জাবি ভিসি কেন জামায়াত-শিবির খুঁজছেন?

জাবি ভিসি কেন জামায়াত-শিবির খুঁজছেন?

জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম – সংগৃহীত

সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির অপসারণ দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। এর এক পর্যায়ে মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের উপর হামলা হয় এবং এর পরপর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনকারীরা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এদিকে আন্দোলনকারীদের পেছনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের মদদ আছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।

ভিসি ফারজানা ইসলাম প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্যানেল থেকে ভিসি প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৪ সালে।

শিক্ষকদের ওই সংগঠনেরই যুগ্ম সম্পাদক ড: তারেক রেজা আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে সুপরিচিত।

ওই একই সংগঠনের নাজমুল হাসান তালুকদার ও আব্দুল জব্বার হাওলাদার দীর্ঘকাল ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের মূল অংশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু চলমান উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনে তারাও রয়েছেন সামনের সারিতেই। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও এখনো ক্যাম্পাস ও হল ছাড়েনি বহু শিক্ষার্থী।

আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে আন্দোলনরতরা।

যদিও ভিসি ফারজানা ইসলাম নিজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান বলেছেন, এবারের আন্দোলনে জামায়াত শিবিরের তৎপরতা দেখতে পেয়েছেন তারা।

নাজমুল হাসান মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘জামায়াত শিবির বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল করছে। আরো অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”

ওইদিন ক্যাম্পাসে ব্রিফিং এ ভিসি দাবি করেন তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পেছনে আছে জামায়াত শিবির।

যদিও ভিসির এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ও ক্যাম্পাসে সাবেক ভিসি শরীফ এনামুল কবিরপন্থী ড: তারেক রেজা বুধবারই ভিসির পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাসে সংহতি সমাবেশে অবস্থানকালেই ফোনে কথা বলেন বিবিসি বাংলার সাথে।

তারেক রেজা বলছেন, “ভিসি কাদের জামায়াত শিবির বলছেন? কয়েক দশক ধরে ছাত্র থাকাকালে ও পরবর্তীকালে শিক্ষক হয়ে যারা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন তারাই এখন দুর্নীতির কারণে ভিসির পদত্যাগ চাইছেন।”

তিনি বলেন আনু মুহাম্মদ, মীর্জা তাসলিম সুলতানা, রায়হান রাইন, সাইদ ফেরদৌস ছাত্র জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

“আমরা অনেকেই জীবনভর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্য লড়াই করছি। এখন শুধু পদ আঁকড়ে রাখার জন্য উনি (ভিসি) সবাইকে জামায়াত শিবির বলা শুরু করেছেন।”

চলমান ভিসিবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সুমাইয়া আরেফিন শিশির বিবিসিকে বলছেন, “যৌক্তিক আন্দোলন দেখলেই আওয়ামী লীগের একটি অংশ এই গীত গাইতে শুরু করে। যাকে তাকে জামায়াত শিবির বলে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে চায় তারা।”

তিনি বলেন, ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বর্তমান ভিসি দায়িত্বে আছেন ২০১৪ সাল থেকে।

“জামায়াত শিবির নির্মূল তারা এতোদিনেও করতে না পারলে সেই ব্যর্থতার জন্যই তাদের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত। কোনো আন্দোলন দানা বাঁধলেই একটি চক্র জামাত শিবির সুর তোলে। এটি দুর্নীতিবাজদের চক্র।”

তিনি বলেন, “লক্ষ্য করে দেখুন শিক্ষকরা কার নেতৃত্বে। তাদের ও জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাস দেখুন। বরাবর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার তারা। এখন দুর্নীতিকে জায়েজ করতে এদেরকেও জামাত শিবির বলা শুরু করেছেন ভিসি ও তার সহযোগীরা।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শারমিন সুলতানা লাকী বলছেন, এটা এখন সারাদেশেই একটা স্টাইল হয়ে গেছে যে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তাকে জামায়াত শিবির আখ্যা দিয়ে নিজেকে বাঁচানো বা কাউকে অন্যায়ভাবে বিপদে ফেলতেও এটা করছে ক্ষমতাসীনরা।

“ভিসি আমাদের শিক্ষকদের জামায়াত শিবির বলা শুরু করেছেন কারণ ১৪ শ’ কোটি টাকার মোহে তারা অন্ধ হয়ে গেছেন। ক্যাম্পাসের প্রতিটি বিন্দু আমাদের পরিচিত, আবার আমরাও ক্যাম্পাসে তেমন। ক্যাম্পাসের গাছ-প্রকৃতি নষ্ট করলে আমাদের রক্তক্ষরণ হয়। এই ন্যায্য আন্দোলনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার নকশা থেকেই জামায়াত শিবির প্রচার শুরু করেছে, কিন্তু তাতে লাভ হবে না।”

অধ্যাপক শারমিন সুলতানার সাথে একমত শিক্ষার্থী রিদিতা তাহসিন অদিতি। তারা দু’জনেই ভিসিবিরোধী সমাবেশে অংশ নিচ্ছিলেন।

তিনি বলছেন, তার বন্ধু যিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের, তার ওপরেও জামায়াত শিবির আখ্যা দিয়ে হামলা করা হয়েছে।

“মুক্ত মনের কিছু চিন্তা করলেই আপনাকে জামায়াত শিবির আখ্যা দেয়াটা এখন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে এবং এটা করছে শাসক দলের সাথে জড়িতরা। এবারের আন্দোলন যৌক্তিক বলেই প্রশাসন এই অনৈতিক প্রচারণা শুরু করেছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে।”

যদিও ভিসির দাবি তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরতদের পেছনে জামায়াত শিবিরই, তবে এর স্বপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য তিনি উপস্থাপন করেননি।

সোমবারের ব্রিফিং এ তিনি বলেছেন আন্দোলনের পেছনে জামায়াতের উপস্থিতির প্রমাণ তার কাছে আছে ও তিনি তদন্ত করে বিচার করবেন।

তবে ভিসিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত কয়েকজনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।

উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে প্রায় তিন মাস আন্দোলন করছে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

সোমবার থেকে তারা ভিসির বাসভবন ঘেরাও করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলো। কিন্তু মঙ্গলবার ছাত্রলীগ ও ভিসিপন্থী কয়েকজন শিক্ষক তাদের ওপর হামলা করে তাদের সরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ আসে।

যদিও ভিসি ছাত্রলীগের প্রশংসা করে বলেছেন তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে, হামলা করেনি।

এ সময় তিনি আন্দোলনের পেছনে জামায়াত শিবির আছে বলে দাবি করেন।

– বিবিসি