কী পরিকল্পনায় ছিল পাকিস্তান

  • মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা
  •  ১৪ মার্চ ২০২২, ২১:৪৭

[৫ম পর্ব]
প্রতিষ্ঠার মাত্র ১১ বছরের মাথায় এমন বিস্ময়কর পরিকল্পনাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫৮ সালের ১৫ জুলাই, যা সামরিক শাসন জারির প্রায় মাস তিনেক আগের কথা। তুরস্কের আঙ্কারায় বাগদাদ চুক্তির রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট এস্কেন্দার মির্জা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আইউব খান যোগ দেন তার একান্ত সহযোগী আলতাফ গওহরকে সাথে নিয়ে, যাকে অবসরকালীন কথোপকথনে ইরানের শাহানশাহ রেজা শাহ পাহলভি পূর্ব-পাকিস্তানের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কাশ্মির নেয়া ও ইরান-পাকিস্তান কনফেডারেশন করার পরিকল্পনা জানেন কি না জিজ্ঞাসা করার কথা তিনি তার ‘আইউব খান’ নামক বইয়ে ৫৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন। শ্রীলঙ্কার এক রাষ্ট্রদূতের কাছেও এই পরিকল্পনার কথা শুনেছেন বলে তখনকার পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত ফখরুদ্দিন আহাম্মদও লিখেছেন তার ‘Critical Times’ নামক বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায়। এর অনুমিত কারণ, তাদের বিবেচনায়, হয়তো বা মুসলিম চেতনায় পূর্ব-পাকিস্তানের বিচ্যুতি ঘটেছে ভাষার ক্ষেত্রে।

ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত সুদীর্ঘকালের মুসলিম শাসনে প্রসারিত ইসলাম ধর্মের কারণে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চল ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলে দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীরও অনেক ধর্মান্তরিতদের ভাষায় বহু উর্দু, আরবি ও ফার্সি বলে ইসলামী শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আদালত, মহাজনী ও জমিদারি সেরেস্তায়ও ব্যবহৃত এ ধরনের বহু শব্দ, না তাদের পরবর্তী ইংরেজরা, না তাদের উত্তরাধিকারী স্বাধীন ভারতীয়রা কখনো বাদ দেয়ার দাবি করেছেন। ফলে এগুলো আজো গোটা উপমহাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৩য় খণ্ড, ১ম পর্বের ৬৯৬ পৃষ্ঠায় ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সিলেট অঞ্চলের মুসলমান সমাজে বাঙালি মুসলমান অপেক্ষা উর্দুভাষী মুসলমানদের অধিকতর প্রভাব স্থাপিত হয়। তাই সিলেটী মুসলমান বাংলা হরফ ও বাংলা ভাষা ত্যাগ করিয়া দেব নাগরী (ছাদ ও আকারযুক্ত অক্ষর) হরফের অনুকরণে একপ্রকার জগাখিচুড়ি ধরনের লিপি গ্রহণ করিয়াছিল। ইহার নাম ‘সিলেটী নাগরী’। সিলেট অঞ্চলের মুসলমানি কিতাবগুলো এই হরফে লিখিত হইত।”

আজ প্রায় মৃতদেব ভাষা বলে গণ্য করা সংস্কৃত হতে উৎপন্ন হিন্দির প্রায় শব্দই বাংলা ভাষায় অভিন্ন। কারণ, বাংলায় বৌদ্ধ পরবর্তী হিন্দু ধর্মের অগ্রযাত্রায় শুধু ভাষাই নয়, বহু কিছুর নামও পরিবর্তিত করার সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাস। হিন্দিরই মুসলমানি রূপের উর্দুরও তদ্রূপ প্রভাব ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মীয় কারণে। অতএব আপত্তি, বিরোধ ও সমালোচনা সবেরই কারণ এখানে। তাই অনুপ্রবেশে ভাষাটিকে দূষিত করার অভিযোগ শুরু হয় মুসলিম লীগেরও জন্মের বহু আগে। কবি নজরুল ইসলামও এই অভিযোগে সমালোচিত ছিলেন। সর্বভারতীয় মুসলমানের মধ্যে ধর্মের পরে উর্দু ভাষাকেই অন্যতম, দ্বিতীয় বন্ধন বলে মুসলিম লীগ ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যখন গুজরাটি ভাষাভাষী জিন্নাহ কংগ্রেসের সদস্য আর পাঞ্জাবি ভাষাভাষী ও মাত্র ১৫ বছর বয়সী হরিয়ানার নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান মুসলিম লীগের কেউই ছিলেন না। ড. প্রদীপ কুমার লাহিড়ীর Bengal Muslim Thought, 1818-1947, Page-140, Note-51 এর তথ্য মতে, ১৯৪৪ সালের ১ ও ২ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম অধিবেশন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল সূত্রপাত ঘটেছে মুসলিম সংস্কৃতি ও সাহিত্যবহির্ভূত। বাংলা সাহিত্য যা এ সময়ে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রদান করেছেন তা পূর্ব-পাকিস্তানের নয়, কারণ এতে মুসলিম চেতনা নেই।’ পরবর্তী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর সুশোভন চন্দ্র সরকার ও মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যারা উভয়ই পূর্ববাংলা দাফতরিক ভাষা বাংলা করার সর্বপ্রথম দাবি জানান। পরে ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া পাকিস্তান শাসনতন্ত্র গঠনকর পরিষদের (CAP) প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৯৭১-এ কুমিল্লায় শহীদ হন) পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা বাংলা বিধায় একে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও ক্যাপের দাফতরিক ভাষা করার উত্থাপিত প্রস্তাবে কংগ্রেসের অন্য সব সদস্য (১৩ জন) সমর্থন করেন। এহেন প্রস্তাবটিতে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা বলে আপত্তি সহকারে লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র বিধায় এর রাষ্ট্রভাষাও মুসলিম জাতীয় হওয়ার কথা’। মুসলিম রাষ্ট্র বলায় বিরোধীদলীয় কংগ্রেস নেতা শিরীষ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। (সূত্র- প্রফেসর গোলাম কবিরের Minority Politics in Bangladesh, Page-19, 23, 24)
দৃশ্যতঃ মুসলিম লীগের সেই প্রস্তাবেরই কার্যকারিতায় পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা উর্দু না হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং প্রাদেশিক ভাষা যার যার ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে নেয়ার কথা বলেছিলেন জিন্নাহ। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হওয়ায় তারা হয়ত বা মনে করেছেন যে, ৪৩ বছর পূর্বকার (বাংলা ভাগ) মুসলমানের প্রত্যাখ্যাত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবারে উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সম্মিলিতভাবে হয়েছে সমাদৃত। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ ক্যাপের কর্মকারক প্রস্তাব গ্রহণকালে সংখ্যালঘু সদস্যগণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবি করেন। ১৯৫০ সালে ক্যাপের সদস্যসংখ্যা ৬৯ থেকে ৭৯-এ উন্নীত করা হয়। বর্ধিত এই ১০টির ৪টি প্রাক-স্বাধীনতা কালে পাকিস্তানের ৪টি রাজোচিত রাজ্যকে এবং বাকি ৬টি আসন ভারত থেকে রিফিউজি হয়ে পাকিস্তানে আসা বিশিষ্ট রাজনীতিকদের দেয়া হয়, যারা সবাই পূর্ব-পাকিস্তান হতে মনোনীত হতেন। যেমন : ১) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান; ২) খান আবদুল কাইউম খান; ৩) মালিক গোলাম মোহাম্মদ; ৪) ড. ইশতিয়াক হোসেন কোরেশী; ৫) ডা: মোহাম্মদ হুসাইন এবং ৬) মাওলানা সাব্বির আহাম্মদ ওসমানী। (সূত্র- প্রফেসর রফিক আফজালের পূর্বোল্লিখিত বই, পৃ-৪৭, নোট-২৪)। মনে হয়, এটা ছিল সংখ্যালঘুদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। কারণ, ১৯৫৩ সালেই তাদের ১৩ আসনসংখ্যা হ্রাস করে ১১ এবং ১৯৫৫ সালে ৯টি করা হয়। (সূত্র- প্রফেসর রঙ্গলাল সেনের Political Elites in Bangladesh, পৃষ্ঠা-১২৭)। অতঃপর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পূর্ববাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান নামকরণ ও সব প্রদেশকে এক ইউনিট করত পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্ররূপে সংবিধান ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পরক্ষণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভারত প্ররোচিত করতে শুরু করে। পরের বছর আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি উত্থাপনের প্রায় চার মাস পরেই পাকিস্তান হতে এমনকি বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচেষ্টায় পূর্ব-পাকিস্তানে গোপন তৎপরতার সংবাদও ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে প্রকাশের কথা লেখা হয়েছে পূর্বোল্লিখিত ব্রিটিশ দলিলের ৬৪১-৪২ পৃষ্ঠায়। পরবর্তী ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ দ্বারা পূর্ব-পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের স্বীকৃত স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র’, যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে ছিল সার্বজনীনভাবে অবিশ্বাস্য। ফলে এর বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলনে অগত্যা মামলাটি প্রত্যাহার করে দেয়া হয় জাতীয় নির্বাচন। (উল্লেখ্য, মামলাটির ২৬ নং অভিযুক্ত কর্তৃক এর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে সুদীর্ঘ ৪৩ বছর পর। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এবং মৃত কর্নেল শওকত আলীর ‘সত্য মামলা আগরতলা’ নামীয় বইটি দ্রষ্টব্য)।

ইয়াহিয়া খানের সাথে মতবিরোধে পদত্যাগী আইয়ুব খান ভাষণে বলেন, ‘I Cannot preside over the dissolution of Pakistan.’ (পাকিস্তানের ভাঙনে আমি সভাপতিত্ব করতে পারি না)। প্রতিকূল নির্বাচনী ফলাফলে ৬ দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্রে সত্যতার বিবেচনায় ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় তারা ছিল বদ্ধপরিকর। বরং সামরিক অভিযানে পাকিস্তানের ভাঙন রক্ষার কৃতিত্বের দাবি তারা করেছেন। তবে মারাত্মক কোনো ক্ষতি বা বিপর্যয় এড়াতে কূটনৈতিক ব্যবস্থা করত ভারতের সাথে একান্তই জড়ানো কৌশলী যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছাও তাদের ছিল বলে জানা যায়। ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত Bangladesh Documents, Vol-1, P-15, ‘WHY BANGLADESH’ শিরোনামে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার একদল বিশেষজ্ঞের প্রকাশিত মতামতে বলা হয়েছে, ‘বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবি পাকিস্তানি নিষ্ঠুর বর্বরতায় চাপায়ে দেয়া হয়েছে।’