এরই নাম ‘বিচার’?

দিল্লি নয়, এটা পিরোজপুরের ঘটনা। কোন ঘটনাটি বেশি গুরুতর, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রতিকার দিতে গিয়ে একজন হাইকোর্টের বিচারপতিকে বদলি হতে হয়েছিল। আর পিরোজপুরে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের জামিন নামঞ্জুর করার পর একজন জেলা ও দায়রা জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ হতে দেখা গেল।

দীর্ঘদিনের বিরতিতে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এমন একটি ঘটনা প্রকাশ্যে এল, যা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এর সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও এর সঙ্গে সুস্থ রাজনীতি বা দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নটিও মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

একটি দৈনিকের শিরোনাম হলো, ‘সাবেক এমপি আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীর জামিন নিয়ে দিনভর নাটক, জেলা ও দায়রা জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ: রাস্তায় কাঠের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবাদ, ইন্দুরকানিতে হরতাল পালন।’

জনাব আবদুল আউয়াল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবনভর আওয়ামী লীগ করেছেন। দুবার সাংসদ ছিলেন। পিরোজপুরে তাঁর মেজ ভাই পৌর মেয়র, সেজ ভাই সদর উপজেলা চেয়ারম্যান। ছোট ভাই জেলা চেম্বার্স সভাপতি, এক ভাগনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। পারিবারিকভাবে সবাই আওয়ামী লীগার বলা যায়।

তবে তাঁর বিরুদ্ধে জাল দলিল করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তটি দুদক বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গেই করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তারা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলেই এই দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলাটি বিএনপি আমলের বা ওয়ান–ইলেভেনের পরের সরকারের দায়ের করা নয়। সম্প্রতি যখন তাঁরা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেলেন, তখন পিরোজপুরে দুই সহস্রাধিক মোটরসাইকেল, অর্ধশতাধিক গাড়িশোভিত একটি বিশাল শোডাউন হয়। ওই শোডাউনের খবর পড়েই আন্দাজ করেছিলাম, এই শোডাউন এলাকার দলীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই শুধু নয়। এটা ছিল ‘টু হৌম ইট মে কনসার্ন’ (যাহার জন্য প্রযোজ্য) ধরনের কাজ।

কিন্তু পিরোজপুরের আদালত পরে তাঁর স্থায়ী জামিনের দরখাস্ত নামঞ্জুর করে দিলে তাৎক্ষণিক ভাঙচুর হলো শ ম রেজাউল করিমের স্থানীয় অফিস। তিনি সম্প্রতি গণপূর্ত দপ্তরের মন্ত্রিত্ব হারিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েছেন। ঢাকায় সার্বক্ষণিক আইনজীবী পেশায় থেকে সাংসদ হওয়া রেজাউলের স্থানীয় খুঁটিগুলো বোধগম্য কারণেই দুর্বল। ৩ মার্চ তাঁর অফিস ভাঙচুর হওয়ার অল্প আগে আদালতে জামিনের শুনানির একপর্যায় অভিযুক্ত আউয়াল বিচারককে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।’ তাঁর এ বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলে তা কঠোর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, এমনকি গুরুতর অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে। আওয়ামী লীগে আউয়ালের ক্যারিয়ার দীর্ঘ—এ কথা সত্য। তেমনি এবারে দুদকের মামলাসূত্রেই নয়, অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে দুর্নীতির খবর এসেছে।

পিরোজপুরের রাজনীতির মাঠে আমরা মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার দূষণ দেখেছি। সেই মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার আলোকচিত্র সংবাদমাধ্যমে বড় করে এসেছে। এমনকি আউয়ালকে দেওয়া আগাম জামিনের বিরোধিতা আমরা চেম্বার জজে দেখেছি। দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলো দেখিয়েও বলেছেন, আগাম জামিন পেয়ে আউয়াল এলাকায় কী করেছেন। চেম্বার জজ অবশ্য হাইকোর্টের আদেশ সমুন্নত রেখেছিলেন।

গত ৩ মার্চে পিরোজপুরের আদালত কক্ষে উপচে পড়া ভিড় ছিল। জেলা বারের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, জিপিসহ একজন সাবেক পিপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বারের সাবেক সভাপতিসহ প্রায় ২৫ জন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন। কিন্তু জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় ভেতরে ‘বিষাদের ছায়া’ নেমে আসে। বাইরে চলে বিক্ষোভ। গাড়ি চলাচল বন্ধ এবং সড়ক অবরোধ করে ত্রাস কায়েম করা হয়। আইনজীবীরা আসামীদের পক্ষে গিয়ে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এধরনের বর্জনের বৈধতা আছে কিনা সন্দেহ।

এরপর ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দুটি ঘটনা ঘটল। জামিন নামঞ্জুর হওয়ামাত্রই আউয়াল দম্পতি যুগপৎ অসুস্থ হলেন। তাঁরা তাঁদের মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিলেন। এর ফলে কারাগারে পাঠানোর আদেশে পরিবর্তন এল। অর্থাৎ হাকিম থাকতেই হুকুম একটু নড়ল। তাঁরা উভয়ে ডিভিশন পেলেন। হাসপাতালবাস নিশ্চিত হলো। কিন্তু এ আদেশদানের ১৫ মিনিট পরে বিচারক স্ট্যান্ড রিলিজ হলেন।

চিকিৎসার কারণে বন্দীর হাসপাতালে থাকা ইদানীং আর খবর নয়। বাংলাদেশের বিচারিক ও চিকিৎসা জগতে এটা একটা ইতিহাস তৈরি করেছে। পিরোজপুরে তাতে নতুন করে কিছু লেখা হলো।

কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে খটকা যেটা লেগেছে, সেটা হলো জেলা ও দায়রা জজের আদেশ যুগ্ম জজ উল্টে দিতে পারেন কি না। পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনের বর্তমান জামিন আদেশটি গোড়া থেকে বাতিল কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। তাঁরা জামিন কেন পেলেন, তা আমাদের প্রশ্ন নয়। জামিন লাভে যে কারও ন্যায়সংগত অধিকার সমর্থনযোগ্য। কিন্তু একটা আইনি প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার নয়।

স্ট্যান্ড রিলিজ কথাটি থানার ওসি, এসপি বা বিরল ক্ষেত্রে ডিসির ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এখন পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুল মান্নানের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখলাম। এর চেয়ে বিস্ময়কর হলো আদেশদানকারী বিচারকের আদেশে কী করে তাঁর কনিষ্ঠ বিচারক হাত দিতে পারেন। এটা তো একমাত্র হাইকোর্টের এখতিয়ার। বিদায়ী বিচারক তাঁর আদেশটি নিজেই রিকল বা দরখাস্তক্রমে পুনঃশুনানি করতে পারতেন; যা তিনি একবার করেছেনও।

জেলা জজের দ্বারা হাসপাতালে পাঠানোর দ্বিতীয় আদেশে ক্ষুব্ধ হতেই পারেন আউয়াল ও লায়লা দম্পতি। আউয়াল আইনপ্রণেতা ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের তিনি বর্তমান সভাপতি। তিনিই জেলার প্রথম আইন মান্যকারী হবেন; এটাই প্রত্যাশিত। জনগণের কাছে তিনি নৈতিক কর্তৃপক্ষ হওয়ার কথা।

তিনি চাইলেই কিছুটা সময় হাসপাতালে থাকতে পারতেন। সেখান থেকেই তিনি হাইকোর্টে আপিল করতে পারতেন। রাষ্ট্রপক্ষ পরিষ্কার বলতে পারত, তারা জামিনের বিরোধিতা করবে না। দুজন এভাবে জামিন পেতে পারতেন। কিন্তু যা ঘটল, তাতে জনগণের মনে পড়বে, সাম্প্রতিককালে বহুল উচ্চারিত উক্তি: জামিন নির্বাহী বিভাগের বিষয় নয়, এটা আদালতের বিষয়। অবশ্য স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়ে হলেও জামিনটা তো আদালতই দিয়েছেন।

কিন্তু বিচার বলব কোনটিকে? ভরদুপুরের জামিন নাকচ নাকি পড়ন্ত বেলার জামিনদানের আদেশকে। আইনগতভাবে, আউয়াল জামিন নামঞ্জুরের আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের আইনজীবী কারাগারের ডিভিশনের দরখাস্ত করেছেন, তা থেকেই বোঝা যায় যে তাঁরা আদালতের আদেশের মধ্যে থেকেই যা করার তা করতে চেয়েছেন। আর জেলা জজ তা মঞ্জুরও করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই পেয়ে গেলেন জামিনের আদেশ।

সাবেক সাংসদ আউয়াল বড় নেতা, কিন্তু কী এত বড় নেতা যে যাঁর জন্য রাষ্ট্রকে তার আপন নিয়ম ভাঙার ঝুঁকি নিতে হবে! কিন্তু দৃশ্যত তেমন একটা কিছুই তো হলো। কেন এত বড় বিচ্যুতির পদক্ষেপ নেওয়া হলো? জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে একটা বার্তা জোরেশোরে রটল। এর ‘চিলিং অ্যাফেক্ট’ অনিবার্য। কেউ কী চাইলেন বা চাইলেন না, সেটা অপ্রাসঙ্গিক।

ঢাকা ট্রিবিউনকে (৪ মার্চ সংখ্যা) আইন মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, দুর্নীতির অভিযোগে জেলা জজকে স্ট্যান্ড ওএসডি করা হয়েছে। সরল প্রশ্ন, সেটা ওই জামিন নাকচের পরেই? শুধু ঝটিকা বদলি নয়, ওই দিনই তাঁর বিচারিক ক্ষমতা হরণ করাই যেন লক্ষ্য ছিল, সেটাই প্রতীয়মান হয়েছে। এখন এরকম একটা সরকারি ব্যাখ্যা এলো যে, আইনজীবীদের সঙ্গে ‘গুরুতর অসদাচারণের’ কারণে ‘তাৎক্ষণিক বদলি’ ও ‘উদ্ভুত পরিস্থিতি’ সামলাতে জামিন দিতে হয়েছে। তাহলে ‘বিচার’ কোথায় দাঁড়ালো?

জেলা জজ মানে প্রজাতন্ত্রের একটি প্রশাসনিক একাংশের প্রধান বিচারক। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝলাম বিচারকের চেয়ে রাষ্ট্রের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দলের একটি জেলা কমিটির সভাপতির চাওয়া-পাওয়া।

দুর্নীতির দায়ে একজন অভিযুক্ত আউয়ালের প্রতি রাষ্ট্র কী করল? আর একইভাবে তথাকথিত অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের প্রধান বিচারকের প্রতি রাষ্ট্র কী আচরণ করল?

বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজের মূল বেতন স্কেল ৭০,৯২৫ টাকা, অতিরিক্ত জেলা জজের ৬২,৩৫০ টাকা, যুগ্ম জেলা জজের ৫৮ হাজার টাকা। পিরোজপুরে অতিরিক্ত জেলা জজের পদ শূন্য ছিল। তাই যুগ্ম জেলা জজকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ করা হলো। হয়তো কেউ বলবেন, জেলা জজের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হিসেবে যুগ্ম জেলা জজ তাঁর জ্যেষ্ঠের আদেশ রদ করেছেন। কিন্তু বিচার বিভাগ তো চলে রীতি–রেওয়াজের ভিত্তিতে। সেটা তো রইল না।

এর নামই কি বিচার?

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail. com