গৃহপালিত বিরোধী দলের উদ্ভাবকের আত্মকথা

Daily Nayadiganta


আমি যখন গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলাম তখন পৃথিবীর কোনো ব্যাকরণ কিংবা অভিধানে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ শব্দগুলো সংযোজিত হয়নি। ফলে একজন নেতা হিসেবে কিভাবে অন্য কোনো নেতার গৃহপালিত হয়ে সর্বোচ্চ ফায়দা হাসিল করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে আমি মাসের পর মাস নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। প্রকৃতিতে যেসব প্রাণী গৃহপালিত হিসেবে সফল এবং প্রশংসিত আমি গভীর অনুসন্ধানী অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে সেসব প্রাণীকে বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। অন্য দিকে যেসব মানুষ নিয়মিত গৃহপালিত পশু-পাখি লালন-পালন করেন তাদেরও পর্যবেক্ষণ করেছি। তারপর একজন গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতার বৈশিষ্ট্য আচরণ-সংলাপ-অঙ্গভঙ্গি, পোশাক, খাবার-দাবার, পানীয়, বাসস্থান এবং পরিবেশ কী রূপ হওয়া উচিত তা নিয়ে গবেষণালব্ধ ম্যানুয়াল তৈরি করেছি। পরিশেষে রাত-দিন পরিশ্রম করে রিয়ার্সাল দেয়ার পর অপারেশনে নেমে সাফল্য পেয়েছি।

আজকের দিনে যখন জীবন ও জীবিকার সর্বত্র গৃহপালিত লোকজনের সফলতা দেখি, তখন আবেগে আমার কান্দন চলে আসে। যখন দেখি অনেক মানুষ একই সাথে গৃহপালিত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে এবং নিয়োগ লাভের জন্য বাহারি চেষ্টা তদবিরের পাশাপাশি তাবিজ-কবজ, জাদু-টোনা-বাণ, পুজো-অর্চনাসহ অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করছে তখন আনন্দে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ি। যখন দেখি আমার মানস পুত্র-কন্যা এবং নাতি-পুতিরা অর্থ-বিত্ত, পদ-পদবি হাসিল করার পর সমাজের সৎ-যোগ্য-নীতিবান এবং জ্ঞানীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ওসব লোকের জবানে তালা মেরে দিয়েছে এবং মাথার ওপর হাজারো দায়দেনার বোঝা চাপিয়ে মস্তক অবনত করতে বাধ্য করছে এবং সর্বোপরি তাদের নীতিকথা শুনাচ্ছে তখন গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে যায়।

আমার আরাধ্য কর্মে সফলতা লাভের জন্য সর্বপ্রথমে আমার মেরুদণ্ড, চোয়াল, মাথা, ঠোঁট, জিহ্বার ব্যায়াম শুরু করলাম। দ্বিতীয় ধাপে আমার হাত, কোমর-পা এবং বিশেষ অঙ্গের লেফট-রাইট করার ক্ষেত্রে নৈপুণ্য অর্জনের চেষ্টা চালাতে থাকলাম। এরপর আমার চিন্তা, কথা-বার্তা, হাসি-তামাশার কার্যপ্রণালী বিধি রচনা করে ভোগ-বিলাস-আহার-নিদ্রার সাথে সমন্বয় করলাম। সবশেষে আমার দৃষ্টি, ঘ্রাণশক্তি এবং অনুভূতিকে মালিকের কদম মোবারকে নিবেদন করে রীতিমতো রোবটে পরিণত হলাম। আমার পরিচালনা শক্তিকে রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে সেই যন্ত্রটিকে মালিকের হাতে সমর্পণ করে পুতুলের মতো নাচার জন্য দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা নিজেকে প্রস্তুত রাখতে আরম্ভ করলাম।

উল্লেখিত অনুশীলন চালাতে গিয়ে আমি কিরূপ কষ্ট করেছি তা যদি বিস্তারিত না বলি তবে আপনারা গৃহপালিত রাজনৈতিক দল-গোষ্ঠী এবং এসব দলের ও গোষ্ঠীর নেতানেত্রীদের হাল হকিকত সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন না। আমি সবার আগে আমার মেরুদণ্ডটির ব্যাপারে নজর দিলাম। সার্কাসের লোকদের মতো আমি যেন আমার পুরো শরীর ডানে-বামে এক শত আশি ডিগ্রি এবং সামনে পেছনে তিন শত ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকাতে পারি সেই চেষ্টা করতে শুরু করলাম। তারপর নিজের দুই পায়ের মধ্যে চিৎ হয়ে উল্টো দিক দিয়ে মাথাটি ঢুকিয়ে যেন মালিকের ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে কিলবিলিয়ে হাসতে পারি এমনতর অনুশীলন করতে গিয়ে আমার কী যে কষ্ট হতো সেটি যদি লোকজন একটু অনুভব করত তবে কিছুটা হলেও শান্তি পেতাম।

মেরুদণ্ডকে আমার মালিকের ইচ্ছায় আঁকাবাঁকা করার যোগ্যতা অর্জন করার পর আমি আমার চোয়াল দাঁত ঠোঁট এবং জিহ্বাকে মালিকের কাজে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হলাম, মালিকের ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলা- হাসি কিংবা কান্না করা, কোনো কিছু চুম্বন করা অথবা কোনো আকর্ষণীয় বা সম্মানীয় বিষয়বস্তুর ওপর ঘৃণা মিশ্রিত থুথু নিক্ষেপ করা এবং সর্বোপরি মালিকের শত্রুদের বেধড়ক কামড়ানোর যোগ্যতা অর্জনের অনুশীলন করতে গিয়ে আমি সত্যিই মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম যে, আমার শ্রবণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং জিহ্বার স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ে কোনো অবস্থাতেই অন্যের ইচ্ছায় চোয়াল-ঠোঁট-দাঁত-জিহবা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত আমার মনমস্তিষ্ক যদি স্বাভাবিক মানুষের মতো কাজ করে তাহলেও কাক্সিক্ষত সফলতা আসবে না। মনের যে জায়গাটিতে মায়া মমতা দরদ উথলে ওঠে সেখানে বিষের ভাণ্ডার স্থাপন এবং মস্তিষ্কের যেখানে ভালো চিন্তার মেশিন বসানো রয়েছে সেটিকে অকার্যকর করাটা যে জরুরি তা আমি খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলাম।

আমার সমস্যাগুলো নিয়ে চেনাজানা অনেকের সাথেই কথা বললাম। কিন্তু কেউই আমাকে পরামর্শ দিতে পারল না। আর পারবেই বা কিভাবে! কারণ মানুষের মনমস্তিষ্ক থেকে সাধারণত ওসব বের হবে না। এ অবস্থায় আমি মানুষ বাদ দিয়ে অমানুষের খোঁজে বের হলাম এবং যারা অতীন্দ্রিয় বিষয়াদি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেরকম কাপালিকদেরও খুঁজে বের করলাম। যখন তাদের পেলাম এবং তাদের পরামর্শগুলো শুনলাম তখন এক অনাহূত বিজয়ের আনন্দে পতঙ্গের মতো খুশিতে নাচতে শুরু করলাম। যথাযথ অনুশীলন কিছু নির্ধারিত নোংরা খাবার ভক্ষণ, পূতি দুর্গন্ধময় স্থানে রাত যাপন, কিছু অশ্লীল কর্ম সম্পাদন এবং কাপালিকদের সান্নিধ্যে নির্ধারিত সময় অতিবাহিত করার পর আমি টের পেলাম যে আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাক্সিক্ষত মাত্রায় ভোঁতা হয়ে গেছে। বিবেক বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। আমি এমন এক প্রেতাত্মায় পরিণত হলাম যে কিনা তার মালিকের সব নোংরা আদেশ নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালনে সক্ষম।

নিজের কর্ম সম্পর্কে আস্থাশীল হওয়ার পর আমি যথারীতি আমার মালিকের দরবারে হাজির হলাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন যে, আমার মধ্যকার মনুষ্যত্ব, শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং মেরুদণ্ডসহ অন্যান্য পৌরুষত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো বিলীন হয়ে গেছে। তিনি কেবল মুচকি মুচকি হাসতে থাকলেন। তার সেই হাসি দেখে আমার শরীরের মধ্যে এক ধরনের বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকল। আমি নতজানু হয়ে তার পায়ের ওপর পড়ে গেলাম। তিনি আমার মাথায় হাত বোলালেন তারপর বারকয়েক পিঠের ওপর মৃদ্যু চপেটাঘাত করে মেরুদণ্ডের হাড্ডিগুলোর অবস্থা অনুমান করলেন এবং সম্ভবত আমার নতজানু হওয়াটা পছন্দ করলেন। আমি মাথা নুয়ানো অবস্থাতেই মালিকের অট্টহাসি টের পেলাম। তিনি দয়া করে আমার চুল ধরে মৃদু টান দিলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

উল্লেখিত ঘটনার পর আমার চাকরি হয়ে গেল। আমি মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলাম। আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাজনীতিতে বিনোদন এবং জাতীয় জীবনে সর্বনাশ করার জন্য বিরাট এক সার্কাস পার্টি গঠন করে ফেললাম। জনগণ যাতে যুগপতভাবে বিভ্রান্ত এবং বিনোদিত হয় সেসব কথা ও কাজের সমন্বয় করে ঝড়ের গতিতে এগোতে থাকলাম। আমার নিয়োগকর্তার যাবতীয় অবৈধ অভিলাষ, চারিত্রিক বিভ্রাট, অশ্লীল কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, অনাচার, ব্যভিচার, যথেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ইত্যাদি সব নারকীয় কর্মকে উপাদেয়রূপে নিজে ভোগ করে তৃপ্তি লাভের ভান করলাম এবং অন্য অনেকের ওপর তা চাপিয়ে দিলাম। ফলে রাজকোষের অর্থ, ক্ষমতা, জনগণের হক, মানসম্মান, ইজ্জত ইত্যাদি হরণ করার ক্ষেত্রে আমি ও আমার নিয়োগকর্তার মধ্যে এক অলিখিত সমঝোতা হয়ে গেল।

আমার মালিক আজ আর নেই। ফলে আমিও তার দেয়া সেই ভোগবিলাস মদ বাৎসল্য পাচ্ছি না বটে কিন্তু আমার কুকর্মজাত অঢেল সম্পদ আজো সাধারণ মানুষের চক্ষু চড়কগাছ বানিয়ে ফেলে। ফলে যে বিষবৃক্ষ আমি রোপণ করেছিলাম তার বিষক্রিয়া বিস্তার লাভ করতে করতে সমাজ সংসারের রাজনীতি-অর্থনীতি, চাকরি-চাকরি, শিক্ষা-দীক্ষা, বিচার-আচার, গল্প-কবিতা, নাটক-সিনেমা ইত্যাদি সবকিছুকে বিষময় করে তুলেছে। বিষের নেশায় পাগলপারা হওয়ার জন্য আমার মতো লাখ লাখ ধড়িবাজ, ফেতনাবাজ, চালবাজ, তেলবাজ প্রভৃতি শ্রেণিপেশার মনুষ্যরূপীরা পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজ নিজ সেক্টরে গৃহপালিত প্রাণী হওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

যখন আমার কুকর্ম শুরু করেছিলাম তখন ভেবেছিলাম হয়তো আমিই প্রথম এবং আমিই শেষ। আমি আরো ভেবেছিলাম যে, রাজনীতির বাইরে অন্য কোনো শ্রেণিপেশায় গৃহপালিত মনুষ্যরূপী অমানুষের বিস্তার ঘটবে না। কিন্তু মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে আমার উদ্ভাবন যে এতটা বিস্তার লাভ করবে এবং নিজের উদ্ভাবন সম্পর্কে আমার আশাবাদকে ভুল প্রমাণ করে দেবে তা আমার মন ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেনি। আজ আমার লাখ লাখ মানসপুত্র-কন্যা নাতি-পুতিরা যেভাবে দুর্নীতির উল্লাস নৃত্যের উৎসব করছে তা দেখে জীবন সায়াহ্নে মনে হচ্ছে- ইস! আরেকটি বার যদি ক্ষণেকের তরে হলেও পুরনো পদটি ফিরে পেতাম তাহলে না জানি কতই মজা হতো!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য