সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন আতাউস সামাদ

আতাউস সামাদ
আতাউস সামাদ – ছবি সংগৃহীত


সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আতাউস সামাদ ছিলেন সততা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার মহীরুহ। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গনতন্ত্রের খাঁটি ‘সতর্ক প্রহরী’। তিনি অন্যের মাধ্যমে প্রভাবিত বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হতেন না। ‘সত্যনিষ্ঠ’ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায়, সেটিই ছিলেন তিনি। ঘটনার ভেতরের ঘটনা বের করে আনতে পারতেন। অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় আতাউস সামাদের জুড়ি ছিল না। তার কোনো প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক হয়নি, তিনি জীবনভর সুনাম বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন।
শনিবার সকালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের আয়োজনে সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্মরণে ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।

সভায় নেতৃবৃন্দ আতাউস সামাদের সৃত্মিচারণ করেন। এবং সভা শেষে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।

ডিইউজের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, বিএফইউজের সভাপতি রুহল আমীন গাজী, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, বিএফইউজের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, বিএফইউজের সিনিয়র সহ-সভাপতি নূরুল আমীন রোকন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউ’র সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, ডিইউজের সহ-সভাপতি শাহীন হাসনাত, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোরসালিন নোমানী, সাবেক যুগ্মসম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম, সিনিয়র সাংবাদিক আবু মুস্তাকিম, ডিইউজের দফতর সম্পাদক ডিএম আমিরুল ইসমাম অমর, খন্দকার আলমগীর হোসেন প্রমুখ।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আতাউস সামাদ সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতেন। কোনো বিষয়ে খটকা লাগলে তিনি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লিখতেন না। সব কিছু নিখুঁতভাবে করতে চাইতেন তিনি। কাজের ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সচেতন থাকতেন৷ তার অভিধানে ফাঁকিবাজি বলে কোন শব্দ ছিলনা। তাই তার সাংবাদিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে নি। সবার কাছে অন্য ধরণের গ্রহণযোগ্যতা ছিল তার।

আতাউস সামাদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সামাদ ভাই বলতেন, ‘গণতন্ত্র আছে, সাংবাদিকতা আছে; গণতন্ত্র নেই, সাংবাদিকতা নেই’। এই দৃঢ় বিশ্বাস থেকে তিনি সবসময় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন।
আতাউস সামাদ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন। মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। সাংবাদিকদের দাবি আদায়ের জন্যও কাজ করেছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন। এদেশের মানুষ বস্তুনিষ্ঠ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, মূল্যবোধ ও পাণ্ডিত্যের জন্য সারাজীবন আতাউস সামাদকে স্মরণ করতে হবে।

রুহুল আমিন গাজি বলেন, সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের যেকোনো সঙ্কট ও দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ। অসাংবিধানিক সরকার, স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদের দিনগুলোতে দৈনিক আমার দেশ ও এনটিভিকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন।চরম বিপদের মুখেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাংবাদিকদের আগলে রেখেছেনপরম আদরে। হুমকিকে তিনি পরোয়াই করেননি কখনো।

তিনি বলেন, আতাউস সামাদ অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম রিপোর্টার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে সহায়তা করেন
আতাউস সামাদ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজ-এর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন মার্শাল ল’ চলাকালীন ১৯৮২ সালের অক্টোবর থেকে। তার সাহসী বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টগুলো সামরিক সরকারের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অস্বস্তিদায়ক ও বিব্রতকর। এসময় বিবিসি ‘হাসিনা অন্তরীণ : খালেদা আত্মগোপনে : জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ারি’ এবং ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি’ শিরোনামে দু’টি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। নিরাপত্তার খাতিরে তাকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। আত্মগোপনে থেকেও তিনি নিয়মিত বিবিসিকে আসন্ন গণঅভ্যুত্থান ও সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্যাবলি জোগান দেন। ১৯৮৭ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি বলেন, ১৯৯৪-৯৫ সালে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসানোর প্রচেষ্টায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
আতাউস সামাদের সবচেয়ে বড়গুন ছিল তিনি পেশাদারিত্বের সাথে আপস করেননি। তিনি ‘সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা’; ‘সাদাকে সাদা, কালোকে কালো’ বলতে পারতেন। তাই শেষ দিকে এসে সুবিধাবাদীদের অনেকেই উনাকে আর পছন্দ করলেন না।

শওকত মাহমুদ বলেন,আতাউস সামাদ ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ সাংবাদিক এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।
১৯৬১ সালে আজাদ পত্রিকার রিপোর্টিংয়ে সাংবাদিকতার শুরুতে আইয়ুবশাহী আর মৃত্যুকালেও ফ্যাসিবাদের ধারালো খড়গ দেখে গেলেন। তিনি সাংবাদিকতার যে ধারাটিকে বহমান রেখেছিলেন সেই পরম্পরা দিয়ে কেউ আমরা যথেষ্ট দায়িত্বশীল অধ্যয়ন-বিশ্লেষণে যাইনি।
একটি সৎ, পরিচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আতাউস সামাদ সু ও স্বশিক্ষিত হয়েছেন। কাজ করেছেন আজাদ, সান, পাকিস্তান অবজার্ভার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বাংলাদেশ টাইমস, বিবিসি, দৈনিক আমার দেশ, এনটিভি, সাপ্তাহিক এখন ইত্যাদি গণমাধ্যমে। দাপটের রিপোর্টারি জীবনে আগরতলা মামলা, বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সঙ্গে দিল্লি থেকে প্লেনে দেশে ফেরা, গণতন্ত্রের আন্দোলনে কারাবাস সত্ত্বেও নির্ভীক চিত্তে দেশ কাঁপানো সাংবাদিকতা করা, শীর্ষ কাগজগুলোতে মূল্যবান রাজনৈতিক কলাম স্মরণের অতীত হওয়ার নয়।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তিনি ও তার পরিবার সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশের নির্বিঘ্ন অধিকারের পক্ষে তাবৎ আন্দোলনেই অংশ নিয়েছেন। আবার গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের সময় দুই নেত্রীর সঙ্গে মধ্যস্থতা বিষয়ে পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের কমিটির একজন ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাংবাদিকদের নিয়ে মিছিল করেছেন।

তিনি বলেন, অনেক রিপোর্টার প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর তটস্থ থাকতেন- এই বুঝি আতাউস সামাদের প্রেরণামূলক, শিক্ষামূলক বা ভর্ৎসনামূলক ফোন এলো! বিবিসি রেডিওতে সাদামাটা বা কাঠ কাঠ রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু বিশ্লেষণীয় বক্তব্য বা রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার। প্রতিবেদন বা রচনার শরীরে চুমকি বসানোর ঘোরতর বিরোধী। সাধারণ মানুষ তার মন-মগজে ছিলেন সর্বক্ষণ।
জাতির প্রতিটি সঙ্কটকালে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

এম আবদুল্লাহ আতাউস সামাদের স্মৃতি চারণ করে বলেন, তিনি যেভাবে প্রতিবেদন তৈরি করতেন তা সত্যিই অনুকরণীয়। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে তাকে জেলও খাটতে হয়েছে। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আতাউস সামাদের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তিনি সব সময় দেশ ও মানুষের কথা ভাবতেন।

কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, আতাউস সামাদ সাংবাদিকতার শিক্ষক ছিলেন l তার অকুতোভয় ও সাহসী লেখনী বাংলাদেশের মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে।
১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করার পর আতাউস সামাদকে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছিল সামরিক ও স্বৈরশাসনের অধীনে। প্রথমে (১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত) পাকিস্তানের তথাকথিত ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এবং পরবর্তীকালে (১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। শ্বাসরুদ্ধকর সেই বছরগুলোতে দুর্দান্ত সাহসী ছিল আতাউস সামাদের ভূমিকা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দারা বিরামহীনভাবে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়েছে, প্রলোভনও কম দেখানো হয়নি। কিন্তু ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে এবং প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন চালিয়েও তাকে সত্য প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এমনকি গ্রেফতারও বরণ করেছেন। ১৯৮০-র দশকের ওই দিনগুলোতে মানুষ আতাউস সামাদ এবং গিয়াস কামাল চৌধুরীর পাঠানো খবর শোনার জন্য সাগ্রহে রেডিও খুলে বসে থাকত।

সভাপতির বক্তব্যে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, সাংবাদিক আতাউস সামাদ ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং একজন খাঁটি ওয়াচডগ (সতর্ক প্রহরী)। তার ডাকনাম ছিল খোকন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন খোকনের মতোই সহজ, সরল, প্রাণখোলা।

বরেণ্য এ সাংবাদিক ছিলেন সবসময় ‘সত্যের’ পক্ষে। মানুষের পক্ষে। গণতন্ত্রের পক্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে। সততা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় তিনি এ দেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সৎ সাংবাদিকতার পথিকৃত ছিলেন, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হতেন না তিনি। ঘটনার ভেতরের ঘটনা বের করে আনতে পারতেন।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন আতাউস সামাদ। অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় আতাউস সামাদের জুড়ি ছিল না। তার কোনো প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক হয়নি, তিনি জীবনভর সুনাম বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন।
সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার ছিলেন তেমনি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য কখনও আপস করতেন না।
সূত্র : প্রেস বিজ্ঞপ্তি