today-is-a-good-day
Tuesday, April 23, 2024

চকবাজার অগ্নিকাণ্ড: চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির একদিন

চকবাজার অগ্নিকাণ্ড: চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির একদিন

রাতভর চেষ্টার পর সারাদিনও ব্যস্ত সময় কাটে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদেরছবির কপিরাইট শাহনেওয়াজ রকি
Image caption রাতভর চেষ্টার পর সারাদিনও উদ্ধার অভিযানে ব্যস্ত সময় কাটে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের

২০১০ এর নিমতলি থেকে ২০১৯ এর চকবাজার। পুরান ঢাকাতে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

একরাতের অগ্নিকান্ডে ৭৮ জন নিহতের পরদিন কেমন ছিল?

কেনা কাটা কিংবা খাওয়া দাওয়া, এর আগে চকবাজার বহুবার যাওয়া হলেও চুড়িহাট্টা জায়গাটার সঙ্গে সেভাবে পরিচয় নেই।

বুধবার রাত থেকেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে পরিচিতি পাওয়াএই জায়গাটি কোথায়, মানুষজনকে তা জিজ্ঞেস করতেই আগ্রহ নিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল, যেনবা কারো অপেক্ষায় পথ দেখাতে দাড়িয়ে তারা।

তবে কথায় আছে না; কিছু পথই আপনাকে পথের দিশা দেয়! এরপর আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হল না, জনতার উৎকন্ঠিত মুখ আর দূর থেকে ভেসে আসা কোলাহলের শব্দ আমাদের উৎসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিংবা এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার দিকে!

একুশে ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টা

এখন আর চুড়িহাট্টা আগে থেকে চেনা বা না চেনায় কিছু যায় আসে না।

কারণ এই একুশে ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টা একটা মৃত্যুপুরী। প্রথম দেখায় মনে হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন পরিত্যক্ত এলাকা।

আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশন
Image caption আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশন

এখানকার প্রতিদিনের বাসিন্দা আব্দুল আজিজও তাই এই চুড়িহাট্টাকে চিনতে পারেন না। তার শূন্যদৃষ্টি এখনও যেন চোখের সামনে আগুন আর সবকিছু ছাই হয়ে যাওয়া দেখছে।

আমাদের চোখের সামনে অবশ্য হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের ধ্বংসস্তুপ দাড়িয়ে।

আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া চারতলার অবয়ব। ফায়ার সার্ভিসের দেয়া পানির ফোঁটা আর স্তিমিত হয়ে আসা ধোঁয়া দুটোই নজর কাড়ে।

“মঞ্জু চাচা তো গেছে গ্যা”

মোট পাঁচটি রাস্তার মিলনকেন্দ্র এটি।

শাহী মসজিদটার ঠিক সামনে রাস্তার এপার-ওপার দুটো গাড়ি, শুধু কাঠামোটা বলছে এটা গতরাতে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত গাড়িই ছিল বটে।

অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া গাড়ির অবশিষ্ট অংশ
Image caption অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া গাড়ির অবশিষ্ট অংশ

অনেকগুলো রিক্সা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির কিছু অংশ যেগুলো দাহ্য নয়, সেগুলো টিকে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এখনো।

পোড়া মোটরসাইকেল আর পিকআপও চোখে পড়ে।

দোকান কোনটা খোলা, কোনটার শাটার অর্ধেক বা পুরো বন্ধ। তবে অনুমান করতে অসুবিধা হয়না যে ভেতরের অবস্থা সবগুলোর একইরকম।

আগুন নিভে যাবার পর প্রতিদিনের রুটি রুজির দোকান যেন হারিয়ে খুঁজছেন মালিক
Image caption আগুন নিভে যাবার পর প্রতিদিনের রুটি রুজির দোকান যেন হারিয়ে খুঁজছেন মালিক

“এখানে একটা ফার্মেসি ছিল, দুজন আলেম ভেতরেই মারা গেছেন”-বলে উঠেন একজন।

কারো দাবী-এই হোটেলটাতেই মারা গেছে বেশি।

হঠাতই কানে আসে একজন আরেকজনকে বলছে-শুনছস মঞ্জু চাচা তো গেছে গ্যা!

তার কাছেই বিস্তারিত বিবরণ মেলে।

“এই ডেকোরেটর দোকানটা ওনার ছিল। বন্ধ করতেছিলেন। এসময় বিস্ফোরণ শুনে মনে করেন মারামারি লাগছে। সাথে সাথে শাটার নামায় দেন, ভেতরে আরেকটা ছেলে ছিল দুজনেই শ্যাষ।”

এই দোকানগুলো স্বরুপে ফিরলেও, এর মালিকরা এই দু:স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি?
Image caption এই দোকানগুলো স্বরুপে ফিরলেও, এর মালিকরা এই দু:স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি?

কেমিক্যাল না সিলিন্ডার?

পায়ের নিচে শর্ষেদানার মতো প্লাস্টিকের কাঁচামাল।

ধবধবে সাদা প্লাস্টিকের গুড়ো কালো, পানি কালো, রং বেরংয়ের বিভিন্ন প্রসাধনী প্যাকেট ও পারফিউমের কৌটা সব পুড়ে কালো।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসায় উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ে। আর কোন পরিচিত স্বজনদের পাওয়ার আশা যখন শেষ তখন তর্ক শুরু হয় আগুনের সূত্রপাত নিয়ে।

কারো দাবী ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে আগুনের শুরু, কেউবা বলতে থাকেন গাড়ির সিলিন্ডার যত নষ্টের গোড়া।

পুরান ঢাকার এই স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে তখন স্পষ্টত দুটি দল। একদল রাসায়নিক কারখানাকে কোনভাবেই দায়ী করতে রাজি নন।

“কেমিক্যাল কি? এখানে তো বছরের পর বছর কেমিক্যাল কারখানা আছে, আপনারা গাড়ির সিলিন্ডারগুলো ঠিক করেন। এই যে নষ্ট সিলিন্ডার দিয়ে গাড়িগুলো চলতাছে কেউ খবর রাখে?”-তেড়ে আসেন ত্রিশোর্ধ্ব একজন।

আরেকদল আবার যেকোন মূল্যে চান এই এলাকাগুলো থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামের অপসারণ।

“আমাদের একটাই আর্জি এই রাসায়নিক কারখানাগুলো সরকার সব সরায়া নিক। আমাদের বাঁচান”-আর্তি জানাচ্ছিলেন এলাকার স্থায়ী পঞ্চাশোর্ধ্ব এক বাসিন্দা।

প্লাস্টিক কাঁচামালের একাংশ
Image caption ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক কাঁচামালের একাংশ

জীবন না ব্যবসা?

মসজিদের সামনে যে দুটো গাড়ি পুড়ে অঙ্গার তার একটির মালিক মাহাবুবুর রহমান। প্রতিদিনের মতোই ঘরে ফিরছিলেন।

“জ্যামে যখন আটকা তখন শুনি হঠাৎ একটা বিকট শব্দ, আর আগুনের উল্কাপিন্ডের মতো কিছু একটা গাড়িতে উড়ে এসে পড়ে ও আগুন ধরে যায়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার পুরো গাড়িতে আগুন। দেখি আমার দরজাও খুলছে না। এসময় ড্রাইভার তার দরজা খুলে বের হয় ও আমাকে বলে ভাই তাড়াতাড়ি বের হন। এরপর কিভাবে আমি বের হইছি বলতে পারিনা।”

প্রাণে বাঁচলেও এই আতঙ্ক যে তাকে অনেকদিন তাড়া করে ফিরবে তা বলাই বাহুল্য। তার কাছেই জানতে চাই, এ থেকে উত্তরণের কোন পথ কি আছে?

“পুরান ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে হয়তো এরকম বড় ঘটনা থেকে নিজেদের সেফ করা যাবে। কিন্তু জীবনটাকে তুচ্ছ করে যদি ব্যবসাটাকে প্রাধান্য দেই তাহলে এরকম ঘটনা বারবার ঘটবে। ”

আগুনে ভেতর থেকে বেঁচে ফেরা মাহাবুবুর রহমান
Image caption আগুনে ভেতর থেকে বেঁচে ফেরা মাহাবুবুর রহমান

হঠাৎ আবার বিস্ফোরণ

ঘড়িতে বেলা চারটা বেজে গেছে।

ঘাতক আগুনও নিয়ন্ত্রণে আসে, উদ্ধার অভিযান শেষের পথে।

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন চারদিক। এসময় হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ।

ওয়াহেদ ম্যানশনের তিনতলার জানালা দিয়ে দেখা মেলে আগুনের লেলিহান শিখা। মূহুর্তের মধ্যে শুরু হয়ে উপস্থিত জনতার হুড়োহুড়ি, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ব্যস্ততা।

আগ্রহী জনতার চাপ সামাল দেয়াটা ছিল সারাদিন চ্যালেঞ্জ। রাস্তায় বেরিকেড দিয়েও আটকানো যায়না মানুষের ঢল।

এরপর আবারো বিস্ফোরণের শব্দ। স্থানীয়রা জানান দেন ওখানে কেমিক্যাল আছে সেগুলো থেকেই নতুন করে এই আগুন। আধাঘন্টার চেষ্টায় আবারো সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।

আবারো এসে ভিড় জমায় উৎসুক কৌতুহলী জনতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাইকে সরিয়ে দিতে গেলে একজন অনুরোধ করেন “ভাই আমাকে এখানে থাকতে দেন। আমার গাড়ি আছে।”

পুলিশের ঐ কর্তা জানতে চান কোনটি। পুড়ে যাওয়া একটা গাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন যুবক। পুলিশের তাতে মন গলে না। “আপনি কি ঐ গাড়ি এখন নিতে পারবেন? এখানে ভিড় করে লাভ কি।” নির্বাক যুবক তবু সরে না!

এই কবুতরটিও কি তাঁর স্বজনকে খুঁজছে?
Image caption এই কবুতরটিও কি তাঁর স্বজনকে খুঁজছে?

সারা দিন ধরে নানা শ্রেণির-নানা পেশার মানুষ ভিড় করেছেন চকবাজারে। এই মর্মান্তিক দুঘটনা ছুঁয়ে গেছে তাঁদের প্রত্যেককেই।

এদের অনেকেই নিমতলির ঘটনারও স্বাক্ষী। এবার তাই একটা স্থায়ী সমাধান চান সবাই।