোটা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. জাহিদ হাসান তাপস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জাহিদ আবিস্কৃত ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ কণার কথা প্রায় ৮৫ বছর আগে ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী হারম্যান ভাইল প্রথম কল্পনা করেছিলেন। এর ৮৫ বছর পর ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ কণার অস্তিত্ব আবিস্কার করেন ড. জাহিদ। ফার্মিয়ন কণা আবিস্কারের পথ ধরে এবার তিনি আরও এক চমক নিয়ে এসেছেন, পৃথিবীবাসীকে অবাক করার মতো তার নতুন চমকের নাম ‘টপোলজিক্যাল ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক’। তার এই আবিস্কারটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘নেচার’ আর মাত্র একদিন পর ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করবে। ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক আবিস্কারের ফলে কম্পিউটার বর্তমানের চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হবে এবং মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযুক্তি যুক্ত হবে।

অধ্যাপক ড. জাহিদ হাসান তাপসের নেতৃত্বে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ২২ সদস্যের  একদল গবেষক দীর্ঘদিন গবেষণার পর ‘ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক’ আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। অধ্যাপক ড. জাহিদ হাসান তার নতুন এই আবিস্কার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি শহর থেকে টেলিফোনে সমকালকে বলেন, ‘নতুন ডিসকভারিটি, যার নাম রাখা হয়েছে টপোলজিক্যাল ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট, এটি কম্পিউটারকে শতগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন করবে। কম্পিউটারে যে মেমোরি বা হার্ডডিস্ক রয়েছে, সেখানে একটি স্টোরেজ থাকে, সেই স্টোরেজকে শতগুণ বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন করবে ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট, অর্থাৎ অল্প জায়গার মধ্যে ১০০ গুণ বেশি তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে।’

ন্যানো টেকনোলজিতে এই আবিস্কার একটি বিপ্লব আনতে পারে। ড. তাপস বিষয়টি আরও পরিস্কার করে বলতে গিয়ে বলেন, ‘ধরুন, নতুন কোনো কম্পিউটারে ইনফরমেশন স্টোরেজ ক্যাপাসিটি হয়তো ১০০ মেগাবাইট। এই ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট ব্যবহারে সেটা আরও বেশি ক্যাপাসিটিতে উন্নীত হবে, সেটা কীভাবে করা সম্ভব, কীভাবে ওটা কাজ করবে- সেটাই আবিস্কার করেছি। তবে এটার ফল পেতে আরও বেশ সময় লাগতে পারে।’

১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের ‘নেচার’ এবং পরদিন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাহিদের এ আবিস্কার প্রকাশ করা হবে। ড. জাহিদ জানান, এর আগে যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচারে তার আবিস্কৃত টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর নামে নতুন একটি কোয়ান্টাম প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা বিশ্বের শীর্ষ ১০ আবিস্কারের মধ্যে রয়েছে আজ পর্যন্ত। আর ভাইল ফার্মিয়ন তো আছেই।

বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার শ্রীপুর সংসদীয় আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীর ছেলে ড. জাহিদ হাসান তাপস। তার মায়ের নাম নাদিরা আলী। ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘বোসন’ নামে একটি কণা আবিস্কারের ৯১ বছর পর আরেক বাঙালি ড. জাহিদের নেতৃত্বে আবিস্কৃত হয়েছে নতুন গ্রুপের একটি কণা, ভাইল ফার্মিয়ন নামের ওই কণা ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ ড. জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে গবেষক দলের এই সাফল্যের খবর ও ভাইল ফার্মিয়ন কণার সন্ধান পাওয়ার প্রামাণ্য তথ্য বিশদভাবে প্রথম প্রকাশ করে। এবারের আবিস্কার ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট কম্পিউটার এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য অপরিহার্য হতে পারে। ড. জাহিদ হাসান বলেন, ‘মানব সভ্যতাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য কাজ করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের এই আবিস্কারের সুফল ভোগ করবে। সেটা হয়তো ১০ থেকে ২০ বছর লাগতে পারে। ক্যাগোমে হলো জাপানি একটি বাস্কেট ডিজাইন প্যাটার্ন। এই প্যাটার্নটা জাপানিরা অনেক আগেই আবিস্কার করেছিল। কিন্তু তারা টপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম চুম্বক আবিস্কার করতে পারেনি, যেটা আমরা পেরেছি। আবিস্কৃত এই কোয়ান্টাম চুম্বকটি এমআরআই করার ক্ষেত্রে আরও অধিকতর স্বচ্ছ দেখাবে।’

ভাইল ফার্মিয়ন কণা সম্পর্কে অধ্যাপক জাহিদ হাসান তাপস জানান, তিন প্রকারের ফার্মিয়নের মধ্যে ‘ডিরাক’ ও ‘ময়োরানা’ নামক ফার্মিয়ন কণার খোঁজ আগেই পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বহু গবেষণা ও প্রতীক্ষার পরও ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ কণার সন্ধান না মেলায় বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন ‘নিউট্রিনোই’ সম্ভবত ভাইল ফার্মিয়ন। ১৯৯৮ সালে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ‘নিউট্রনোর’ ভর আছে, ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ ভরশূন্য। এরপর থেকে ভাইল ফার্মিয়নের খোঁজে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাতে থাকেন। অবশ্য ড. জাহিদ বলেন, ভাইল ফার্মিয়নের অস্তিত্ব প্রমাণ হওয়ায় দ্রুতগতির ও অধিকতর দক্ষ ইলেক্ট্রনিকস যুগের সূচনা হবে। এই আবিস্কার কাজে লাগিয়ে আরও কার্যকর নতুন প্রযুক্তির মোবাইল ফোন বাজারে এসে যাবে, যা ব্যবহারে তাপ সৃষ্টি হবে না। ভাইল ফার্মিয়ন কণার ভর নেই বলে এটি ইলেকট্রনের মতো পথ চলতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে না, তৈরি হবে নতুন প্রযুক্তির কম্পিউটার ও বৈদ্যুতিক নানা সামগ্রী।

এই পৃথিবীর যাবতীয় গ্রহ-নক্ষত্র, নদী-নালা, সমুদ্র-পর্বত, প্রাণিজগৎ,গাছপালা, মানুষ সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার পিণ্ড। মহাজগতের এসব বস্তুকণাকে বিজ্ঞানীরা দু’ভাগে ভাগ করেন। একটি হলো ‘ফার্মিয়ন’, অন্যটি ‘বোসন’। এই বোসন কণা আবিস্কার করেছিলেন ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তার নামেই নামকরণ করা হয় বোসন কণার। ‘ফার্মিয়ন’ কণার একটি উপদল হলো ‘ভাইল ফার্মিয়ন’, এই ভাইল ফার্মিয়ন কণার মতোই ‘ক্যাগোমে কোয়ান্টাম ম্যাগনেট’ আবিস্কার মানব সভ্যতার জন্য অনিবার্য হয়ে হয়ে উঠবে।

১৯৭০ সালের ২২ মে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন জাহিদ হাসান তাপস। ১৯৮৬ সালে ধানমণ্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গণিতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চার দিন ক্লাস করার পর আর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি বলে জানান। তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় সময়ই মারামারি হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির এই বিষয়টা জাহিদ অপছন্দ করতেন। ওই বছরই স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান আমেরিকা। অস্টিনের টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞানে। সুযোগ হয় নোবেল বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের কাছে শিক্ষা গ্রহণের। এরপর মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে চলে যান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলত তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কাজ করেন অসংখ্য খ্যাতিমান ও নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে। এরই মধ্যে বিশেষ আমন্ত্রণে গেস্ট হয়ে লেকচার দিতে যান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার লেকচার শুনে মুগ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রস্তাব আসে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের।

বর্তমানে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মাহমুদ হাসান মুকুল ছিলেন জাহিদ হাসান তাপসের গৃহশিক্ষক। পুরনো ওই ছাত্রের কথা বলতে গিয়ে মাহমুদ হাসান মুকুল বলেন, ‘তাপস শুধু মেধাবীই ছিল না, সে এক বিস্ময়বালক। আমি যদি এক নিয়মে অঙ্ক করে দিতাম পরদিন বাসায় গিয়ে দেখতাম সেই অঙ্কই দুই-তিন নিয়মে করে রেখেছে সে। নিজেই আবিস্কার করত অঙ্কের নতুন নতুন নিয়ম। শিশু তাপসের এমন প্রতিভা দেখে শিক্ষকরা শুধু অবাকই হতেন না, তার কাছ থেকে অঙ্কের নতুন নিয়ম বের করার কৌশলও জেনে নিতেন।’