করোনার প্রেক্ষাপটে এবারের স্বাধীনতা দিবস

লেখালেখিতে নিরপেক্ষতাই কাম্য

স্বাধীনতার মাস মার্চ। এই মাসের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি হলো, স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মহানায়ক-নায়ক-খলনায়কগণের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ, স্বাধীনতার বর্তমান অবস্থা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা। বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৬০ শতাংশের বেশি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। অতএব, তাদের উপকারার্থেই এ ধরনের আলোচনা বেশি প্রয়োজন। দেশবাসী সেই প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করে। পত্রিকাগুলো মাসব্যাপী প্রত্যেক দিন ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ঘটনাবলির স্মৃতি রোমন্থন করে। ২৫ এবং ২৬ মার্চ উপলক্ষে টেলিভিশন এবং পত্রিকাগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা বা রচনা উপস্থাপন করে; আগামীকাল ২৬ মার্চ ২০২০-সালেও করবে। মুক্তিযোদ্ধাগণ যারা এখনো বেঁচে আছেন এবং সক্ষম, তারা ফেসবুকে তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ২৫-২৬ তারিখে বা তার আগেও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সবই ভালো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ব্যতিক্রম ঘটছে। সব স্মৃতি রোমন্থন, ঘটনার পুনর্গঠন, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা সবকিছুর মধ্যেই একটা ‘কিন্তু’ আছে। ‘কিন্তু’টি হলো, লেখক বা উপস্থাপক বা আলোচকের দৃষ্টিভঙ্গি তথা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। আক্ষরিক অর্থেই, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে, রাজনীতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো কিছু বলা বা লিখা বা উপস্থাপন করা কঠিন; তা হলেও কেউ-না-কেউ এরূপ করার চেষ্টা করেছেন এবং করেই চলছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনটি স্পষ্ট আঙ্গিক আছে। প্রথম আঙ্গিকটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক আঙ্গিক। দ্বিতীয়টি হলো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক আঙ্গিক। তৃতীয় আঙ্গিকটি হলো, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের কর্মগুলো, যুদ্ধগুলো, ত্যাগগুলো, আত্মত্যাগগুলো। সব ত্যাগের নির্যাস ছিল একটি স্বাধীন দেশ অর্জন করা বা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের পর সবার আগ্রহ ও চেষ্টার নির্যাস হলো, সেই অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখা, অর্থবহ রাখা।

করোনাভাইরাস এবং লণ্ডভণ্ড অনুষ্ঠান
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই, মুক্তিযুদ্ধকালে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল যে, তারা ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এ জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল এবং আছে। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালের বেশ কিছু কলঙ্ক বা কেলেঙ্কারির ঘটনা এবং বিশেষ করে ২০২০ সালের কিছু আর্থিক ও প্রশাসনিক কেলেঙ্কারির ঘটনা, আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ও সুনামের ওপর বাস্তবভিত্তিক কঠোর নেতিবাচক আঘাত হানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সর্বশেষ দুইটি ভারত সফরে, নয়া দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আর কলকাতায় যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কূটনৈতিক সৌজন্য প্রদর্শনে গাফিলতি বা তার অবমূল্যায়ন, বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি এবং আওয়ামী লীগ ও ভারত সরকারের মধ্যে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনায় বাদ সাধে। দুর্যোগটি হলো করোনাভাইরাসের আক্রমণ। ইংরেজি ভাষায় প্রবাদ আছে ‘ম্যান প্রপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস’। বাংলা ভাষায় এর তাৎপর্য হলো : মানুষ নিজের মনের খুশিতে বা নিজের প্রয়োজনে ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করে, একজন আরেকজনকে জানায়, কিন্তু চূড়ান্তভাবে মানুষের সব কর্ম প্রসঙ্গে ফয়সালা প্রদান করেন (ইংরেজদের ভাষায় গড) মহান আল্লাহ। করোনা ভাইরাস এসে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী লণ্ডভণ্ড করেনি, ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়েশাদির অনুষ্ঠানাদি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা কতটুকু বাস্তবায়িত হলো বা হলো না, সে আলোচনা আজকের কলামের উদ্দেশ্য নয়। করোনাভাইরাস নামক মহাবিপদ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে; তা সত্ত্বেও আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করছি। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, মানুষ বাঁচবে-মরবে, কিন্তু স্বাধীনতা যেন বাঁচে।

ঐক্য বনাম বিভাজন

১৯ মার্চ ১৯৭১ : তখন ছিল ঐক্য, এখন আছে বিভাজন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান গাজীপুর জেলার সদর দফতর যেখানে অবস্থিত সেই ভাওয়াল রাজাদের আবাস ভবনে (ভাওয়াল রাজবাড়িতে) স্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কনিষ্ঠতম অফিসার এবং কনিষ্ঠতম বাঙালি অফিসার ছিলাম তখন। এখন ওই স্থানটি ‘গাজীপুর জেলা সদর’ বলে পরিচিত। ১৯৭১ সালে এটা জয়দেবপুর থানা সদর বলে পরিচিত ছিল। আমাদের জন্য তথা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য, মুক্তিযুদ্ধ ১৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখেই ধরা দিয়েছিল। সেই ১৯৭১ সালে ১৯ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ছিল উত্তেজনায় এবং অনিশ্চয়তায় ভরা, যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহে প্রদীপ্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হাজারো বড়-ছোট ঘটনা বা উপাখ্যানের মধ্যে, ১৯ মার্চের ঘটনা অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত। আমাদের মূল্যায়ন হলো : বঙ্গবন্ধু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রেরণায় এবং নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধও গুরুত্বপূর্ণ; সে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের অংশগ্রহণকারীরাও গুরুত্বপূর্ণ। অতএব সব মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানো এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সাথে জড়িত রাখা, সরকারের দায়িত্ব। কথাগুলো বলতে হয় এজন্য যে, বাংলাদেশকে এখন এমন অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে ‘তৃতীয় পক্ষ’ থাকার জায়গা নেই, যেখানে কোনো ‘মধ্যম পক্ষ’ থাকার জায়গা নেই। এই বিভাজনটি বর্তমান বাংলাদেশ শাসনকারী রাজনৈতিক দলটিই করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলেও, আমরা পারিনি এবং পারার কোনো লক্ষণ এখনো দেখছি না। এরূপ পরিস্থিতির কাছে আমরা সবাই আজ জিম্মি।

সবার যুদ্ধ, সবার দায়বদ্ধতা
মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার, স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও সবার। ওপরের তিনটি অনুচ্ছেদের আলোচনাটি করলাম এ জন্য যে, সম্মানিত পাঠকদের নিকট আমার মনের আকুতিটি যেন স্পষ্ট হয়। আকুতিটি হলো : মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবার, বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সবার এবং সেই স্বাধীনতার রক্ষার দায়িত্বও সবার। আমরা মনে করি, ‘সবার’ বলতে সব রাজনৈতিক দলের সদস্যরা শামিল, এ দলগুলোর বাইরের কোটি কোটি জনতা শামিল, সব ধরনের ছাত্র, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, পেশাজীবী সবাই শামিল, মানে, এটা সবারই দায়িত্বের আওতায় পড়ে। অতএব, যদি স্বাধীনতার ওপর হুমকি আসতে পারে এমন কিছু মনে হয়, অথবা অর্থবহ-স্বাধীনতার অর্থকে যদি কেউ ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করে, তাহলে অবশ্যই আমাদের সাবধান সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। সেই সাবধানতা, সেই সচেতনতা এবং সেই উচ্চারণ প্রকাশের কোনো অলঙ্ঘনীয় সময়সূচি নেই।

২০১৭ থেকে ২০ সালের গুরুত্বের আঙ্গিক
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গোলযোগ হয়, এক দিন পরই নিপীড়িত নির্যাতিত রোহিঙ্গা মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। বর্তমান রূপে ও আকারে রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশের গত ৪৯ বছরে মোকাবেলা করা অন্যতম বড় সমস্যা। তাই শিরোনামে ‘২০১৭ সাল’ লিখেছি। ২০২০ সাল চলছে, তবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠানমালা নয়, শুধু করোনাভাইরাস নয়, আরো অনেক কারণে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এ বছর। তাই ‘২০২০ সাল’ লিখে রেখেছি। আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে এই চারটি বছর, বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। ওই দ্বন্দ্বগুলোর সাথে, অবশ্যই আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পড়ে না- এমন অনেক কিছুই জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ এর কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি। এক. আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা জড়িত; দুই. আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর আন্তঃদেশীয় রাজনীতির আঙ্গিকে বাংলাদেশের অবস্থান জড়িত; তিন. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব জড়িত। অতএব, বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে বা কোন দিকে যাওয়া উচিত বা বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করা সব সচেতন নাগরিকের জন্যই প্রয়োজন। এই অনুচ্ছেদে যে তিনটি আঙ্গিক উল্লেখ করলাম, তার সম্পূরক কিছু বক্তব্য নিচে উপস্থাপন করছি।

চীন ও রোহিঙ্গা সমস্যা
২০১৮ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে একজন নতুন চীনা রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন যার নাম ছিল ঝ্যাং জুয়ো (বর্তমান চীনা রাষ্ট্রদূতের পূর্বসূরি)। ওই নবাগত রাষ্ট্রদূত মহোদয় ২১ মার্চ ২০১৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিলেন, সেটি এখনো প্রণিধানযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক। ওই সময় ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় খবরটি যেমন উদ্ধৃত হয়েছিল, তেমনটিই এখানে হুবহু উদ্ধৃত করছি। ‘রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান হবে না।’ ঢাকায় চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ঐতিহাসিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সব বিষয় মিলিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটটি এতটাই জটিল যে, তার আশু কোনো সমাধান নেই। খবর বিডিনিউজের।

সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশের ওই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো তার দেশের এ মনোভাবের কথা জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেইজিং ‘গভীর মনোযোগের সাথে দেখছে’ বলেও চীনের প্রতিনিধি জানিয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়ে নজর রাখার কথা জানিয়েছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো। তিনি বলেছিলেন, আমরা আপনাদের অবস্থান সম্পর্কে জানি, আপনাদের উদ্বেগও বুঝি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এর একটি সমাধান খুঁজে নেবে। রাষ্ট্রদূত জুয়ো বলেছিলেন : রোহিঙ্গা সঙ্কটে চীনের কোনো স্বার্থ নেই। ঢাকায় চীনের দূতাবাসে দোভাষীর মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যেন সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে বিষয়ে সহযোগিতা করছে তার দেশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন : তবে আমরা দেখছি, রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানের আশু কোনো উপায় নেই; কারণ এটা একটি জটিল সমস্যা; ঐতিহাসিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিষয় এতে জড়িত।’

এ পর্যায়ে কলাম লেখক সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের মন্তব্য : সম্ভবত কূটনৈতিক সৌজন্যের কারণেই, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে চীনা রাষ্ট্রদূত যেটা বলেননি, সেটি হলো : এই সমস্যা সমাধানের জন্য একদিকে ভারত ও বাংলাদেশ এবং অপর দিকে চীন ও বাংলাদেশ এই উভয়ের সম্পর্কের সমীকরণ প্রয়োজন। আরো যে কথাটি তখনকার রাষ্ট্রদূত বলেননি তা হলো, রোহিঙ্গাবিহীন রাখাইনে চীনের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলগত স্বার্থ এবং কৌশলগত অর্থনৈতিক বিনিয়োগের নিরাপত্তা জড়িত। চীনা রাষ্ট্রদূত মহোদয় যেমন বলেননি, কোনো কূটনীতিবিদই হয়তো তা বলতেন না। কারণ, রাষ্ট্রদূতদের থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া ব্যতিক্রম। ১৭ মার্চ ২০১৮ তারিখের ‘বণিকবার্তা’ নামক বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার কালো হরফের বড় শিরোনাম ছিল : ‘বাংলাদেশে চীনের কৌশলগত বিনিয়োগগুলো প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে’। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের বর্তমান (২০২০) অবস্থা এবং চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সিরিয়াস মূল্যায়নের দাবি রাখে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কও ব্যতিক্রম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বা মুক্তিযুদ্ধের কথা আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই অবশ্যই ভারতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। এ আলোচনায় অনেকগুলো আঙ্গিক আছে; যথা- রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক। আঙ্গিকগুলো আলোচনা করতে গেলে আওয়ামী লীগ দলীয় বা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন আলোচকের মূল্যায়ন এবং অন্যদের মূল্যায়নে মৌলিক বা বড় পার্থক্য পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ দলীয় মূল্যায়নে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রধান এবং অলঙ্ঘনীয় নোঙর হলো ১৯৭১। আওয়ামী লীগের দলীয় মূল্যায়নে বাংলাদেশ ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ, অসীম কৃতজ্ঞ এবং এই কৃতজ্ঞতাবোধ অব্যাহতভাবে, নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশযোগ্য ও প্রকাশিতব্য। অন্যদের মূল্যায়নে, ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেই; তবে সেটা অসীম হওয়া সমীচীন নয়; ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭১ ছাড়া আরো নোঙর আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাও, বাস্তবতার নিরিখে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে গিয়ে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। চ্যালেঞ্জটি হলো, কৃতজ্ঞতাবোধের সীমারেখা কোথায়? এখানে ২৪ মার্চ ২০১৮ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রথম পৃষ্ঠার সবার ওপরে ডান দিকে প্রকাশিত একটি ছবিসহ প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ওই সংবাদটির উৎস হচ্ছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, প্রখ্যাত চিকিৎসক-মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। চারটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। ‘বাংলাদেশের সব সমস্যার জন্য দায়ী হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে। এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে বিএনপিকে মাশুল দিতে হবে। ভারতকে চিনতে ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, এই কলামের লেখকের আজকের মন্তব্য : মাশুল শুধু বিএনপিকেই দিতে হবে না, পর্যায়ক্রমে সব দলকেই দিতে হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এ কথাটি আজো প্রযোজ্য।

ইবরাহিমের মন্তব্য
চীন এবং ভারত প্রসঙ্গে একাধিক সংবাদ উদ্ধৃত করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সফররত ভারতীয় রাজনীতিবিদ বা ঢাকায় অবস্থান কূটনীতিবিদদের পক্ষ থেকে সম্মানিত বাংলাদেশীদের প্রায়ই বলা হয় যে, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে বন্ধুত্ব নয়, বন্ধুত্ব হবে বাংলাদেশের মানুষের সাথে। ‘এরকম একটি ক্লারিফিকেশন বা ব্যাখ্যা দেয়ার পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ হলো, বাংলাদেশের মানুষ, সব রাজনৈতিক দলের মানুষ, বিশ্বাস করে যে, ভারতের কারণেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে এবং ভারতীয় বুদ্ধি-পরামর্শেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীগুলো সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। এ দেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ সন্দেহ করে যে, ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় যে অভিনব পদ্ধতিতে গভীর রাতে ভোট ডাকাতি হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সমর্থন ছিল। জনগণের মধ্যে যারা সচেতন, তারা মনে করেন, সাধারণ জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব নেতাদের। জনগণের দায়িত্ব নেতা বেছে নেয়া। এটা হচ্ছে পারস্পরিকভাবে অনুঘটকের ভূমিকা। নেতা প্রসঙ্গে নিচের অনুচ্ছেদে অন্য একজনের কথা তুলে ধরলাম।

একটি উদ্ধৃতি
আমি আরেকজন সাংবাদিকের মন্তব্য উদ্ধৃত করছি। ‘এমন অবস্থা নিয়ে দেশ চলছে। ষোলো কোটি মানুষের দেশ, হাজারো সমস্যা এখানে। এ থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইয়ে পথ দেখাবে কোন সেই সৎ ও সাহসী মানুষ। জনগণ এমন এক নেতৃত্বের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। আর এ কথা সত্য, এমন সৎ-সাহসী মানুষ আকাশ থেকে নামবে না। আমাদের মধ্য থেকেই তারা আসবে। যারা ভালো কাজ করতে চায়, তারা কদাচিৎ যেচে এগিয়ে আসে, তাদের খুঁজে বের করতে হয়। সভ্য সমাজে এই খোঁজার প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। … এ পর্যন্ত যারা দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সততা, নিষ্ঠা এবং যোগ্যতার বিপুল ঘাটতি ছিল তাদের। তারা ক্ষমতার চর্চা করেছেন। যারা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন করেছে, তাদের কল্যাণে তারা মনোযোগী ছিলেন না। আগামীতে এমন… যারা ক্ষমতায় যাবেন, তারা কল্যাণের পথে অগ্রসর হবেন। যারা ভোট দিয়ে নেতা বানিয়েছে তাদের সজাগ থাকতে হবে।’ এখানেও ইবরাহিমের মন্তব্য : নেতা বেছে নেয়ার এই প্রক্রিয়া, পৃথিবীব্যাপী অনুসৃত, কিন্তু আমাদের দেশের জন্য শতভাগ ফলপ্রসূ নয়। কারণ আমরা আমাদের দুর্নীতিযুক্ত চিন্তা দিয়ে, আমাদের লোভী মানসিকতা দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করি। গত ১৮ মার্চ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার কলামের শিরোনাম ছিল ‘পরিবর্তনের সুবাতাস চাই : ঘূর্ণিঝড় নয়।’ আজ ২৫ মার্চ ২০২০ সালে আমার মন্তব্য- বাতাস আসবেই, সুবাতাসকে যদি বাধাগ্রস্ত করা হয় তখন ঘূর্ণিঝড় অবশ্যম্ভাবী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসকে স্মরণে আনছি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য তখন সুবাতাস বইতেও পারত। কিন্তু তখনকার সামরিক শাসকরা সে সুবাতাসকে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন। সে বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ-এর রাত্রিতে অসংখ্য বাঙালিকে এক রাত্রিতে হত্যা করা। তারা ২৫ মার্চের রাত্রিকে ‘কালরাত্রি’ বানিয়েছিল। পরের দিনই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। সেই আঘাত মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। স্বাধীনতা রক্ষা করার অন্যতম পন্থা চির সচেতনতা। তাই ইংরেজিতে বলা হয় : ইটারনাল ভিজিলেন্স ইজ দ্য প্রাইস অব লিবার্টি। সম্মানিত পাঠক, আজ ২৫ মার্চ ২০২০। গত ২৫ দিনে ধীরে ধীরে করোনাভাইরাসের আক্রমণ বাংলাদেশে এসেছে। ১৭ মার্চকে সামনে রেখে, ওই ১৭ দিন প্রচার ও প্রচারণা কম ছিল। সরকার বহুবার বহু ভাষায় বহু কথনে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এই সঙ্কট মোকাবেলায় প্রস্তুত! বাংলাদেশে আসার আগে ‘করোনাভাইরাস’ নামক ভীতিকর ‘মেহমান’টি, বাংলাদেশকে অন্তত দুই মাসের ওয়ার্নিং টাইম বা গ্রেইস পিরিয়ড দিয়েছে। এ ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম চীনে। তারা এই পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করলেন এবং অন্যান্য আক্রান্ত দেশ কিভাবে মোকাবেলা করল, সেটি দেখা বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ ছিল বাংলাদেশের; সেখান থেকে গঠনমূলক শিক্ষা নেয়ার সুযোগ ছিল আমাদের সরকারের। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার সেই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার পর্যাপ্ত করেন নি। বিদেশফেরত ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা, আবার তাদের হোম-কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থাপনা, হাসপাতালে যথেষ্ট সিটের ব্যবস্থা করা, পরীক্ষার কিট ব্যবস্থাপনা, বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, সরকারি কোয়ারেন্টিন সৃষ্টি করা ইত্যাদি সবকিছুতেই একটা লুকোচুরি ভাব ছিল; এটা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পেল অবহেলা ও ব্যর্থতা রূপে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য, যথা করোনাভাইরাসের আক্রমণের শিকার কতজন বা কতজন এতে মারা যাচ্ছে, সেই তথ্যটি নিয়েও মানুষের মনে অনাস্থা আছে। বিলম্বে সেনাবাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে, দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মটিকে আমরা স্বাগত জানাই। করোনাভাইরাস আক্রমণ তথা সঙ্কটটি আওয়ামী লীগের সঙ্কট নয়; সব রাজনৈতিক দলের এবং দেশের সব মানুষের। সরকারের ভুলগুলোকে নিম্নমাত্রায় উল্লেখ রেখে, সবার মেধা ও শক্তি প্রয়োগ করে এই সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে বাধ্য, আগামী সপ্তাহে আমার কলামটিও আপনারা পাবেন না, তার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। পার্থিব যত চেষ্টা আছে, সব করতে হবে। সাথে সাথে মহান আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd