আরপিও’র সংশোধনী আনার উদ্যোগ অপ্রয়োজনীয় ও হঠকারী : বিএনপি

Daily Nayadiganta

সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর – ছবি : নয়া দিগন্ত


রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আইন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরপিও’র অনেকগুলো মৌলিক সংশোধনী আনয়নের জন্য নির্বাচন কমিশন যে সময়টিকে বেছে নিয়েছে বিএনপি’সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে অপ্রয়োজনীয়, হঠকারী ও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগ কোনো বিবেচনাতেই স্বাভাবিক কিংবা সময়োচিত নয় বরং অস্বাভাবিক, অনভিপ্রেত, অগ্রহণযোগ্য এবং মহল বিশেষের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অপকৌশল বলে আমরা মনে করি।

বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, যেকোনো জনগুরুত্বসম্পন্ন নতুন আইন প্রণয়নে জনমত গ্রহণ, সংশ্লিষ্টজনদের অবারিত মত প্রদানের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং আইনের ভাষা ও শব্দচয়নে সর্তকতা গ্রহণ অতিশয় প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত। অথচ বিদ্যমান সময়ে এর কোনোটাই সম্ভব নয় জানা সত্ত্বেও যে আইন পরিবর্তনের বা স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের জন্য কোনো জন দাবি নেই এবং যা এখনই করা আদৌ জরুরি নয় তেমন একটি কাজ হাতে নেয়ার জন্য কমিশনের উদ্যোগ অসময়োচিত, সামর্থের অপব্যয় ও সন্দেহজনক।

তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিস্ময়কর কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যেই কুখ্যাতি অর্জন করেছে। গত সাড়ে তিন বছরে তাদের মেয়াদকালে অনেক অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের জনস্বার্থবিরোধী মানসিকতারই প্রকাশ পায়নি, তাদের অসততা ও অযোগ্যতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। ২০১৪ সালে নির্বাচন করেছে রাজনৈতিক দলবিহীন নির্বাচন। ২০১৮ সালে করেছে ভোটারবিহীন ‘নৈশ’ নির্বাচন। আর প্রস্তাবিত আরপিও’র মাধ্যমে আগামীতে করতে চায় নির্বাচন কমিশনবিহীন প্রহসনের নির্বাচন। ২০১৪ সালে এক অদ্ভুত নির্বাচন আয়োজন করে বসেছিল রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তখনকার নির্বাচন কমিশন। নজিরবিহীন এ কাণ্ড করার জন্য শতাধিক আসনে নির্বাচন কমিশন নিজেই একজন বাদে অন্য প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করে দেয়। সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে একাধিক প্রার্থী নাই ঘোষণা করে ভোট গ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়, নির্বাচনের দিনের আগেই সরকারি দল নির্বাচনে জিতেছে তা নিশ্চিত করা হয়। এই নির্বাচনে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়। অর্থাৎ নির্বাচনের দিন ভোট প্রদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলেও সরকার গঠনে তাদের যেন কোনো সমস্যা না হয় তা আগেই নিশ্চিত করে নেয়া হয়। মানুষ নির্বাচনটির নাম দিয়েছে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানো বা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশনকে তৎপর দেখা যায়। প্রয়োজনে তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু কোনো দিন কোনো কমিশন (বা সরকারি প্রতিষ্ঠান) নিজের ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে, এটি কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছে নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে রকিবউদ্দিন কমিশনও একই কাজ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হননি। আইন হচ্ছে একটি রক্ষাকবচ। আইন পরিবর্তনের কাজে কমিশন হাত দিতে পারে না। সরকার চাইলে নির্বাচন কমিশন সরকারকে আইন করার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু স্বপ্রণোদিত হয়ে কমিশনের আইন প্রণয়নের উদ্যোগ সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। আইন পরিবর্তন করে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করা অনেকটা আত্মহত্যার শামিল।

তিনি বলেন, বর্তমান কমিশনের অকার্যকারিতা সম্পর্কে সবাই জানে, আইন পরিবর্তন করার মাধ্যমে তারা জনগণের কাছে আরো ঘৃণ্য হিসাবে গণ্য হবে। বর্তমান আইনে মনোনয়নপত্র বাতিলের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। কমিশন এই ক্ষমতা নিজেদের কাছে রাখতে চায় না। ফলে কমিশন বিড়ালে পরিণত হবে মর্মে একজন নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করেছেন।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন এখন আর স্বাধীন নেই। তারা সরকারের হুকুম তামিলের জন্য আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কমিশন সরকার নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় সব কাজ করছে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রকল্প কমিশন সরকারের হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তাব। এটা হলে ভোটার তালিকা তৈরির ক্ষমতা সরকারের কাছে চলে যাবে। ফলে সরকার নিজের ইচ্ছামতো ভোটার তালিকা প্রণয়নের সুযোগ পাবে। সেই ভোটার তালিকায় প্রকৃত ভোটার নয়, সরকারী দলের পছন্দের লোকজনকে স্থান করে দেয়া হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা জাতীর জন্য একটি অশনিসঙ্কেত ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি সঠিক ও স্বচ্ছ ভোটার তালিকার অপরিহার্যতা সবারই জানা। আর এ কারণে সংবিধানের ১১৯(১)(২) অণুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সংসদ নির্বাচন ও সংবিধান ও অন্য কোনো নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন, তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনকে প্রদান করা হয়েছে।

ফখরুল বলেন, বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি এদেশের মানুষ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক দলের নূন্যতম শ্রদ্ধা কিংবা আস্থা নাই। আর এজন্য নিঃসন্দেহে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যারা গলাটিপে হত্যা করেছে কেবলমাত্র তারা এবং তাদের সহযোগী হিসেবে নির্লজ্জ ভূমিকা রাখা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বশংবদ নির্বাচন কমিশনই দায়ী। এ নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। একটি নিরাপেক্ষ সরকারের তত্বাবধানে এবং একটি স্বাধীন ও নিরাপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের প্রতি এতো অভিযোগ থাকা সত্বেও আইনের দারস্থ হচ্ছেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিচার থাকলেতো বিচার পাবো। আদালতসহ সব জায়গা ধংস করে ফেলা হয়েছে। বলার অবকাশ রাখে না যে, সেক্রেটারিরা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রমাণ করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত।